মুসলিম বিশ্বের খলিফা তখন হযরত আলী (রাঃ)। একবার হযরত আলী (রাঃ) এর অতি প্রিয় ও মুল্যবান লৌহ বর্ম হারিয়ে গেল।
একদিন তিনি দেখলেন কুফার বাজারে জনৈক অমুসলিম সেই বর্মটি বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে। কাছে গিয়ে তিনি বর্মটি ভালোভাবে পরখ করে চিনে ফেললেন, বললেন – ‘বর্মটি আমার। এটি আমার উটের পিঠ থেকে অমুক রাত্রে … অমুক স্থানে পড়ে গিয়েছিল।’
লোকটি বলল – ‘ জ্বী না, আমিরুল মুমিনীন! এটি আমার বর্ম এবং আমার হাতেই রয়েছে।’
হযরত আলী (রাঃ) বললেন – ‘এটি অবশ্যই আমার বর্ম কারণ এটি আমি বিক্রিও করিনি বা কাউকে দানও করিনি। এটি কখনও তোমার হতে পারেনা।’
লোকটি বলল- ‘তাহলে তো মীমাংসার জন্য কাজীর কাছেই যেতে হয়।’
হযরত আলী (রাঃ) বললেন – ‘ঠিক আছে চল কাজীর কাছেই যাই…।’
সে সময় কাজীর দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট তাবেঈ শুরাইহ (রঃ)। উভয়েই গেল শুরাইহের দরবারে। শুরাইহ আলী (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘আপনার বক্তব্য কি? হে আমিরুল মুমিনীন!’
হযরত আলী (রাঃ) বললেনঃ ‘এই লোকটির হাতে যেই বর্ম দেখতে পাচ্ছেন সেটি আমার। অমুক রাতে, অমুক স্থানে এটি আমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমার বর্মটি আমাকে ফেরত দিতে বলুন।’
এরপর শুরাইহ (রঃ) লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘তোমার বক্তব্য বল…’
লোকটি বলল – ‘জনাব, এটি আমার বর্ম এবং আমার দখলেই আছে। আমি আমিরুল মুমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিনা যে, তিনি মিথ্যা অভিযোগ করছেন…।’
এরপর শুরাইহ (রঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে বললেন – ‘আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, আপনার কথাই সত্য এবং বর্মটি আপনারই। কিন্তু আপনার বক্তব্যের পক্ষে নির্ভরযোগ্য দুই জন সাক্ষী আছে কি?’
হযরত আলী (রাঃ) বললেন – ‘নিশ্চয় আছে… আমার ছেলে হাসান এবং ক্রীতদাস কাম্বর’
শুরাইহ (রঃ) বললেন – ‘ কিন্তু পিতার পক্ষে সন্তানের সাক্ষ্য আমি গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করি না হে আমিরুল মুমিনীন।’
হযরত আলী (রাঃ) অবাক হয়ে বললেন – ‘সুবহানাল্লাহ! জান্নাতবাসী একজন মানুষ, তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়? আপনার কি জানা নেই, রাসূল (সাঃ) বলেছেন – হাসান ও হুসেইন হবে জান্নতী যুবকদের সরদার।’
শুরাইহ (রঃ) বললেন – ‘কেন নয় অবশ্যই আমি জানি হে আমিরুল মুমিনীন…। কিন্তু পিতার পক্ষে আমি সন্তানের সাক্ষ্য অনুমোদন করি না।’
হযরত আলী (রাঃ) নিরুপায় হয়ে লোকটিকে বললেন – ‘যাও… তুমিই এটি নিয়ে যাও, কারণ আমার আর কোন সাক্ষী নাই।’
তখন লোকটি বলে উঠল – ‘কিন্তু আমি তো আছি, আমিই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে বর্মটি আপনার…’
এরপর হৃদয়ের সবখানি আবেগ কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে সে বলল – ‘হায় আল্লাহ্! আমিরুল মুমিনীন আমার বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হয়েছেন তারই অধীনস্থ কাজীর দরবারে!
তারই অধীনস্ত কাজী তারই বিরুদ্ধে আমার পক্ষে রায় দিলেন!
আমি সাক্ষ দিচ্ছি, যে দ্বীন (ধর্ম) এমন সুন্দর শিক্ষা দেয় সেই দ্বীন অবশ্যই সত্য…’
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি – ‘আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) তার বান্দা ও রাসুল’
‘হে কাজী! নিঃসন্দেহে বর্মটি আমিরুল মুমিনীনের। তার যে বাহিনী সিফফীন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিল, আমি তাদের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলাম। হটাৎ দেখলাম ধূসর রঙয়ের উটের পিঠ থেকে বর্মটি পড়ে গেল, সাথে সাথে আমি সেটি তুলে নেই।’
হযরত আলী (রাঃ) এই সব কথা শোনার পর বললেন – ‘তুমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছ তখন বর্মটি আমি তোমাকে দান করে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার একটি ঘোড়াও তোমাকে দিলাম।’
এই ঘটনার পর খুব বেশি সময় যায় নি, দেখা গেল ঐ লোকটি আলী (রাঃ) এর পতাকাতলে খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এবং চরম বীরত্বের সাথে লড়াই করতে করতে নাহারওয়ান এর যুদ্ধেই শহীদ হয়ে গেলেন। হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে আলী (রাঃ) এর তখন এই হাদীস জানা ছিল না সন্তানের সাক্ষী পিতার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। পরে তিনি মেনে নেন। এটাই ইসলামের সৌন্দর্য্য। যতক্ষণ না সুস্পষ্ট দলিল প্রমান না থাকে অপরাধীকে অপরাধী বলা যাবে না কারণ সে যদি প্রকৃত অপরাধী হয় তার বিচার আল্লাহ করবেন বা পাপ আল্লাহ গোপন রেখে তাকে হেদায়েত বা রক্ষা করবেন। কিন্তু বিচারের নামে যেন কখনও নির্দোষকে অপরাধী বানানো না হয় সেই ব্যাপারে ইসলাম সচেষ্ট। আলী (রাঃ) ও কাজীর নিকট স্বাক্ষী ছিল না তারা বললেন না- আসুন আমরা গম পড়া, খেজুর পড়া বা আয়না পড়া দিয়ে চোর চিহ্নিত করি। কারণ ইসলামে এসব কুফর, শিরকী নিয়ম নেই। এসব ভ্রান্ত নিয়মনীতি অন্য ধর্ম হতে ইসলামে এসেছে। নামধারী যেসব হুজুর এরূপ চাল পড়া, আয়না পড়া, বাটি চালান দেয় – তাদের জিজ্ঞাস করুন তারা কি দোয়া পড়ে কারণ রসুল (সাঃ) সব দোয়াই উম্মতের জন্য সুস্পষ্ট বলে গেছেন। এমন কোন দোয়া নেই যা গোপন রাখতে হয় ও এমন শিক্ষা নেই আড়াল রাখতে হয়। বরং ইসলামের শিক্ষা যতই ছড়াবে যতজন আমল করবে ততই নেকী পাবে। তাহলে তাদের উচিত সাধারণ মুসলিমদের এই সহীহ বিদ্যা শেখানো। এভাবে চাল পড়া, আয়না পড়া, বাটি চালান দিয়ে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অনেক নির্দোষের জীবন ধ্বংস হচ্ছে। কোন প্রিয় জিনিস হারালে বা চুরি হলে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন – আল্লাহ তারচেয়ে বহু উত্তম কিছু দান করবেন।