আমলই ঈমানের পরিচয়

আল্লাহ বলেন-

হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদের বন্ধু এবং অভিভাবক রূপে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু এবং অভিভাবক। এবং তোমাদের মধ্যে যে কেহ তাদের [বন্ধু এবং অভিবাবকরূপে] গ্রহণ করবে, সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না। (কোরআন ৫:৫১)

কোরআনের বাংলা অনুবাদে অনুবাদকগণ ‘বন্ধু’ ও ‘অভিভাবক’ শব্দ দুটি ব্যবহার করলেও কিন্তু আল্লাহ পাক আউলিয়া ব্যবহার করেছেন। আউলিয়া মানে অভিভাবক, তত্ত্বাবধায়ক, নিরাপত্তাদানকারী। অর্থাৎ মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে গিয়ে ওদের ধর্মীয় রীতিনীতি, উৎসব অনুসরন করা যাবে না। আর মুসলিমদের বিপরীতে ওদের অভিভাবক মানা যাবে না।

যারা মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুশরিকদের সাহায্য ও সহযোগিতা করবে তারা তাদের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে গন্য হবে। আবার অনেকে ওদের টেকনোলজি বা অস্ত্র ব্যবহারকে হারাম ফাতওয়ার আয়াতের ভুল ব্যাখা করে। অথচ রসুল (সা) পারস্যের নীতিতে পরিখা খনন করেছেন, সাহাবীরা (রা) গনিমত হিসেবে ওদের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, রসুল (সা) যুদ্ধরত শত্রু নয় এমন ইহুদি হতে ঢাল ধার নিয়েছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

যেমন – অপর আয়াতে বর্নিত হয়েছে –

‘ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন।’ (৬০:৮)

আসলে প্রকৃতপক্ষে ঈমানের স্বীকৃতি আমলে। শুধু মুখে বলা আর কর্ম বিপরীত হলে তা গ্রহনযোগ্য নয়।

সুরা আনফালে বর্নিত –

হে নবী, তাদেরকে বলে দাও, যারা তোমার হাতে বন্দী হয়ে আছে যে, আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে কোন রকম মঙ্গলচিন্তা রয়েছে বলে জানেন, তবে তোমাদেরকে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী দান করবেন যা তোমাদের কাছ থেকে বিনিময়ে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া তোমাদেরকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন। বস্তুতঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।
(আয়াত -৭০)

অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন যে, এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতৃব্য আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। কারণ, তিনিও বদরের যুদ্ধবন্দীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

তার কাছ থেকেও মুক্তিপণ নেয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে তার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, মক্কা থেকে তিনি যখন বদর যুদ্ধে যাত্রা করেন, তখন কাফের সৈন্যদের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশ্যে বিশ ওকিয়া (স্বর্ণমূদ্রা) সাথে নিয়ে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো ব্যয় করার পূর্বেই তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। যখন মুক্তিপণ দেয়ার সময় আসে, তখন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আমি তো মুসলিম ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনার ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহই ভাল জানেন।

যদি আপনার কথা সত্য হয় তবে আল্লাহ আপনাকে এর প্রতিফল দিবেন। আমরা তো শুধু প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের (আমল) উপর হুকুম দেব। সুতরাং আপনি আপনার নিজের এবং দুই ভাতিজা আকীল ইবন আবী তালেব ও নওফেল ইবন হারেসের মুক্তিপণও পরিশোধ করবেন। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আবেদন করলেন, আমার এত টাকা কোত্থেকে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কেন, আপনার নিকট কি সে সম্পদগুলো নেই, যা আপনি মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময়ে আপনার স্ত্রী উম্মুল ফযলের নিকট রেখে এসেছেন? আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ আপনি সে কথা কেমন করে জানলেন? আমি যে রাত্রের অন্ধকারে একান্ত গোপনে সেগুলো আমার স্ত্রীর নিকট অর্পণ করেছিলাম এবং এ ব্যাপারে তৃতীয় কোন লোকই অবগত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সে ব্যাপারে আমার রব আমাকে বিস্তারিত অবহিত করেছেন।

তখন আব্বাস বললেন, আমার কাছে যে স্বর্ণ ছিল, সেগুলোকেই আমার মুক্তিপণ হিসেবে গণ্য করা হোক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যে সম্পদ আপনি কুফরীর সাহায্যের উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছিলেন, তা তো মুসলিমদের গনীমতের মালে পরিণত হয়ে গেছে, ফিদইয়া বা মুক্তিপণ হতে হবে সেগুলো বাদে। তারপর আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নিজের ও দুই ভাতিজার ফিদইয়া দিলেন। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [সীরাতে ইবন হিশাম; ইবন কাসীর]

আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম প্রকাশের পর প্রায়ই বলে থাকতেন, আমি তো সে ওয়াদার বিকাশ-বাস্তবতা স্বচক্ষেই প্রত্যক্ষ করছি। কারণ আমার নিকট থেকে মুক্তিপণ বাবদ বিশ উকিয়া সোনা নেয়া হয়েছিল। অথচ এখন আমার বিশটি গোলাম (ক্রীতদাস) বিভিন্ন স্থানে আমার ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে এবং তাদের কারো ব্যবসায়ই বিশ হাজার দিরহামের কম নয়। [দেখুন, মুস্তাদরাকে হাকিম: ৩/৩২৪ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩ য় খন্ড -৫২০ পৃ]

অনুরুপ -উসামা ইবনে যায়দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জুহাইনা গোত্রের এক শাখা হুরাকার দিকে পাঠালেন। অতঃপর আমরা সকাল সকাল পানির ঝর্নার নিকট তাদের ওপর আক্রমণ করলাম। (যুদ্ধ চলাকালীন) আমি ও একজন আনসারী তাদের এক ব্যক্তির পিছনে ধাওয়া করলাম।

যখন আমরা তাকে ঘিরে ফেললাম, তখন সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলল। আনসারী থেমে গেলেন, কিন্তু আমি তাকে আমার বল্লম দিয়ে গেঁথে দিলাম। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করে ফেললাম। অতঃপর যখন আমরা মদীনা পৌঁছলাম, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এ খবর পৌঁছল। তিনি বললেন, ‘‘হে উসামা! তার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরেও কি তুমি তাকে হত্যা করেছ?’’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! সে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এরূপ করেছে।’ পুনরায় তিনি বললেন, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরও তুমি তাকে খুন করেছ?’’ তিনি আমার সামনে এ কথা বারবার বলতে থাকলেন।

এমনকি আমি আকাঙ্ক্ষা করলাম যে, যদি আজকের পূর্বে আমি ইসলাম গ্রহণ না করতাম (অর্থাৎ এখন আমি মুসলিম হতাম)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘সে কি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তুমি তাকে হত্যা করেছ?’’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! সে কেবলমাত্র অস্ত্রের ভয়ে এই (কলেমা) বলেছে।’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছিলে যে, সে এ (কলেমা) অন্তর থেকে বলেছিল কি না?’’ অতঃপর একথা পুনঃ পুনঃ বলতে থাকলেন। এমনকি আমি আকাঙ্ক্ষা করলাম যে, যদি আমি আজ মুসলিম হতাম। (মুসলিম, রিয়াযুস সলেহীন ৩৯৮)

অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে বাহ্যিক আমল দ্বারা বিবেচনা করা হবে- তার অন্তরের ব্যাপারে আল্লাহ বিবেচনা করবেন।
কোন ব্যক্তি যদি কুফর, শিরকে লিপ্ত থাকে তাকে তাই ভাবতে হবে। আবার কোন ব্যক্তি যদি তওবা করে ফিরে আসে যেকোন পরিস্থিতি হোক না কেন বা বাহ্যিকভাবে যে ইসলাম পালন করে যতক্ষণ না তার নেফাক সুস্পষ্ট হয় তাকে মুসিলম ভাবতে হবে। তাই যারা মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে গিয়ে মুশরিক, জালেমের পক্ষ নিয়ে মুসলিমদের উপর জুলুম, নির্যাতন চালায় তারা মুশরিকদের সাহায্যকারী নয় কি!? দ্বীনের দাওয়াত ও শিরক কুফরের বিরোধিতা করায় ইসলামে ফিরে না এসে উল্টো মুসলিমদের উপর জুলুম, নির্যাতন করে সেই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গন্য হবে।

আর ইসলামের কোন আমলকে অস্বীকার বা অপছন্দ করলে কাফের হয়ে যায়। যেমন -আমরা জীবনে বহু আমল করি না (সালাত ব্যতীত) কিন্তু এসব আমলকে স্বীকার করি। তার জন্য ওলামারা কাফের ফাতওয়া দেন না। অথচ ইবলিশ এজন্যই কাফের কারন সেই আমল করতে অস্বীকার ও অপছন্দ করে উল্টো যুক্তি দেখিয়েছিল। তারপরও ইবলিশ আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছিল, তবুও তাকে ইসলাম ও মুসলিমেদের শত্রু ভাবা হয়।

কুরআনে বর্নিত –

“সে (ইবলিশ) বলল, ‘হে আমার রব, আমাকে সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন যেদিন তারা পুনরুত্থিত হবে।’ তিনি বললেন, আচ্ছা তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে- নির্ধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।’
সে বলল, ‘আপনার ইজ্জতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করে ছাড়ব।’ তাদের মধ্য থেকে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া।”[ সূরা সা’দ : ৭৯ – ৮৩ ]

তাই শরীয়তের ভুল ব্যাখা ও চমকপদ বক্তব্য দিয়ে, যারা মুশিরক ও ইসলামের শত্রুদের পক্ষ নিয়ে মুসলিমদের হত্যা করে তারা মুসলিমদের বন্ধু না কাফেরের সাহায্যকারী। আল্লাহ শুধু ফেরাউন, নমরুদকে একা ধ্বংস করেননি তার সাহায্যকারী প্রশাসন, সেনাবাহিনীকেও ধ্বংস করেছেন। তওবা না করে ফিরে না আসলে রোজ কেয়ামতের দিন মুমিন ও কাফের, মুনাফেক, ইসলামের শত্রুরা আলাদা হয়ে যাবে! একদল জান্নাতী, অন্যদল জাহান্নামী। বহু আলেম, চেতনাবাদী দেখছি যখন কোন মুশরিক, ইসলামের শত্রুদের উপর আঘাত আসে তারা কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখা করে অথচ মুমিনের ক্ষেত্রে নিরব কেন!?

আল্লাহ বলেন-

এ কারণেই আমি বানী ইসরাঈলের জন্য বিধান দিয়েছিলাম যে, যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা যমীনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে সে যেন তামাম মানুষকেই হত্যা করল। আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচালো, সে যেন তামাম মানুষকে বাঁচালো। তাদের কাছে আমার রসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছিল, এরপরও তাদের অধিকাংশই পৃথিবীতে বাড়াবাড়িই করেছিল। (সুরা মায়েদাহ -৩২)

অথচ মুসলিম হত্যার ব্যাপারে কুরআন, হাদিসে ভীতি দেখানো হয়েছে তা প্রকাশ করে না।

কুরআনে বর্ণিত,

‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৯৩)

অনেকে বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে জনপ্রিয় হয় অথচ নিজ দেশে মুসলিম নির্যাতনে নিরব ভয়ে ও স্বার্থে।
ভাবুন তারা আসলে ইসলাম ও মুসলিম প্রেমী নাকি অর্থ, জনপ্রিয়তা তাদের মূল উদ্দেশ্য!?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *