উয়াইস ক্বারনীর নামে পীর মুরিদী ব্যাবসা

262902962 154209000263877 5181320425348714354 N

উয়াইস ক্বারনী সব মাযহাব ও হাদীসমতে শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী। ইসলামের ইতিহাসে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু জীবন কাহিনী ও হাদীসকে বিকৃত করে পীর-মুরিদী চালু করেছে। কল্পকাহিনি বাদ দিয়ে আগে হাদীস দেখি- উসাইর ইবনু ‘আমর মতান্তরে ইবনু জাবের থেকে বর্ণিতঃ উমার (রাঃ)- এর নিকট যখনই ইয়ামান থেকে সহযোগী যোদ্ধারা আসতেন, তখনই তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোমাদের মধ্যে কি উয়াইস ইবনু ‘আমের আছে?’ শেষ পর্যন্ত (এক দলের সঙ্গে) উয়াইস (ক্বারনী) (রহঃ) (মদ্বীনা) এলেন। অতঃপর উমার (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি উয়াইস ইবনু আমের?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ উমার (রাঃ) বলেন, ‘মুরাদ (পরিবারের) এবং ক্বার্ন (গোত্রের)?’ উয়াইস (রহঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি (পুনরায়) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার শরীরে শ্বেত রোগ ছিল, তা এক দিরহাম সম জায়গা ব্যতীত (সবই) দূর হয়ে গেছে?’ উয়াইস (রহঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা আছে?’ উয়াইস (রহঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘‘মুরাদ (পরিবারের) এবং ক্বার্ন (গোত্রের) উয়াইস ইবনু আমের (রহঃ) ইয়ামানের সহযোগী ফৌজের সঙ্গে তোমাদের কাছে আসবে। তার দেহে ধবল দাগ আছে, যা এক দিরহাম সম স্থান ছাড়া সবই ভাল হয়ে গেছে। সে তার মায়ের সাথে সদাচারী হবে। সে যদি আল্লাহর প্রতি কসম খায়, তবে আল্লাহ তা পূরণ করে দেবেন। সুতরাং (হে উমার!) তুমি যদি নিজের জন্য তাকে দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনার দো‘আ করাতে পার, তাহলে অবশ্যই করবে।’’ সুতরাং তুমি আমার জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ শোনা মাত্র উয়াইস (রহঃ) উমারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। অতঃপর উমার (রাঃ) তাঁকে বললেন, ‘তুমি কোথায় যাবে?’ উয়াইস (রহঃ) বললেন, ‘কূফা।’ তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমার জন্য সেখানকার গভর্নরকে পত্র লিখে দেব না?’ উয়াইস (রহঃ) বললেন, ‘আমি সাধারণ গরীব-মিসকীনদের সাথে থাকতে ভালবাসি।’ অতঃপর যখন আগামী বছর এল তখন কূফার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হজ্জে এল। সে উমার (রাঃ)- এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাকে উয়াইস (রহঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, ‘আমি তাঁকে এই অবস্থায় ছেড়ে এসেছি যে, তিনি একটি ভঙ্গ কুটির ও স্বল্প সামগ্রীর মালিক ছিলেন।’ উমার (রাঃ) বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘‘মুরাদ (পরিবারের) এবং ক্বার্ন (গোত্রের) উয়াইস ইবনু আমের (রহঃ) ইয়ামানের সহযোগী ফৌজের সঙ্গে তোমাদের নিকট আসবে। তার দেহে ধবল রোগ আছে, যা এক দিরহামসম স্থান ছাড়া সবই ভালো হয়ে গেছে। সে তার মায়ের সাথে সদাচারী (মা-ভক্ত) হবে। সে যদি আল্লাহর উপর কসম খায়, তাহলে আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেবেন। যদি তুমি তোমার জন্য তার দ্বারা ক্ষমাপ্রার্থনার দো‘আ করাতে পার, তাহলে অবশ্যই করবে।’’ অতঃপর সে (কূফার লোকটি হজ্জ সম্পাদনের পর) উয়াইস (ক্বারনীর) (রহঃ) নিকট এল এবং বলল, ‘আপনি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ উয়াইস (রহঃ) বললেন, ‘তুমি এক শুভযাত্রা থেকে নব আগমন করেছ। অতএব তুমি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘তুমি উমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছ?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ।’ সুতরাং উয়াইস (রহঃ) তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। (এসব শুনে) লোকেরা (উয়াইসের) মর্যাদা জেনে নিল। সুতরাং তিনি তার সামনের দিকে (অন্যত্র) চলে গেলেন (মুসলিম)। মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় উসাইর ইবনু জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, কুফার কিছু লোক উমার (রাঃ)-এর নিকট এল। তাদের মধ্যে একটি লোক ছিল, সে উয়াইসের (রহঃ) সাথে উপহাস করত। উমার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে ক্বার্ন গোত্রের কেউ আছে কি?’ অতঃপর ঐ ব্যক্তি এল। উমার (রাঃ) বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের নিকট ইয়ামান থেকে উয়াইস (রহঃ) নামক একটি লোক আসবে। সে ইয়ামানে কেবলমাত্র তার মা-কে রেখে আসবে। তার দেহে ধবল রোগ ছিল। সে আল্লাহর কাছে দো‘আ করলে আল্লাহ তা এক দ্বীনার অথবা এক দিরহাম সম স্থান ব্যতীত সবই দূর করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমাদের কারো যদি তার সাথে সাক্ষাৎ হয়, তাহলে সে যেন তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।’’ অন্য এক বর্ণনায় আছে, উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘‘সর্বশ্রেষ্ঠ তাবেঈন হল এক ব্যক্তি, যাকে উয়াইস (রহঃ) বলা হয়। তার মা আছে। তার ধবল রোগ ছিল। তোমরা তাকে আদেশ করো, সে যেন তোমাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমাপ্রার্থনা করে।’’ মুসলিম ২৫৪২, আহমাদ ২৬৮, দারেমী ৪৩৯, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৩৭৭ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস। এখান হতে অনেকে দলিল দেয় জান্নাতে যেতে হলে পীর ধরা ও মুরীদ হওয়া ফরজ। পীর ছাড়া মাগফেরাতের দোয়া কবুল হয় না। আসুন হাদীসের সহজ ব্যাখা দেখি- উয়াইস ক্বারনীর মাগফেরাত বা ক্ষমার দোয়া করার বহুপূর্বে রসুল (সাঃ) উমরের (রাঃ) মাগফেরাতের দোয়া ও জান্নাতের সুসংবাদ দেন। এখানে মূলত আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল উয়াইস ক্বারনীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবেন। তাই রসুল (সাঃ) উমরকে (রাঃ) উয়াইস ক্বারনী দ্বারা দোয়া করান, এতে উমর (রাঃ) নয় বরং উয়াইস ক্বারনীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। উমর (রাঃ) আগে হতেই সুমহান মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। যেমন- দূরুদে ও আযানের পর আমরা রসুলের (সাঃ) জন্য দোয়া করি এতে রসুলের (সাঃ) নয় বরং আল্লাহর নিকট আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বরং হাদীস হতে এই শিক্ষা নেওয়া যায়- অনেক বড় দ্বীনদার ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত কম আমল করা ব্যক্তির কাছে মাগফেরাতের দোয়া চাইতে পারে এবং তার নেতৃত্বে দোয়া করা যায়। কারণ উমর (রাঃ) এর আমলের তুলনায় উয়াইস ক্বারনীর আমল অতি সাধারণ। আবার ভাবুন- তথাকথিত কয়জন পীরসাহেব মুরীদকে দিয়ে বা তার কাছে মাগফেরাতের দোয়া করাইছে বা চাইছে? আর যদি উয়াইস ক্বারনী দোয়া করলে কেউ মাগফেরাত পেত তাহলে তিনি দোয়া না করে রিয়ার ভয়ে কেন পালালেন? বরং কুরআন, হাদীস বলে- আল্লাহ প্রতিটি ব্যক্তির ডাকই শুনেন। আপনার যদি নিশ্চিত জানা থাকে এরকম কোন আল্লাহর প্রিয় আলেম আছে তাকে দিয়ে মাগফেরাতের দোয়া করান। কিন্তু উয়াইস ক্বারনীর মর্যাদা ও দোয়া কবুলের ঘটনা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর তথাকথিত পীরসাহেবগণ কতটা কুরআন, হাদীসের উপর চলে যাচাই করুন। আর পিতামাতার দোয়া সন্তানের জন্য কবুল হয় বেশি। উয়াইস ক্বারুনীও মায়ের সেবা করতেন। তাই পিতামাতা সন্তানদের জন্য দোয়া করুক এবং এভাবে গড়ে তুলুক তারাই পিতামাতার জন্য মাগফেরাতের দোয়া করবে। মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিমের (আঃ) দোয়া কবুল হওয়ার কথা আল্লাহ কুরআনে বর্ণনা করেছেন। অর্থ : “হে আমার প্রতিপালক! তারা (সন্তান-সন্তুতি) যাতে সালাত প্রতিষ্ঠা করে। কাজেই তুমি মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও। আর ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর; যাতে তারা (আল্লাহ তায়ালার) শুকরিয়া আদায় করতে পারে।” আর উয়াইস ক্বারনী (রহঃ) ছিলেন রসুল (সাঃ) ও সাহাবীদের আদর্শে চলা প্রকৃত মুমিন। তিনি কোন সুফীবাদী ছিলেন না৷ তিনি যেমন মায়ের সেবা, তাহাজ্জুদসহ সকল আমল করতেন, তেমনি ছিলেন আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ। তিনি সিফফিনের যুদ্ধে আলীর (রাঃ) পক্ষে জেহাদ করে শহীদ হন। অনেকে তাকে আলীর (রাঃ) দলে দেখে দলত্যাগ করে আলীর (রাঃ) দলে যোগ দেয়। এমন ছিল সাহাবী ও তাবেয়ীদের জীবন, তারা যেমন ব্যক্তিগত আমল করতেন নরম হৃদয়ে তেমনি জেহাদের ময়দান ঝাপিয়ে বেড়াতেন কঠোর প্রতিরোধে। বর্তমানে উয়াইস ক্বারনীর (রহঃ) ওয়াজ দিয়ে আয় করা পীর, শায়েখগণ জেহাদের ওয়াজই ঠিকমত করে না।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *