৯০৯ সালে প্রথমবারের মতো ইসমাইলিয়া শিয়ারা মিশরে রাজত্ব কায়েম করে। ইসমাইলিয়া শিয়াদেরই আরেকটি শাখা প্রাধান্য লাভ করে ইরান ও সিরিয়ায়। ধর্মীয় নিষ্ঠুরতা ও দর্শনের ভিন্নতার কারণে সুন্নী শিয়া নির্বিশেষে তাদের ‘মালাহিদা’ বা বিধর্মী বলে আখ্যা দেয়। ঐতিহাসিক ইবনে আসির তাদের ‘দাওয়াতুল আখিরা’ বা পরবর্তী আন্দোলন এবং শাহরিস্তানি তাদের ‘দাওয়াতুল জাদীদা’ বা নব্য আন্দোলন বলে উল্লেখ করেছেন। কালক্রমে তারা হাসাসিন নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করে। আরবি এই হাসাসিন থেকেই ইউরোপে Assassins নামের আমদানি ঘটে। এই হাসাসিনদের জনক হল হাসান বিন সাব্বাহ। প্রথম জীবনে ইসনা আশারিয়া শিয়া মতবাদের সমর্থক হলেও মুমিন নামক এক ফাতেমীয় প্রচারকের মাধ্যমে ইসমাইলীয়া বা বাতেনী মত গ্রহণ করেন। ১০৭৮ সালে প্রচারক ইবনে আততাশের প্রতিনিধি হিসেবে মিশরের রাজধানী কায়রো যান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মুসতালী এবং সেনাপতি বদরের ষড়যন্ত্রের জন্য অচিরেই ত্যাগ করতে হয় কায়রো। ১০৮১ সালে ইস্পাহানে ফিরে খলিফা মুসতানসিরের জ্যেষ্ঠপুত্র নিযারের পক্ষে প্রচারণা চালান।
১০৮৪ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা মুসতানসিরের মৃত্যু হলে সেনাপতি বদরের পুত্র আফজাল খলিফার নাবালক পুত্র আবুল কাসেমকে সিংহাসনে বসিয়ে ক্ষমতা হস্তগত করেন। যদিও খলিফা মনোনীত করে গিয়েছিলেন বড় ছেলে নিযারকে। এই ঘটনায় হাসান বিন সাব্বাহ কায়রোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং পারস্যে নিযারের নামে প্রচারণা চালান। গোষ্ঠীটি নিযারিয়া নামে পরিচিতি পায়। আলামুত দুর্গকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ইতিহাস বিখ্যাত ‘গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়’ বা হাসাসিনদের উৎস ছিল এই নিযারিয়া মতবাদ। ইরানে বাতেনী প্রচারণা নতুন রূপ লাভ করে বলে এটি ‘দাওয়াতে জাদীদ’ হিসাবে পরিচিতি পায়। হাসাসিনদের প্রচারণা কাঠামো ছিল খুব সংগঠিত এবং পরিকল্পিত। মর্যাদা ও দায়িত্বের দিক থেকে গোটা প্রচারক দলকে ছয়টি পৃথক শ্রেণিতে বিভক্ত করা হতো। প্রধান প্রচারক বা দায়ী আদ দোআ’য়াত তাদের সদর দপ্তর আলামুত পার্বত্য দূর্গে অবস্থান করতেন।
হাসাসীনদের মধ্যে ভয়ংকর ছিল গুপ্তঘাতক ফিদায়ীরা। প্রকৃতপক্ষে ফিদায়ীরাই ছিল গুপ্তঘাতকতার প্রধান বাহক বা প্রকৃত হাসাসিন। সাধারণত ফিদায়ী দলের জন্য পার্বত্য যুবকদের সংগ্রহ করে তাদের কষ্টসহিষ্ণু করে গড়ে তোলা হতো। শেখানো হতো অস্ত্রচালনা, ছদ্মবেশ ধারণ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাষা। দেওয়া হতো ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সংস্কৃতি নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান। ফলে অনায়াসে গির্জা কিংবা মসজিদে ঢুকে নির্ধারিত ব্যক্তির বুকে ছুরি বসিয়ে আসতে পারতো তারা। ফিদায়ীদের অনুগত রাখার জন্য আলামুত দূর্গকে সাজানো হতো। প্রাথমিক অবস্থায় হাসান ইবনে সাব্বাহের সহচররা বিভিন্ন কাফেলা লুট করত। যতটা সম্পদ লুট করত, তারচেয়ে বেশি নারী শিশুকে বন্দী করত তারা। ওদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো এবং যুবক ও এমনকি রাজবংশের অনেকের বিরুদ্ধে প্রেম-প্রতারণা ফাঁদে ফেলে তথ্য, হত্যাসহ বিভিন্ন কার্যসম্পাদন করতো। তাদের অন্যতম প্রধান শায়খুল জাবাল যাদের গুপ্তঘাতক দলে আনার মনস্থ করতেন, তারা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারতো না। বারো থেকে বিশ বছর বয়সী যুবকদেরকে শায়খ তার দরবারে স্থান দিতেন। তাদের হাশিম লতার আরক পান করিয়ে চার পাঁচজন করে করে তন্দ্রাচ্ছন্ন করা হতো। তন্দ্রা ভাঙলে তারা দেখতে পারতো অপরূপ স্বর্গে বসে আছে যেখানে হুরেরা ঘুরছে। আসলে নেশার প্রকোপ আর লুটপাট করা মেয়েদের অপরূপভাবে সাজিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। শায়খ যখন কোনো যুবককে কোনো মিশনে প্রেরণ করতেন, তার আগে আবার আরক পান করানো হতো। তারপর জ্ঞান ফিরলে শায়খের সামনে আনা হতো। বলা হতো সে যদি অমুক শাহজাদাকে হত্যা করে আসতে পারে, তবে তাকে সেই স্বর্গে পাঠানো হবে। এই ফিদায়ী এমন ছিলো ধরা পড়ার আগেই আত্মহত্যা করতো বা যেকোন সময় শায়েখের কথামত মরতে রাজি থাকতো। রাজদরবার, মসজিদ, গির্জা, বাজার এমন কোন স্হান ছিলো না ওরা ছদ্মবেশে থাকতো ও কাজ করত না৷ ১০৯০-৯১ সালে হাসাসিনরা আলামুত দূর্গ অধিকার করে। ক্রমে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ইয়াজিদ, কিরমান, তাবারিস্তান, দামগান, কাযবীন প্রভৃতি অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে। একে একে দখল করে শাহদীজ, কালান্ জান, কুসাফ, ওয়াসম কুহ, উস তানাওয়ান্দ, আরদাহান, গীরদ্ই-ই-কুহ, কিলায়াতুন নাদীর, কিলায়াতুন তানবির, কিলায়াতুন খাল্লাত খান প্রভৃতি দূর্গ। সেলজুক আমির, পশ্চিম এশিয়ার রাজন্যবর্গ এবং তাদের সেনাপতি এমনকি ক্রুসেডাররাও তাদের ভয়ে তটস্থ থাকতো। এভাবে গুপ্তহত্যা ও ত্রাস সঞ্চার করে তারা সমগ্র পশ্চিম এশিয়ার ভূখণ্ডে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিল। ১১২৪ সালে হাসান ইবনে সাব্বাহ মারা যান। এরপর তার পরবর্তী কিছু বংশধর হেদায়েতপ্রাপ্ত হন তখন হাসাসিনরাই তাদের হত্যা করে। হালাকু খানের আক্রমণে ওদের পরাজয় হয় ও শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। ওরা বহুভাগে বিভক্ত হয় এবং ভারত, পাকিস্তান, ইরান, সিরিয়া, লেবাননে তাদের সদস্য বিদ্যমান। আগা খান তাদেরই বংশধর ছিলো। মূলত হাসান ইবনে সাব্বাহ ছিল শয়তানপূজারী। সে তাৎকালীন বিভিন্ন টেকনোলজি ব্যবহার করে মানুষকে চমকে দিত আর জ্বিন শয়তান দ্বারা অনেক কারসাজি ও তথ্য নিয়ে মানুষকে ধোকায় ফেলে ভক্ত বানাত। যেমন – কারিন জিন দ্বারা একটা মানুষের স্বভাব সম্পর্কে ধারণা দিয়ে চমকে দিত। এই বিষয়ে দাজ্জাল, জিন, কারিন পোস্টটা দেখতে পারেন। আর সে শয়তানের মত মানবচরিত্রের লোভ ও দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ফাঁদে ফেলতো। সম্পদ, নারী লোভ, নেশা দিয়ে সহজে অচেতন করে নিজের কার্য উদ্ধার করতো। সে বুঝতে পেরেছিল মানুষের চরিত্রে সামান্য লোভ, দুনিয়াপ্রীতি থাকলে এটাকে কাজে লাগিয়ে সহজে তার ক্ষতি করা যায়। মস্তিষ্কে যখন তীব্র আকাঙ্ক্ষা, নেশা, চাহিদা জাগে তখন মানুষ স্বাভাবিক চিন্তাবোধ হারিয়ে ফেলে সহজ ব্যাপারগুলো তার চিন্তায় আসে না। শয়তান মানুষকে দুনিয়ায় দীর্ঘস্হায়ী সুখ-স্বপ্ন, রূপ, রসের ফাঁদে ফেলে ভুলিয়ে দেয় জীবন ক্ষনস্থায়ী। সুখ, সম্পদ, বিলীসিতা সাময়িক উপভোগের বিষয়বস্তু মাত্র। চিন্তা করুন ইবনে সাব্বাহের তথাকথিত জান্নাতের জন্য বহুলোক জীবন দিতে রাজি ছিল আর দাজ্জাল যখন তারচেয়ে বহুগুণ সুন্দর প্রতারণার জান্নাত দেখাবে তখন আসক্তি, লোভের বশীভূত হয়ে কত মানুষই দাজ্জালের জান্নাত খ্যাত আগুনে ঝাপ দিবে। দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ হবে ইস্ফাহান হতে আর একসময় ইস্ফাহান জুড়ে ছিল হাসান সাব্বাহের কার্যক্রম।
দাজ্জাল, জিন, কারিন