তালহা (রাঃ) ছিল রসুল (সা:) থেকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ সাহাবীদের অন্যতম। তার জীবনী মুমিনদের আদর্শ, অনুপ্রেরনা। অপরদিকে তার শাহাদাত বেদনাদায়ক, হক্ব গ্রহনে সদা অগ্রগামী হওয়ার প্রমান ও মুনাফেকদের ষড়যন্ত্রের প্রকাশ।
সীরাত গ্রন্থ হতে জানা যায়- তিনি ছিলেন যেমন উত্তম মুজাহিদ তেমনি দানশীলতার ক্ষেত্রে উত্তম উদাহরণ রেখে গিয়েছেন মুসলিম উম্মাহর জন্য। ঈমান আনার পর অন্যদের মতো তালহারও (রা:) জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এরপর হিজরত করেন।
হিজরত করার পরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবূ আইয়ুব আনসারী (রা)-এর সঙ্গে তাঁর ভ্রাতৃ সম্বন্ধ স্থাপন করেন। বদর ব্যতীত সকল জিহাদ অভিযানে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে উপস্থিত ছিলেন। বদর যুদ্ধের সময় তিনি ব্যবসা উপলক্ষে শামে অবস্থান করেছিলেন।
অথবা মতান্তরে দূত প্রতিনিধিরূপে দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং সে কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বদরের প্রতিদান ও গনীমতের অংশ প্রদান করেছিলেন। উহুদ যুদ্ধে ছিল তাঁর সমুজ্জ্বল অবদান। রাসুল (সা.) কাফিরদের আক্রমণে মারাত্মক আহত হন। তাঁর শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়। দান্দান মোবারক শহীদ হয়। হজরত তালহা বীরবিক্রমে আক্রমণ করে কাফিরদের কিছুদূর হটিয়ে দিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে ফিরে এসে তাঁকে কাঁধে করে পাহাড়ের ওপরে উঠছিলেন। আবার কাফিরের দল এগিয়ে এলে তিনি রাসুল (সা.)-কে রেখে তাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। এভাবে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে একটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তিনি একসময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। ইতিমধ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুল (সা.)-কে কেন্দ্র করে সমবেত হতে থাকেন। হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি ও আবু উবায়দা (রা.) রাসুলুল্লাহর কাছে এসে তাঁর সেবার জন্য গেলে তিনি বলেন, তোমরা আমাকে ছেড়ে তোমাদের ভাই তালহার খবর নাও।
আবু বকর (রা.) বলেন, আমরা দেখি কিছু দূরে একটি গর্তের মধ্যে তালহা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীরে তরবারি, তীর ও বর্শার সত্তরটির বেশি আঘাত ছিল। উহুদের যুদ্ধের এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) তালহা (রা.) সম্পর্কে বলতেন, ‘যদি কেউ কোনো মৃত ব্যক্তিকে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াতে দেখতে চায়, তাহলে সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে দেখে।
এ দিন তাঁর হাত (আঘাতের আধিক্যে) অবশ হয়ে গিয়েছিল। কেননা, তাঁর হাত দ্বারা তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপরে আগত আঘাতসমূহ প্রতিহত করে তাঁকে হিফাজত করেছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত হাতখানি সে অবস্থায়ই ছিল। কেউ তাঁর হাতের কথা আলোচনা করলে আবূ বকর সিদ্দীক (রা) বলতেন, সে দিনটি সমগ্রই ছিল তালহা (রা)-এর জন্য। সে দিন রসূলুল্লাহ্ তাঁকে বলেছিলেন, “তালহা নিশ্চিতরূপে সাব্যস্ত করে নিয়েছে।
হাদীসে রয়েছে-
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) ত্বলহাহ্ ইবনু ‘উবায়দুল্লাহ (রাঃ)-এর প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, যদি কেউ এমন কোন লোককে জমিনের উপর চলাফেরা করতে দেখতে চায়, যে তার মৃত্যু-প্রতিজ্ঞাপূর্ণ করেছে, সে যেন এই লোকটির দিকে চেয়ে দেখে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, যদি কেউ এমন শহীদকে দেখতে চায়, যে জমিনের উপর বিচরণ করেছে, সে যেন ত্বলহাহ্ ইবনু উবায়দুল্লাহ-কে দেখে নেয়। (তিরমিযী)
সহীহ: তিরমিযী ৩৭৩৯, ইবনু মাজাহ ১২৫, সিলসিলাতুস সহীহাহু ১২৫। হাদিসের মানঃ সহিহ
কাইস ইব্নু আবূ হাযিম (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি ত্বলহা (রা)-এর ঐ হাতকে অবশ অবস্থায় দেখেছি, যে হাত দিয়ে (উহুদ যুদ্ধে) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রক্ষা করেছিলেন। (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪৪৬, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৪৫৩)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৭২৪
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ الأَشَجُّ، حَدَّثَنَا يُونُسُ بْنُ بُكَيْرٍ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ عَبَّادِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ، عَنِ الزُّبَيْرِ، قَالَ كَانَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ أُحُدٍ دِرْعَانِ فَنَهَضَ إِلَى صَخْرَةٍ فَلَمْ يَسْتَطِعْ فَأَقْعَدَ تَحْتَهُ طَلْحَةَ فَصَعِدَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى اسْتَوَى عَلَى الصَّخْرَةِ فَقَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ “ أَوْجَبَ طَلْحَةُ ” . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ .
যুবাইর ইবনু আও্ওয়াম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উহূদের যুদ্ধের দিন দু’টি লৌহবর্ম পরা ছিলেন। (যুদ্ধে আহত হওয়ার পর) তিনি একটি পাথরের উপরের ঊঠার চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি (উঠতে) পারলেন না। তিনি ত্বালহা (রাঃ)-কে তাঁর নিচে বসিয়ে তার কাঁধে চড়ে পাথরের উপর উঠে অবস্থান করেন। বর্ণানাকারী বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ ত্বালহা (তার জন্য জান্নাত) অনিবার্য করে নিয়েছে।
হাসানঃ ১৬৯২ নং হাদীস পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
ফুটনোটঃ
আবূ ‘ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ গারীব।
জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩৭৩৮
হাদিসের মান: হাসান হাদিস
তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সুহবাত-সান্নিধ্যে জীবন যাপন করেছেন এবং তাকে উত্তম সঙ্গ প্রদান করেছেন এবং তিনি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায় ওফাত প্রাপ্ত হন। আবূ বকর ও উমর (রা)-কেও তিনি উত্তম সান্নিধ্য দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায় তাঁরা ইহলোক ত্যাগ করেন। উসমান (রা)-এর মর্মান্তিক ঘটনার সময় তিনি দূরে সরে ছিলেন এবং এ কারণে অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে উক্ত ঘটনায় সঠিক আচরণ না করার (এবং প্রকারান্তরে বিদ্রোহীদের মদদ দেওয়ার) অভিযোগ করেছে। এ কারণেই জামাল যুদ্ধের দিন ময়দানে উপস্থিত হওয়ার সময় যখন ‘আলী (রা) তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন ও উপদেশ দিলেন তখন তিনি সম্মুখ ভাগ হতে সরে গিয়ে পিছনের কোন সারিতে অবস্থান করেন। এসময় তীরবদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হোন।
أَخْبَرَنِي الْوَلِيدُ، وَأَبُو بَكْرِ بْنُ قُرَيْشٍ، ثَنَا الْحَسَنُ بْنُ سُفْيَانَ، ثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدَةَ، ثَنَا الْحَسَنُ بْنُ الْحُسَيْنِ، ثَنَا رِفَاعَةُ بْنُ إِيَاسٍ الضَّبِّيُّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: كُنَّا مَعَ عَلِيٍّ يَوْمَ الْجَمَلِ، فَبَعَثَ إِلَى طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ أَنِ الْقَنِي فَأَتَاهُ طَلْحَةُ، فَقَالَ: نَشَدْتُكَ اللَّهَ، هَلْ سَمِعْتَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ يَقُولُ: «مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ، اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَلَاهُ، وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ» ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَلِمَ تُقَاتِلُنِي؟ قَالَ: لَمْ أَذَكُرْ، قَالَ: فَانْصَرَفَ طَلْحَةُ
[التعليق – من تلخيص الذهبي] 5594 – الحسن هو العرني ليس بثقة
রাফা’ বিন আয়াস জাবী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
আমরা জামালের যুদ্ধের দিন হযরত আলীর সাথে ছিলাম।হযরত আলী (রাঃ) তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রাঃ) কে তার সাথে দেখা করার জন্য বার্তা পাঠালেন।হযরত তালহা (রা.) তাঁর কাছে এলেন।হযরত আলী (রা.) বললেন,আমি তোমাকে আল্লাহর কসম করে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি আল্লাহর রসূল (সা.)-এর পবিত্র জবান থেকে এই কথাগুলো শুনেছো?রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন আমি যার মাওলা(অভিভাবক) আলীও তার মাওলা(অভিভাবক)।হে আল্লাহ যে আলীকে সাহায্য করে আপনিও তাকে সাহায্য করুন এবং যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা করে আপনিও তার সাথে শত্রুতা করুন।তালহা বললেনঃ হ্যাঁ।হযরত আলী বললেন,তাহলে আমার সাথে যুদ্ধ করছ কেন? হযরত তালহা (রা.) বললেন, আমার মনে ছিল না। এরপর হযরত তালহা (রা.) ফিরে গেলেন। (আল মুসতাদরাক হাকিম-৫৫৯৪)
অপর বর্ননায় রয়েছে –
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حَمْشَاذَ الْعَدْلُ، ثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ غَالِبٍ، ثَنَا يَحْيَى بْنُ سُلَيْمَانَ الْجُعْفِيُّ، ثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ إِسْمَاعِيلَ بْنِ أَبِي خَالِدٍ، عَنْ قَيْسِ بْنِ أَبِي حَازِمٍ، قَالَ: «رَأَيْتُ مَرْوَانَ بْنَ الْحَكَمِ حِينَ رُمِيَ طَلْحَةُ بْنُ عُبَيْدِ اللَّهِ يَوْمَئِذٍ فَوَقَعَ فِي رُكْبَتِهِ فَمَا زَالَ يُسَبِّحُ إِلَى أَنْ مَاتَ»
[التعليق – من تلخيص الذهبي] 5591 – صحيح
কায়স বিন হাযিম বর্ণনা করেন: “আমি মারওয়ান বিন হাকামকে দেখেছি তালহা কে তীর দ্বারা আঘাত করতে, যা তার হাঁটুতে বিদ্ধ হয় এবং তিনি শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে ইন্তিকাল করেন। [মুসতাদরাক হাকিম: ৫৫৯১, ইমাম হাকিম এবং যাহাবি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]।
এছাড়া আরও রয়েছে -তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা — ২২৩; ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা – ৩৮। ইবনে হাযার, তাহযীবুত তাহযীব, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২০। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৪। ইবনে আবদুল বার, আল-ইস্তীআব পৃষ্ঠা — ২০৭ ২০৮। ইবনে আবদুল বার বলেন : মারওয়ান হযরত তালহা (রাঃ)-এর সেনাবাহিনীতে শামিল ছিলেন, আর তিনিই হযরত তালহা (রাঃ)-কে হত্যা করেছেন—নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। আল্লামা ইবনে কাসীর আল-বেদায়ায় এ বর্ণনাকেই প্রসিদ্ধ বর্ণনা বলে স্বীকার করেছেন – ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৪৭।
তিনি ছিলেন জীবন্ত শহীদ। তার জীবন কেটেছে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় ও রসুলকে (সা:) রক্ষায় আর জঙ্গে জামালের ভয়ংকর মুহূর্তে তিনি রসুলের (সা:) হাদীসে বর্নিত – আলীর (রা:) মর্যাদার কথা শুনে যুদ্ধ হতে বিরত হোন। এটাই আমাদের জন্য শিক্ষনীয়- পরিস্থিতি, গুজব, মুনাফেকদের ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার যতই হোক না কেন সবসময় রসুলের (সা:) সুন্নাহ ও হাদীসের অনুসরণ করতে হবে। আর কাফেরদের হতে মুসলিমদের বড় শত্রু হল মুনাফেকরা। তারা চায় মুসলিমরা পরস্পর লড়াই করে দুর্বল হোক।
তার শাহাদাতে অনেকের কাছে স্পষ্ট হয় যে রসুলের (সা:) এর আহলে বায়াত হক্বের পথে ছিল।