পূর্ববর্তী জাতীর অনুসরন পর্ব-৩ (মুবাহালা)

আমরা এমন এক জমানায় আছি যেখানে হক্বের আলোচনার চেয়ে বেশিরভাগ আলেমরাই একে অপরের বিরুদ্ধে কাফের ফাতেয়া দিতে ব্যস্ত।

কাউকে দ্বীনের দাওয়াত দেন বহু দলিল যুক্তি, তর্কের পরও তা যদি তার মত বা তার পছন্দনীয় আলেমের বিরুদ্ধে যায় তাহলে পরস্পরকে কাফের, ইহুদির দালাল, ফেতনাবাজ বিভিন্ন উপাধি দিতে থাকে।

অথচ হক্ব বাতিলের দলিল হল- কুরআন ও সুন্নাহ।

আসুন কুরআন হতে দেখি – ইহুদি, খ্রিস্টানরা নিজেকে সত্য ও নাজাতপ্রাপ্ত একমাত্র দল দাবি করত। কুরআনের দাওয়াতকে প্রত্যাখান করে পূর্বসূরীদের নামে মিথ্যা দ্বীনের অনুসরণ করতো।

আল্লাহপাক বলেন-

অতঃপর আপনার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে আপনার সাথে তর্ক করে তাকে বলুন, এস, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদেরকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে, আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে, তারপর আমরা মুবাহালা (বিনীত প্রার্থনা) করি, অতঃপর মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা'নত।(সুরা আল ইমরান -৬১)

এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুবাহালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুবাহালা হলো, যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আল্লাহর লানতের অধিকারী হয়।

মূলত: লা’নত অৰ্থ আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া। আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া মানেই আল্লাহর ক্রোধে পড়া। এর সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর ক্রোধ বর্ষিত হোক। এরূপ করার পর যে পক্ষ মিথ্যাবাদী, সে তার প্রতিফল ভোগ করবে। সে সময় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয় অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এতে বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করলেই চলে। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু একত্রিত করলে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়।

৯ম হিজরীতে নাজরান থেকে খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধিদল নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে এসে তারা যে ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে অতিরঞ্জনমূলক আকীদা রাখত, সে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয় এবং মহানবী (সাঃ) তাদেরকে মুবাহালার আহ্বান জানান।

তিনি আলী, ফাতিমা এবং হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-দেরকে সাথে নিয়ে মুবাহালার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে আসেন এবং খ্রিষ্টানদেরকে বলেন যে, তোমরাও তোমাদের পরিবারের লোকদের সাথে নিয়ে এসো। তারপর আমরা মিথ্যাবাদীর উপর অভিশাপ বর্ষণের বদ দুআ করব। খ্রিষ্টানরা আপোসে পরামর্শ করে মুবাহালা করার পথ ত্যাগ করে বলল যে, আপনি আমাদের কাছে যা চাইবেন, আমরা তা-ই দিব। সুতরাং রসূল (সাঃ) তাদের উপর জিযিয়া-কর ধার্য করে দেন। আর এই কর আদায়ের জন্য তিনি আমীনে উম্মত (উম্মতের বিশ্বস্তজন উপাধি লাভকারী) আবূ উবায়দা ইবনে জাররাহ (রাঃ)-কে তিনি তাদের সাথে পাঠিয়ে দেন। (ইবনে কাসীর এর সারাংশ)

বুখারীর হাদীসে রয়েছে হুযাইফাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নাজরান এলাকার দু’জন সরদার আকিব এবং সাইয়িদ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর কাছে এসে তাঁর সঙ্গে মুবাহালা করতে চেয়েছিল। বর্ণনাকারী হুযাইফাহ (রাঃ) বলেন, তখন তাদের একজন তার সঙ্গীকে বলল, এরুপ করো না। কারণ আল্লাহ্‌র কসম! তিনি যদি নবী হয়ে থাকেন আর আমরা তাঁর সঙ্গে মুবাহালা করি তাহলে আমরা এবং আমাদের পরবর্তী সন্তান-সন্ততি (কেউ) রক্ষা পাবে না।

তারা উভয়ে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলল, আপনি আমাদের নিকট হতে যা চাবেন আপনাকে আমরা তা-ই দেব। তবে এর জন্য আপনি আমাদের সঙ্গে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিন। আমানতদার ব্যাতীত অন্য কোন ব্যক্তিকে আমাদের সঙ্গে পাঠাবেন না। তিন বললেন, আমি তোমাদের সঙ্গে এমন একজন আমানতদার পাঠাবো যে প্রকৃতই আমানতদার এবং পাক্কা আমানতদার। এ পদে ভূষিত হওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর সাহাবীগণ আগ্রহান্বিত হলেন। তখন তিনি বললেন, যে আবূ ‘উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ্‌! তুমি উঠে দাঁড়াও। তিনি যখন দাঁড়ালেন, তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এ হচ্ছে উম্মতের সত্যিকার আমানতদার। [৩৭৪৫]

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৩৮০
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
Source: আল হাদিস অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ,

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো – মুবাহালা হয়েছিল আকীদাগত, কারন তারা মুশরিক ছিল, মাসায়ালাগত নয়। মাসায়ালাগত একতেলাফ থাকা স্বাভাবিক। আজ চারপাশে মুসলিম দাবিদারেরর মধ্যে আকীদাগত দ্বন্দই বিদ্যমান, একদল যেটাকে শিরক, বিদআত, কুফর বলছে আরেক দলের নিকট এটা হালাল, সুন্নত।

যুগ যুগ ধরে পরস্পরকে দোষারোপ না করে বরং আকীদা নিয়ে মুবাহালা করুন দেখবেন খুব কম লোকই রাজি হবে।
কারণ সুনিশ্চিতভাবে জানে- তারা অধিকাংশ ভুল পথে আছে আর আল্লাহর কিতাব আর আল্লাহর আযাব সত্য। আমরা বলি- আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল বা জানার ভুল থাকলে আল্লাহ ক্ষমা ও হেদায়েত করুক আর যারা জেনেশুনে মিথ্যা ছড়ায় তারা আল্লাহর আযাবকে স্মরন করুন।

প্রায় একই নীতি ইহুদিদের ছিল- তারা নিজেদের হক্ব দাবি করত এবং মরলে জান্নাত নিশ্চিত বলত অথচ দীর্ঘজীবন ছিল ওদের আখাংক্ষা।

আল্লাহ বলেন-

বলে দিন, যদি আখেরাতের বাসস্থান আল্লাহর কাছে একমাত্র তোমাদের জন্যই বরাদ্দ হয়ে থাকে-অন্য লোকদের বাদ দিয়ে, তবে মৃত্যু কামনা কর, যদি সত্যবাদী হয়ে থাক।
কস্মিনকালেও তারা মৃত্যু কামনা করবে না ঐসব গোনাহর কারণে, যা তাদের হাত পাঠিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ গোনাহগারদের সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছে।
আপনি তাদেরকে জীবনের প্রতি সবার চাইতে, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও অধিক লোভী দেখবেন। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ দেখেন যা কিছু তারা করে। (সুরা বাকারহ-৯৪-৯৬)

আজও বহু দল, বহু মতের অনুসারীরা আছে যারা বলে তাদের পথে চললে জান্নাত। এমনকি মুরীদকে জান্নাতের সুপারিশের স্বপ্ন দেখায় অথচ দীর্ঘ হায়াতের দোয়া করে, শহীদী মৃত্যু কামনা করে না।

অথচ রসুলুল্লাহ (সা:) এর সাহাবীরা শহীদী মৃত্যু কামনা করতেন। এমনকি চার প্রধান সাহাবীর মধ্যে তিনজনই শহীদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *