কিছুলোক আকীদা, শরীয়া জ্ঞান বাদ দিয়ে কেয়ামতের আলামত নিয়ে ব্যস্ত। আবার কারো নিকট কেয়ামতের আলোচনা করলে তারা বলবে – এগুলো ঘটতে আরও বহুবছর বাকী!! আবার কেউ জনপ্রিয়তার জন্য সত্য-মিথ্যা মিশ্রণে আলামত নিয়ে ওয়াজ করে।
আসলে কেয়ামতের আলামত নিয়ে যুগ যুগ ধরে সাহাবী, তাবেয়ী, আলেমরা আলোচনা করেছেন। তবে তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন আকীদা (তাওহীদ), কুফর, শিরক, আল ওয়ালা ওয়াল বারা ইত্যাদি। বহু হাদীসগ্রন্থ ও আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ায় রসুলের (সাঃ) ভবিষ্যবাণী বর্ণনা করা হয়েছে। কেয়ামতের আলামত আলোচনা কেন গুরুত্বপূর্ণ – ইসলাম পুরো মানবজাতির জন্য এসেছে।
রসুল (সাঃ) আসার পূর্বে তাওরাত, ইনজিলে ভবিষ্যবাণী ছিল। ইহুদীরা তা প্রচার করত যদিও তারা রসুলকে (সাঃ) চেনার পর অল্পকিছু ইহুদী ছাড়া অধিকাংশ ঈমান আনেনি। কিন্তু মদীনার মুশরিকরা অনেকে সত্যনবীর আগমনে ঈমান এনেছেন তাদের ভবিষ্যৎবানীর সাথে মিল দেখে। তেমনি কেয়মতের আলামতগুলো- রসুল (সাঃ) সত্য হওয়ার প্রমাণ যা মুশরিকদের জন্য দাওয়াত স্বরূপ। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওহীর জ্ঞান ছাড়া এতটা নিখুত সত্য ভবিষ্যত বক্তব্য সম্ভব নয়। তাই যে যার মত কেয়ামতের আলামতের ব্যাখা করা হতে বিরত থাকা উচিত। আর কেয়ামতের আলামত পড়লে, শুনলে, জানলে, বর্তমান পরিস্থিতির সাথে মিলালে – মুমিনের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় যে আল্লাহ সবকিছু জানেন, পর্যবেক্ষণ করেন।
শয়তান, দাজ্জাল, ইসলামের শত্রুদের মেকাবেলার প্রতিটি কৌশল মুমিনকে জানিয়ে দিয়েছেন মহান রব্বুল আলামীন। যে আমাদের রব ইসলামের শত্রুদের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ধ্বংস করবেন ইনশাআল্লাহ আর আমাদের এক আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত। তার নির্দেশনা মোতাবেক চলা উচিত।
আল্লাহ বলেন-
নিশ্চয় কোরআন সত্য-মিথ্যার ফয়সালা এবং এটা উপহাস নয়। তারা ভীষণ চক্রান্ত করে, আর আমিও কৌশল করি। অতএব, কাফেরদেরকে অবকাশ দিন, তাদেরকে অবকাশ দিন, কিছু দিনের জন্যে।
সুরা আত-তারিক
কেয়ামতের কয়টি আলামত
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেন- “অচিরেই এমন এক জমানা আসবে, যখন কোরআনের পাঠক বেড়ে যাবে, দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞানসম্পন্ন লোক কমে যাবে, ওহীর জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে এবং সংঘাত বেড়ে যাবে। সংঘাত কি? জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- “পারস্পরিক হত্যাযজ্ঞ-”। অতঃপর এমন এক জমানা আসবে, যখন কোরআন পাঠ করা হবে, কিন্তু কোরআনের আয়াত তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করবে না (কোরআনের বিধান বাস্তবায়িত হবে না)। অতঃপর এমন এক জমানা আসবে, যখন কাফের, মুনাফেক, মুশরেক ব্যক্তি ইসলাম নিয়ে মুমিনের সাথে তর্কযুদ্ধ করবে।” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেন- “কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে জ্ঞানকে আল্লাহ আকস্মিক উঠিয়ে নেবেন না; বরং উলামাদেরকে উঠিয়ে নেবেন। অবশেষে যখন বিজ্ঞ আলেম বলে কেউ থাকবে না, তখন মানুষ মূর্খদের শরণাপন্ন হয়ে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবে। আলেম নামধারী মূর্খরা ভুল ফতোয়া দিয়ে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদের ও পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে।” (বুখারী-মুসলিম)
বর্তমানে কি তা ঘটছে না – মিলিয়ে দেখুন!? বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান, টকশোতে কারা ইসলাম নিয়ে বিতর্ক করছে আলেমদের সাথে??
জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, একদা কাব বিন উজরা (রা)-কে উদ্দেশ্য করে নবী করীম (সা) বলতে লাগলেন- “নির্বোধ ব্যক্তিদের নেতৃত্ব থেকে আল্লাহ পাক তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুন!” নির্বোধের নেতৃত্ব কি? -জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন “আমার পর এমন সব নেতা-নেত্রীদের আগমন হবে, যারা আমার আদর্শকে অবহেলা করবে। প্রচুর মিথ্যা কথা বলবে। সুতরাং যারাই মিথ্যুকদেরকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে, অপরাধ-দুর্নীতিতে তাদেরকে সহায়তা করবে, অবশ্যই তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। আমি তাদের থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। হাউজে কাউসারে তারা আমার ধারে-কাছেও আসতে পারবে না। পক্ষান্তরে যারা মিথ্যুকদেরকে সত্যায়ন করেনি, অপরাধ দুর্নীতিতে সহায়তা করেনি, তারাই আমার উম্মত। আমি তাদের পক্ষে থাকব। হাউজে কাউসারে তারা আমার কাছে আসবে। ওহে কাব বিন উজরা..! (জেনে রেখো!) রোযা হচ্ছে ঢাল, সাদাকা পাপকে ধুয়ে দেয় এবং নামায হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায়। ওহে কাব বিন উজরা..! (জেনে রেখো!) অবৈধ উপার্জনে ক্রিত খাদ্যে যে মাংস শরীরে বেড়ে উঠল, তা কখনো-ই জান্নাতে প্রবেশ করবে না; বরং জাহান্নামের আগুনই তার জন্য অধিক মানানসই। ওহে কাব ! মানুষ প্রতিদিন (কর্ম শেষে) প্রত্যাগমন করে, কেউ নিজেকে বিক্রি করে দিয়ে আসে, কেউ (নিজেকে জাহান্নাম থেকে) মুক্ত করে আসে।” (মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে বাযযার)
এখানে মুনাফিক বলতে যাদের অন্তরে খোদা-ভীতি বলতে কিছু নেই, দুর্বল ঈমান, প্রচণ্ড মিথ্যাবাদী এবং গণ্ডমূর্খ লোক উদ্দেশ্য।
এ রকম নির্বোধ গণ্ডমূর্খরা নেতৃত্বে আসার ফলে সমাজের আমূল বিবর্তন ঘটবে। মিথ্যুককে সত্যবাদী বলা হবে, সত্যবাদীকে মিথ্যুক বলে অবহেলা করা হবে। ঘাতককে বিশ্বস্ত আর বিশ্বস্তকে ঘাতক মনে করা হবে। জ্ঞানীদের মুখ বন্ধ করে মূর্খরা সমাজ নিয়ে কথা বলবে।
ইমাম শাবী রহ. বলেন- “কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে প্রকৃত জ্ঞান হয়ে যাবে মূর্খতা, আর মূর্খতা হয়ে যাবে প্রকৃত জ্ঞান। এভাবেই দৃশ্যপট পাল্টে যাবে।”
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেন- “কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, উৎকৃষ্টদের অবহেলা করা হবে এবং নিকৃষ্টদের মর্যাদা দেয়া হবে।” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
বর্তমানে একজন হক্বপন্থী আলেমদের তুলনায় বিভিন্ন চলচ্চিত্র তারকা, খেলোয়াড় অনেক বেশি জনপ্রিয় ও সম্মানিত।
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেন “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না মানুষ সু-বিশাল বাড়ী নির্মাণ করবে। ডোরাকাটা মহামূল্যবান চাদর দিয়ে দেয়ালকে সুসজ্জিত করবে।” (বুখারী)
অর্থাৎ চাদর যেমন সুন্দর ডিজাইনে বুনা হয়, দেয়ালও সে রকম কারুকার্যে বানানো হবে।
ঘরকে সুদর্শন করতে চাদর ঝুলানো হারাম কিছু নয়; কিন্তু এক্ষেত্রে সীমাতিরিক্ত অপচয়, অহংকার এবং প্রতিযোগিতায় মত্ত হওয়া হারাম।
বজ্রাঘাতে নিহতের হার বেড়ে যাওয়া কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন। আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেন “কেয়ামত ঘনিয়ে আসার পাশাপাশি বজ্রপাতের ঘটনাও বেড়ে যাবে। এমনকি মানুষ পাশের এলাকায় গিয়ে বলতে থাকবে- “গতরাতে তোমাদের এদিকে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পেলাম। উত্তরে তারা বলবে- অমুক, অমুক এবং অমুক বজ্রপাতে মারা গেছে।” (মুসনাদে আহমদ)।