প্রথমে লাওহে মাহফুজের তাকদীর নিয়ে আগের পর্বে আলোচনা হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ আল্লাহ বনী আদমকে তাদের পিতা আদম (‘আলাইহিস্সালাম)-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করে তাদের নিকট থেকে এমর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা যেন তাঁর সাথে শিরক না করে। এসময় তিনি তাদের সবাইকে দু’বার দু’মুষ্টিতে নিয়েছিলেন এবং এক মুষ্টিকে জান্নাতবাসী আর অপর মুষ্টিকে জাহান্নামবাসী হিসাবে লিখে রেখেছিলেন। এই লিখন ছিল লাউহে মাহফুযে লিখনের পরের স্তরে। (সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৭০৩, ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়, ‘তাক্বদীর’ অনুচ্ছেদ; ছালেহ ইবনে আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ আলুশ্-শায়খ, জামে “উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৬৯)
মহান আল্লাহ বলেন,
‘আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি ; যাতে ক্বিয়ামতের দিন এ কথা না বলতে পার যে, আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে বেখবর।’
আল-আ’রাফঃ ১৭২
● আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ অন্ধকারে তাঁর সৃষ্টিকে সৃষ্টি করে স্বীয় নূরের আলোচ্ছটা দিলেন। ঐদিন যাকে আল্লাহর নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করেছে, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে, যাকে স্পর্শ করেনি, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। সেজন্যই তো আমি বলি, কলম শুকিয়ে গেছে’। (জামে তিরমিযী, হা/২৬৪২, ঈমান অধ্যায়, ‘এই উম্মতের মধ্যে বিভক্তি অনুচ্ছেদ, ইমাম তিরমিযী (রহেমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন)
মনে রাখতে হবে, একদলকে জান্নাতী এবং অপর দলকে জাহান্নামী হিসাবে লিখে দেওয়া অথবা একদলকে আল্লাহর নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করা এবং আরেক দলকে স্পর্শ না করার বিষয়টি এলোপাতাড়ি কোন বিষয় নয়; বরং আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান, ইচ্ছা এবং তাঁর পরিপূর্ণ ন্যায় ও ইনছাফের উপর ভিত্তি করেই তা সংঘটিত হয়েছে।
তৃতীয় পর্যায়ঃ মানুষ মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা এসে তার আয়ু, কর্ম, রিযিক্ব এবং সে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা, তা লিখে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’ঊদ (রা) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের যে কাউকে চল্লিশ দিন ধরে তার মায়ের পেটে একত্রিত করা হয়, তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে জমাটবদ্ধ রক্ত হয় এবং তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। অতঃপর চারটি বিষয়ের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তার কাছে ফেরেশতা পাঠান এবং তার রিযিক্ব, দুনিয়াতে তার অবস্থানকাল, তার আমলনামা এবং সে দুর্ভাগা হবে না সৌভাগ্যবান হবে তা লিখে দেওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়’।
লাউহে মাহফুযের লিখন ছিল সমগ্র সৃষ্টিকুলের; কিন্তু মায়ের পেটের এই লিখন শুধুমাত্র মানুষ জাতির জন্য নির্দিষ্ট।
চতুর্থ পর্যায়ঃ প্রত্যেক ক্বদরের রাতে ঐ বছরের সবকিছু লেখা হয়। লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে ঐ বছরের সবকিছু লিখতে নির্দেশ দেন। ইহাকে বাৎসরিক তাক্বদীর বলা হয়।
মহান আল্লাহ বলেন,
“আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।”
সূরা দুখান ৩-৪
ইবনে আব্বাস বলেন, ক্বদরের রাতে লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী ঐ বছরের জন্ম, মৃত্যু, রিযিক্ব, বৃষ্টি ইত্যাদি সবকিছু আবার লেখা হয়। এমনকি ঐ বছর কে হজ্জ করবে আর কে করবে না, তাও লিখে রাখা হয়।
পঞ্চম পর্যায়ঃ পূর্বের লিখিত তাক্বদীর অনুযায়ী প্রত্যেক দিন সবকিছুকে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়। এটা প্রত্যাহিক তাক্বদীর।
মহান আল্লাহ বলেন,
“তিনি প্রতিদিন কোন না কোন কাজে রত আছেন।”
সূরা আর রহমানঃ ২৯
(জামে’উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্ ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৭০; আত-তা’লীক্বাতুয্ যাকিইয়াহ আলাল আক্বীদাতিল ওয়াসেত্বিইয়াহ, ২/১৫৭।)
● ইবনে জারীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূল (সা) উক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলে ছাহাবায়ে কেরাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক দিন তিনি কি করেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কাউকে ক্ষমা করেন, কারো বিপদাপদ দূর করেন, কারো মর্যাদা বৃদ্ধি করেন আবার কারো মর্যাদার হানি করেন।
(ইবনে জারীর ত্ববারী, তাফসীরে ত্ববারী (জামেউল বায়ান ফী তাবীলিল কুরআন), তাহক্বীক্ব: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুহসিন তুর্কী, (দারু হাজার/হিজর, প্রথম প্রকাশ: ২০০১ইং), ২২/২১৪, বর্ণনাটি ‘হাসান’ (মা’আরেজুল ক্ববূল-এর ৩/৯৩৯ পৃষ্ঠার টীকা দ্র:))
তাক্বদীর লিপিবদ্ধের এই পাঁচটি পর্যায়ের শেষোক্ত চারটি পর্যায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দার বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতামণ্ডলীকে তাঁদের স্ব-স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করা এবং এগুলি লাউহে মাহফূযে লিখিত তাক্বদীরের বাইরে নয়; বরং এগুলি লাউহে মাহফূযের তাক্বদীরেরই অন্তর্ভুক্ত।।
আর তাকদীরের সকল জ্ঞান আল্লাহর নিকট, ফেরেশতাদের দায়িত্ব অর্পনের জন্য যতটুকু জ্ঞান দেয় তারা ততটুকুই জানে।
তাকদীরের হ্রাস-বৃদ্ধি বলতে শবে কদ্বরের রাতে লিখিত তাকদীর ও দৈনন্দিন আমাদের রিযিকের হ্রাস-বৃদ্ধিকে বুঝায়। এবং এই পরিবর্তন লাওহে মাহফুজে পূর্বে উল্লেখ রয়েছে যা ফেরেশতাদের জ্ঞানে ছিলো না।
এই বিষয়ে ইবনে তাইমিয়ার (রহঃ) মতামত বেশিরভাগ আলেমই গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন তাক্বদীর ২ প্রকার।
এক. অনড় তাক্বদীর: উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে লিখিত তাক্বদীর এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকারের তাক্বদীরে কোন পরিবর্তন হয় না।
দুই. ঝুলন্ত তাক্বদীর: ফেরেশতামণ্ডলীর নিকট লিখিত তাক্বদীর এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকার তাক্বদীরে পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং রিযিক্ব, আয়ু লাউহে মাহফূযে অনড় রয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হয় না। তবে ফেরেশতামণ্ডলীর দফতরে লিখিত রিযিক্ব, আয়ু ইত্যাদিতে পরিবর্তন হতে পারে। (আল-ঈমান বিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১২৫)।
ইবনে তাইমিয়া (র.) বলেন, মানুষের আয়ু দুই ধরনের: এক ধরনের আয়ু অনড়, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। দ্বিতীয় প্রকারের আয়ু কোন শর্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকে। এর আলোকে রাসূল (সা.)-এর নিম্নোক্ত হাদীসটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে উঠে,
মহান আল্লাহ ফেরেশতাকে বান্দার আয়ু লেখার নির্দেশ দেন এবং তাঁকে বলে দেন, বান্দা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তুমি তার বয়স এত বছর বাড়িয়ে দিও। কিন্তু তার বয়স বাড়বে কি বাড়বে না সে বিষয়ে ফেরেশতা কিছুই জানেন না।
কেবল আল্লাহই তার সুনির্দিষ্ট বয়স সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। তারপর তার মৃত্যু এসে গেলে আর সময় দেওয়া হয় না। (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৮/৫১৭)।
তাঁকে মানুষের রিযিক্ব কম-বেশী হয় কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
রিযিক্ব দুই প্রকার: এক প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে কেবলমাত্র আল্লাহই জ্ঞান রাখেন এবং এই প্রকারের রিযিক্বে কোন পরিবর্তন হয় না।
দ্বিতীয় প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে অবহিত করান। এই প্রকারের রিযিক্ব কম-বেশী হওয়ার বিষয়টি বান্দার কর্মের উপর নির্ভর করে।
যেমন- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে লোক তার রিজিক প্রশস্ত ও আয়ু বাড়াতে চায় সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ (বুখারি)
হাফেয ইবনে হাজার র. বলেন,
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেরেশতাকে বলা হয় যে, অমুক আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তার বয়স হবে ১০০ বছর। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার বয়স হবে ৬০ বছর। কিন্তু আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, সে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে নাকি ছিন্ন করবে। সেজন্য আল্লাহর জ্ঞানে যা রয়েছে, তার কোন পরিবর্তন ঘটে না।
কিন্তু ফেরেশতার জ্ঞানে যা রয়েছে, তাতে পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন,
‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন এবং বহাল রাখেন’
সূরা আর রা‘দঃ ৩৯
সুতরাং মিটিয়ে দেওয়া বা বহাল রাখার বিষয়টি ঘটে ফেরেশতার জ্ঞানের ক্ষেত্রে। কিন্তু উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে যা রয়েছে, তাতে তেমনটি ঘটে না। আর লাউহে মাহফূযের সবকিছুই আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে।