সেদিন ছিল বুধবার, বেলা ৪:১৫ তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম, হঠাৎ প্লাটফর্মে মানুষের হইচই। একটা ছেলে নাকি ট্রেন হতে পড়ে গেছে, কৌতূহলী হয়ে আমিও সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি ২০-২২ বছরের একজন ছেলে মাটিতে শুয়ে আছে তার মুখ হতে রক্ত ঝরছে আর আশেপাশের কৌতুহলী মানুষগুলো সাহায্যের বদলে তাকে অনবরত প্রশ্ন করছে, সমালোচনা করছে। আহারে! অদ্ভুত জাতি টিভিতে যারা মেসি, নেইমার, রেনোলদোর মত তারকাদের ইনজুরি, লালকার্ড ও পরাজয় দেখে অশ্রু ঝরায় তখন ভাবে না এই খেলাটাই হারাম। অথচ তাদের চোখের সম্মুখে তাদের মুসলিম ভাই আহত, রক্তাক্ত আর সাহায্যের বদলে সমালোচনা, ব্যক্তি জ্ঞান জাহিরে মত্ত। আমি ছেলেটিকে ধরে নিয়ে পাশের মসজিদের অযুখানায় তার রক্তমাখা মুখটা ধুইয়ে দিলাম, মাথায় পানি দিলাম, দেখলাম তার বাম চোয়ালের নিচে বড় একটা গর্ত আর পায়ে আঘাত পেয়েছে। ছেলেটা অনর্গল কাঁদতে ছিল, তার মা, ভাই , আত্মীয়স্বজন সবাইকে সাহায্যের জন্য কল করছিল। আমি বললাম – চিন্তা করো না আমি তোমার চিৎকিসার ব্যবস্হা করবো। ছেলেটাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠলাম, ছেলেটা যেন হতাশ না হয় সেজন্য তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। সে জানালো ভার্সিটিতে পড়ে প্রকৌশলী বিভাগে, ক্লাস শেষ করে বনানী স্টেশন হতে ট্রেনে করে বাসায় ফিরছিল। ভীষন ভিড় ছিল ট্রেনে তাই দরজার পাশে সে দাড়িয়েছিল, ট্রেন থামার সময় কারো সাথে তার ধাক্কা লাগে আর সে পড়ে যায়। এই বলে সে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষন পরে ওর ফোনটা বেজে উঠল, ধরলাম আমি ওপাশ থেকে শুনলাম ছেলেটার মায়ের কান্না জড়িত কন্ঠ আমাকে বলল ওকে ইসলামিক হাসপাতাল নিয়ে যেতে ওরা সবাই হাসপাতালে আছে। প্রচন্ড জ্যাম সড়কে, তাই আস্তে আস্তে চলছে সিএনজি আর অবিরত কল ধরে ছেলেটার মার কান্নারত কন্ঠ শুনি। অবেশেষে হাসপাতালে এসে পৌঁছলাম। দেখলাম- ওর মা, বাবা, ভাই সবাই আছে ওখানে। ছেলেটাকে যখনি হাসপাতালে নিয়ে প্রবেশ করলাম হঠাৎ সে জ্ঞান হারালো, স্টেচারে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার জানাল তেমন সমস্যা নাই তবে শরীরটা ভীষন দুর্বল। ছেলেটার মা আমাকে ধরে অনেকক্ষন কান্না করল। আমি চলে আসার সময় ওদের সাথে একসাথে ইফতার করতে বলল কিন্তু আমার মনটা সায় দিল না। আজও আমাদের দেশে অনেকে কষ্ট করে পড়াশুনা করে কিন্তু যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, যোগ্যতা থাকাসত্ত্বেও শিক্ষিত মানুষগুলো বেকার হয়ে ঘুরে। তখন মনে হয় সমাজের প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের জুলুমে নিরীহ মানুষগুলো নিষ্পেষিত। আর আমরা ও আমাদের অভিভাবকরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মত করেও যদি দ্বীনী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিত তার জন্য শ্রম, অর্থ খরচ করত তাহলে ইনশাআল্লাহ জান্নাতের পুরস্কার পেত। হয়তো দুনিয়ার রিজিকও সহজ হতো। সমাজব্যবস্হা, রাষ্ট্রব্যবস্হায় অযোগ্য লোকদের বসিয়ে যতই উচ্চশিক্ষিত হোক না কেন মানুষ- শিক্ষিতরা বেকার হবে আর সৎরা অবহেলিত, অপমানিত হবে। আর এই দুর্গতির জন্য দায়ী হল ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্হা এবং অনেক আলেমদের শিক্ষা নিয়ে ভুল ফাতেয়া। আমাদের দেশে দুনিয়ার শিক্ষা ও দ্বীনি শিক্ষা নামক মতবাদ প্রচলন ঘটেছে। অথচ প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভর করে। মুমিনের কোন কাজেই দ্বীনের বিপরীত দুনিয়ামুখী নয়। কেউ যদি হালাল রিজিক অর্জনের জন্য, মুসলিমদের সেবা ও উপকারে জ্ঞান অর্জন করে তাও দ্বীনের জন্য হয়, আল্লাহও নেকী দেন। রসুলের (সা) হাদীসে রয়েছে- “যে ব্যক্তি নিজের রুজি উপার্জনের জন্য কাজ করে সে কাজে লক্ষ্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তার দৃষ্টান্ত মুসা (আঃ) এর মায়ের মত। তিনি নিজের সন্তানকে দুধ পান করান এবং তার বিনিময় লাভ করেন।” (তিবরানী,বায়হাকী)। হালাল রিজিক অন্বেষণকারী আল্লাহর সন্তুষ্টি পায় এবং রিজিকও অর্জন করে। রসুলের (সাঃ) সাহাবীদের কেউ ছিলেন হালাল ব্যবসায়ী, কেউ কৃষিজীবী, কেউ রাখাল। তাদের ব্যবসা, কৃষি, পশুপালন বিষয়ে উত্তম জ্ঞান ছিল। এগুলো দিয়ে তারা যেমন হালাল জীবনযাপন করতেন তেমনি জেহাদ, যাকাত, দান সদকদাসহ দ্বীনের কাজে লাগাতেন। রসুল (সাঃ) নিজেই টেকনোলজির উন্নত শিক্ষা পছন্দ ও গ্রহণ করতেন। তার তালোয়ার জুলফিকার ছিল দুমুখী তাৎকালীন সময়ে উন্নত সমরাস্ত্র। খন্দকের যুদ্ধের সময় সালমান ফারসী (রাঃ) এর পরামর্শক্রমে খন্দক খনন করেন যা সালমান ফারসী (রাঃ) কাফেরদের হতে শিখে ছিলেন। আজও বিশ্বে ডাক্তার, প্রকৌশলী, কেমিস্ট আছে যারা একইসাথে কুরআন, হাদীস বিশেষজ্ঞ এবং ইসলামের বাণী ছড়াচ্ছে।