মুসা ও খিযির পর্ব-১

মুসা (আঃ) ও খিযির (আঃ) এর ঘটনা বহু আলোচিত ঘটনা। সুফীরাও অনেকে নিজের স্বার্থে যে যার মত ব্যাখা করে। তাফসীরবিদদের মতে এই ঘটনা সংগঠিত হয় মুসা (আঃ) ও বনী ইসরায়েল জাতীর হিজরতের পূর্বে। সুরা কাহাফ নাযিল হয় ইহুদিদের প্রশ্নের জবাবে। মুসা (আঃ) ও খিজিরের (আঃ) ঘটনায় ইহুদিদের ভুল তুলে ধরা হয়। ইহুদিরা অনেকে উযাইরকে (আঃ) আল্লাহর পুত্র বলত নাউজুবিল্লাহ!! (সুরা কাহাফ-৪ সুরা তওবা – ৩০)। কথিত আছে- ইহুদিরা তাওরাত যখন ভুলে যায়, তখন উযাইর (আঃ) একদিনে তার স্মৃতি হতে তাওরাত লিখে দেন। এটা নিয়ে তারা পরবর্তীতে যুক্তি দেখায়- মুসা (আঃ) এর উপর বহুবছর ধরে তাওরাত এসেছিল আর উযাইর (আঃ) একদিনে তা লিখে দেখান। তাই তিনি শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানিয়ে দেন, এটা আল্লাহর ইচ্ছে তিনি যাকে যতটুকু ইচ্ছে জ্ঞান দেন। মুসা (আঃ) জীবিত অবস্থায় কিছু ক্ষেত্রে খিযিরের (আঃ) জ্ঞান মুসা (আঃ) এর চেয়ে বেশি ছিল, তারমানে এই নয় খিযির (আঃ) শ্রেষ্ঠ। বরং মুসা (আঃ) আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম পাঁচজন রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত।

হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হ’তে আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) একদা বনী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কোন ব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী? তিনি বললেন, আমিই সর্বাধিক জ্ঞানী। জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ না করার কারণে আল্লাহ্‌ তাকে তিরস্কার করে বললেন, বরং দু’সাগরের সঙ্গমস্থলে আমার এক বান্দা আছে, যিনি তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। অতঃপর আল্লাহর আদেশ মত তিনি সফর শুরু করলেন। এক সময় মুসা (আঃ) ও খিজিরের (আঃ) দেখা হয়। মূসা (আঃ) তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, এখানে সালাম কি করে এলো? তিনি বললেন, আমি মূসা। খিজির জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈল বংশীয় মূসা? মূসা (আঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি এসেছি এজন্য, যে সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা হ’তে আপনি আমাকে শিক্ষা দিবেন। খিযির বললেন, হে মূসা! আমার আল্লাহ্‌ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আপনি জানেন না। আর আপনিও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এমন কিছু জ্ঞানের অধিকারী, যা আমি জানি না। মূসা (আঃ) বললেন, আমি কি আপনার সাথী হ’তে পারি? খিজির বললেন, ‘আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। আপনি আমার সঙ্গে থেকে আমার কার্যাবলী দেখলে আমার নিকট তথ্যানুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকবেন। যেমনটি ছাত্র শিক্ষককে শিক্ষণীয় বিষয়ে অবিরত প্রশ্নবাদ করতে থাকলে তাকে সঙ্গে রাখা দুস্কর হয়ে পড়ে। তাছাড়া তুমি কিরূপে ধৈর্যধারন করবে এমন বিষয়ে যাহা তোমার জ্ঞান সীমার বাহিরে। (সূরা কাহ্ফ: ৬৮)।

এরপর ঘটনাগুলো সংক্ষেপ বিবরন হল- খিজির (আঃ) ও মুসা (আঃ) যে নৌকায় উঠে খিজির (আঃ) সেই নৌকা ফুটো করে, মুসা (আঃ) তার বিরোধিতা করে। এরপর খিজির (আঃ) একজন বালককে হত্যা করে, তারা উভয়েই একটা জনপদে প্রবেশ করে। খিজির (আঃ) একটা প্রাচীর নির্মান করেন কিন্তু প্রারশ্রামিক নেননি। সব ঘটনায় মুসা (আঃ) প্রতিবাদ করেন ফলে তাদের যাত্রা বিছিন্ন হয়। পরবর্তীতে খিজির (আঃ) তার ব্যাখা দেন।

প্রথমতঃ সেই নৌকাটির ব্যাপার এই ছিল যে, সেটির মালিক ছিল কয়েকজন গরীব লোক। সাগরে যারা জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিলাম এই কারণে যে, সামনে এমন এক বাদশাহর এলাকা রয়েছে যে প্রত্যেকটি নিখুঁত অর্থাৎ ভাল নৌকা জোর পূর্বক ছিনিয়ে নিত। তাই সেই রাজা যেন তা নিতে না পারে বা নিতে না চায়। এভাবে জালেম শাসক হতে অসহায়দের রক্ষা করেন। এই ঘটনায় শিক্ষনীয় হল এই – তাকদীরের ভালোমন্দের জ্ঞান আল্লাহর নিকট। আল্লাহ যাকে জানান শুধু তিনি তা জানতে পারেন। স্বাভাবিকভাবে থাকলে মনে হবে গরীব মাঝি নেককাজ করলো অথচ তার উপর বিপদ আসলো। কিন্তু নেককাজের বদৌলতে সে জালেম হতে রক্ষা পেল যা তার অগোচরে হল। এভাবে আমাদের জীবনেও ঘটে, আমরা তার ব্যাখা জানি না, শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে আল্লাহর প্রতি। আর এই ঘটনায় শিক্ষা ছিল ইউশা ইবনে নুন (আঃ) (মুসার (আঃ) সঙ্গী, যিনি পরবর্তীতে নবী ছিলেন) ও বনী ইসরায়েল জাতির জন্য। মুসা (আঃ) খিজিরের (আঃ) কর্মকান্ডের ব্যাখা না বুঝে আতংকে বলে উঠেছিলেন -মূসা বলল, ‘আপনি কি আরোহীদেরকে ডুবিয়ে দেবার জন্য তাতে ছিদ্র করলেন?! আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন (সুরা কাহাফ- ৭১)। পরে ব্যাখা পেয়ে তিনি শিক্ষা পেলেন। এ ঘটনা মুসা (আঃ) এর নবুওয়তের প্রাথমিক সময়ের, তখন খিযিরের (আঃ) কিছুক্ষেত্রে জ্ঞান মুসার (আঃ) চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ও আজও কুরআনের পর তাওরাত, ইনজিল শ্রেষ্ঠ কিতাব। আর মুসা (আঃ) শ্রেষ্ঠতম রসুলদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গন্য। তাই পরবর্তীতে যখন বনী ইসরায়েলের অনেকে এই ঘটনা হতে শিক্ষা না নিয়ে হিজরতের সময় ফেরাউনের কাছে ধরা পড়ার ভয় করলো। মুসা (আঃ) এর ঈমান দৃঢ় ছিল। কুরআনে বর্নিত- “অতঃপর যখন দু’দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা বলল, ‘আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম।’ মূসা বললেন, কখনই নয়! আমার সঙ্গে আছেন আমার রব সত্বর তিনি আমাকে পথনির্দেশ করবেন।” (সুরা আশ শুআরাঃ ৬১-৬২ )। পরবর্তীতে মুসা (আঃ) এর দোয়ায় আল্লাহ জালেম ফেরাউনকে ডুবিয়ে মারেন।

প্রকৃতপক্ষে বনী ইসরায়েলের অনেকে উযাইর (আঃ) ও খিজির (আঃ) কে বাড়াবাড়ি করে মুসা (আঃ) এর উর্ধ্বে স্হান দিত। অনেকে ঝড়-তুফানে খিজির (আঃ) এর সাহায্য চাইতো। অথচ কুরআন সুস্পষ্ট জানায় – খিজির (আঃ) জালেম শাসক হতে বাচাতে নৌকা ফুটো করেছেন আর আল্লাহ মুসা (আঃ) ও বনী ইসরায়েলকে বাচাতে জালেম ফেরাউন ও তার সেনাকে ধ্বংস করেছেন। এখানেও মুসা (আঃ) এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। তাফসীরবিদগন কেউ কেউ বলেন- খিজির ছিলেন নবী, কেউ বলেন ফেরেশতা, কেউ বলে বুজুর্গ। যদি নবী বা ফেরেশতা হন তিনি ওহীর জ্ঞানের ভিত্তিতে করেন আর বজুর্গ হলে আল্লাহ প্রদত্ত ইলহাম বা নির্দেশনা অনুযায়ী করেন, নিজ হতে নয়। তাই খিজির (আঃ) নিজেও বলেছিলেন – “আর ঐ প্রাচীরটি— সেটা ছিল নগরবাসী দুই ইয়াতিম কিশোরের এবং এর নীচে আছে তাদের গুপ্তধন আর তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। কাজেই আপনার রব তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ইচ্ছে করলেন যে, তারা বয়ঃপ্ৰাপ্ত হোক এবং তারা তাদের ধনভাণ্ডার উদ্ধার করুক। আর আমি নিজ থেকে কিছু করিনি; আপনি যে বিষয়ে ধৈর্য ধারণে অপারগ হয়েছিলেন, এটাই তার ব্যাখা।” (সুরা কাহাফ-৮২)। প্রকৃতপক্ষে মুসা (আঃ) এর মত বিজ্ঞব্যক্তি স্বাভাবিক মানবিক জ্ঞান (কিয়াস ও ইজতেহাদ) দিয়ে খিজির (আঃ) এর আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান বা ওহীর জ্ঞানকে ব্যাখা করতে সক্ষম হননি বরং একনিষ্ঠ অনুসরণ ছিল উত্তম উপায়। তাহলে মুসা (আঃ), যার উপর তাওরাত নাযিল হয়েছে বনী ইসরায়েল কিভাবে স্বাভাবিক মানবিক জ্ঞান দিয়ে তা ব্যাখা করতে পারবে। বরং মুসা (আঃ) এর সুন্নাহের একনিষ্ঠ অনুসরন হলো নাজাত লাভের পথ। তাওরাত অনুযায়ী- রাসুল (সাঃ) কাংক্ষিত রাসুল। মূল শিক্ষা হল- ওহীর জ্ঞান বা আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানকে যুক্তির উর্ধ্বে গিয়ে অনুসরণই মুক্তির উপায়। তাই সাহাবীরা মেরাজ ও ইসরার ঘটনা বিনা যুক্তিতে মেনে নিয়েছিলেন। দাজ্জালের সময় কুরআন, সুন্নাহের জ্ঞান একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও অনুসরণ মুক্তির উপায় হবে। পরবর্তী পর্বে মুসা ও খিজির, ইউশা নুনের বাকী ঘটনা ব্যাখা হবে ইনশাআল্লাহ।

মুসা ও খিজির পর্ব-২

মুসা ও খিজির পর্ব-৩

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *