রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ ‘এমন কিছু রয়েছে যেটির ব্যাপারে আমি আমার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের অপেক্ষাও অধিক ভয় করি।’
তখন আমি ভীত হয়ে পড়লাম, তাই আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ্র রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এটি কোন জিনিস, যার ব্যাপারে আপনি আপনার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের চাইতেও অধিক ভয় করেন?’ তিনি [রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বললেন, ‘পথভ্রষ্ট ’আলিম গণ।’” (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং. ২০৩৩৫)।
দাজ্জাল মহাবিশ্বের বড় ফেতনা অথচ রসুলুল্লাহ (সাঃ) পথভ্রষ্ট আলেমদের ফেতনাকে এর চেয়ে বেশি ভয় পেতেন?! এর কারণ হল- দাজ্জাল পুরো মানবজাতির জন্য বড় ফেতনা আর দাজ্জালের ফেতনাকালও অল্প সময়কাল থাকবে।
কিন্তু পথভ্রষ্ট আলেমদের ফেতনা দীর্ঘদিন চলতে থাকবে আর মুমিনদের জন্য তারাই বড় ফেতনা। যারা পূর্ব হতে পথভ্রষ্ট আলেমদের অনুসরণ করবে দাজ্জাল আসলে তার ফেতনায় তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আসুন – পথভ্রষ্ট আলেম কিরূপ হতে পারে হাদীসের আলোকে জানি।
রাসূল (ﷺ) আরও বলেছেনঃ ‘তোমরা জেনে রাখ সব খারাপের মাঝে সবচেয়ে বড় খারাপ হচ্ছে আলেমদের মাঝে যারা খারাপ তারা আর সব ভালোর মাঝে সবচেয়ে ভাল হলো আলেমদের মাঝে যারা ভালো তারা।” (দারেমী হা/৩৭০; মিশকাত হা/২৪৯)।
অর্থাৎ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম মুমিন হল হক্বপন্হী আলেমগণ আর নিকৃষ্ট হল পথভ্রষ্ট আলেমগন।
এছাড়াও রয়েছে –
যে রাজা-বাদশার নিকট আসা-যাওয়া করে সে ফিতনায় নিপতিত হয়।’ (সুনানে আবু দাউদ ২৮৫৯, মান: সহিহ)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন,
আমার উম্মাতের কতক লোক ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করবে, তারা কুরআন পড়বে এবং বলবে, আমরা শাসকদের নিকট যাবো তাদের নিকট থেকে পার্থিব স্বার্থ প্রাপ্ত হবো এবং আমাদের দ্বীন থেকে তাদের সরিয়ে রাখবো। এরূপ কখনো হতে পারে না। যেমন কাঁটাদার গাছ থেকে ফল আহরণের সময় হাতে কাঁটা ফুটবেই, তদ্রূপ তারা তাদের কাছে গিয়ে গুনাহ থেকে বাঁচতে পারে না। মুহাম্মাদ ইবনুস সাব্বাহ (রহঃ) বলেন, অর্থাৎ গুনাহ ব্যতীত তারা কিছুই লাভ করতে পারে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২৫৫, মিশকাত ২৬২, মিশকাত হা/২৪৫, মিশকাতুল মাসাবিহ ৬৩)
কেয়ামতের পূর্বমুহুর্তে ক্বারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে কিন্তু কুরআনের জ্ঞান ও ঈমান কমে যাবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন- “অচিরেই এমন এক জমানা আসবে, যখন কোরআনের পাঠক বেড়ে যাবে, দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞানসম্পন্ন লোক কমে যাবে, ওহীর জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে এবং সংঘাত বেড়ে যাবে। সংঘাত কি? জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- “পারস্পরিক হত্যাযজ্ঞ-“। অতঃপর এমন এক জমানা আসবে, যখন কোরআন পাঠ করা হবে, কিন্তু কোরআনের আয়াত তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করবে না (কোরআনের বিধান বাস্তবায়িত হবে না)। অতঃপর এমন এক জমানা আসবে, যখন কাফের, মুনাফেক, মুশরেক ব্যক্তি ইসলাম নিয়ে মুমিনের সাথে তর্কযুদ্ধ করবে।” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
আজ দেখুন – বহু অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াতের প্রতিযোগিতা হচ্ছে অথচ মানুষ কুরআনের অর্থ বুঝছে না!? যে সংসদে কুরআন পাঠ করে সূচনা করা হচ্ছে – সেখানে কুরআন বিরোধী আইন ও কথাবার্তা চলছে।
আর একদল লোক (প্রশাসন) কুরআন ধরেই শপথ করছে কুরআন বিরোধী আইনের সুরক্ষা ও অটল রাখার।
বহু সাংস্কৃতিক, বিদায় অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়েত হচ্ছে আবার গানবাজনা হচ্ছে। অথচ কুরআন গান-বাজনা হারাম ঘোষণা করেছে। চলচ্চিত্রের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লেখা হচ্ছে – অনেক তারকারা চলচ্চিত্রে সফলতার জন্য দোয়া চাইছেন!! অনেক পোস্টারে লেখা আল্লাহ সর্বশক্তিমান অথচ পোস্টারে পাশেই বেপর্দা নারীর ছবি বিদ্যমান ও রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শ বাদ দিয়ে অন্য কারো আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচার করা হচ্ছে। অনেকে কুরআনের আয়াত ও ইসলামী জিকিরকে গান হিসেবে ব্যবহার করছে।
হযরত আবেস আল গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের উপর ছয়টি বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন। সেগুলো হলো, শিশু তথা বোকা ও অযোগ্য ব্যক্তিদের নেতা হওয়া। জালেম পুলিশের আধিক্য। আদালতে ঘুষ লেনদেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরণ। রক্ত মূল্যহীন হওয়া অর্থাৎ মানুষের জানের মূল্য না থাকা। এমন এক প্রজন্ম তৈরী হওয়া, যারা কুরআনে কারীমকে গানের বাঁশি বানিয়ে ফেলবে, অর্থাৎ গানের সুরে কুরআন তিলাওয়াত করবে। লোকেরা এমন ব্যক্তিকে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য সামনে এগিয়ে দিবে, যে তাদের মাঝে জ্ঞান বুদ্ধিতেও বেশি হবে না, কুরআন ও হাদীসের ইলমেও পরিপক্ক হবে না এবং না সে তাদের মাঝে উত্তম হবে। সে তাদেরকে গানের সুরে কুরআন শুনাবে। [আলমু’জামুল আওসাত লিততাবারানী, হাদীস নং-৬৮৫, আলমু’জামুল কাবীর লিততাবারানী, হাদীস নং-৬২]
অনেক হক্বপন্হী আলেমরা যেসব নিয়মনীতি শিরক, কুফর বলছে অথচ পথভ্রষ্ট আলেমদের প্রশ্ন করা হলে – দুনিয়ার লোভে ও ভয়ে সত্যকে আড়াল করে ঘুরিয়ে উত্তর দেন। তাহলে মনে রাখুন- জান্নাতের নেয়ামত হতে নিজেদের বঞ্চিত করছেন আর নিজেদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি সঞ্চিত করছেন।
যে ব্যক্তিকে এমন কোন জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যা সে জানে, অথচ গোপন রাখে (বলে না), ক্বিয়ামাতের (কিয়ামতের) দিন তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেয়া হবে। (আহমাদ, আবূ দাঊদ ও তিরমিযী, আহমাদ ৭৮৮৩, আবূ দাঊদ ৩৬৫৮, তিরমিযী ২৬৪৯, সহীহুল জামি‘ ৬২৮৪, মিশকাতুল মাসাবিহ ২২৩, মান: সহিহ)।
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
তোমরা ‘জুব্বুল হুযুন’ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। সহাবীগন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল! ‘জুব্বুল হুযুন’ কি?
তিনি (ﷺ) বললেন, এটা হল জাহান্নামের মধ্যে একটি গর্ত। এ গর্ত হতে বাচার জন্য জাহান্নামও দৈনিক চারশ বার আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়। সহাবীগণ জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসুল! এতে (এ গর্তে) কারা যাবে? তিনি (ﷺ) বললেন, যারা দেখানোর উদ্দেশ্যে ‘আমাল ও কুরআন অধ্যয়ন করে থাকে। কুরআন অধ্যায়নকারী (‘আলিম)-গনের মধ্যে তারাই আল্লহর নিকট সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত, যারা আমীর-ওমরাহদের (সম-সাময়িক শাসকগোষ্ঠীর) সাথে বেশী বেশী সাক্ষাত বা মেলামেশা করে।” (তিরমিযী ২৩৮৩, ইবনু মাজাহ্ ২৫৬, য‘ঈফুত্ তারগীব ১৬, মিশকাতুল মাসাবিহ ২৭৫)।