আলেমদের নেতৃত্ব, ফাতওয়ার ফেতনায় মুসল্লীরা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। এর অন্যতম কারণ – নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বীনের মাপকাঠিতে পরিনত করা। আর অনেকে সত্য বুঝতে পারে তবুও গ্রহণ করে না সমালোচনা ও বিরোধিতার ভয়ে। অথচ সত্য গ্রহণ করে জীবন দিলে শ্রেষ্ঠ শহীদ হতে পারতো।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সেই পত্রখানি আনার নির্দেশ দিলেন, যা তিনি দিহ্ইয়াতুল কালবী (রাঃ)-কে দিয়ে বসরার শাসকের মাধ্যমে হিরাক্লিয়াসের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। তিনি তা পড়লেন। তাতে (লেখা) ছিলঃ
বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম (পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে)। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পক্ষ হতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। – শান্তি (বর্ষিত হোক) তার প্রতি, যে হিদায়াতের অনুসরণ করে।
তারপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। আল্লাহ্ আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সকল প্রজার পাপই আপনার উপর বর্তাবে।
‘‘হে আহলে কিতাব! এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক ও অভিন্ন। তা হল, আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত না করি, কোন কিছুকেই যেন তাঁর শরীক সাব্যস্ত না করি এবং আমাদের কেউ যেন কাউকে পালনকর্তারূপে গ্রহণ না করে আল্লাহকে ত্যাগ করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমরা বল, ‘‘তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা তো মুসলিম।’’ (সূরাহ্ আলে-‘ইমরান ৩/৬৪)
আবূ সুফইয়ান বলেন, ‘হিরাক্লিয়াস যখন তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন এবং পত্র পাঠও শেষ করলেন, তখন সেখানে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, চীৎকার ও হৈ-হল্লা চরমে পৌঁছল এবং আমাদেরকে বের করে দেয়া হলো।
পরবর্তীতে হিরাক্লিয়াস হিমসের প্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলেন এবং প্রাসাদের সকল দরজা বন্ধ করার আদেশ দিলে দরজা বন্ধ করা হলো। অতঃপর তিনি সম্মুখে এসে বললেন, হে রোমের অধিবাসী! তোমরা কি মঙ্গল, হিদায়াত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবীর বায়’আত গ্রহণ কর।’
এ কথা শুনে তারা বন্য গাধার ন্যায় দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু তারা তা বন্ধ দেখতে পেল। হিরাক্লিয়াস যখন তাদের অনীহা লক্ষ্য করলেন এবং তাদের ঈমান থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন বললেন, ‘ওদের আমার নিকট ফিরিয়ে আন।’ তিনি বললেন, ‘আমি একটু পূর্বে যে কথা বলেছি, তা দিয়ে তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপর কতটুকু অটল, কেবল তার পরীক্ষা করছিলাম। এখন তা দেখে নিলাম।’ একথা শুনে তারা তাঁকে সিজদা করল এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হলো। এটাই ছিল হিরাক্লিয়াসের সর্বশেষ অবস্থা। (বুখারী- সংক্ষিপ্ত)
হিরাক্লিয়াস ভেবেছিল ভক্তরা তার কথায় ঈমান আনবে যেভাবে রাজা কনস্টান্টাইন নাসারাদের ধর্ম গ্রহন করলে, অধিকাংশরা তা মেনে নেয় ফলে নেতৃত্ব কনস্টান্টাইনের কাছে থেকে যায়। তেমনি ভক্তরা ঈমান আনলে নেতৃত্ব তার হাতে থাকতো। কিন্তু অন্ধ ভক্তরা বিরোধিতা ও নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে সেই ঈমান না এনে কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
আজও দেখবেন বহু আলেমই তার ভুল-ভ্রান্তি ছেড়ে সত্য পথে চলার ও আহ্বানের ইচ্ছে জাগে কিন্তু অন্ধভক্তরা তার সত্যকে মানতে রাজি থাকে না। তাদের সমালোচনা, নেতৃত্ব, দুনিয়ার আরাম আয়েশ হারানোর ভয়ে আলেমরা হক্ব পথে ফিরতে পারে না। কোন আলেম কোন ভুল বক্তব্য দিলে তিনি বক্তব্য সংশোধন করে তওবা করার পূর্বে তার ভক্তরা যুক্তি দিয়ে তার ভুলকে জায়েজ প্রমান করতে চায়!?
অপরদিকে মুসলিমদের উত্তম উদাহরণ হলো আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:)। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মদীনা আগমনের খবর আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের নিকট পৌঁছলে তিনি এসে নবী করীম (সাঃ)-কে কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করেন।
তিনি বলেন, আমি আপনাকে এমন তিনটি বিষয়ে প্রশ্ন করব যা নবী ছাড়া আর কেউ জানে না- (এক) ক্বিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত কি? (দুই) জান্নাতবাসীগণ সর্বপ্রথম কোন খাদ্য খাবে? (তিন) কিসের কারণে সন্তান (আকৃতিতে কখনো) তার পিতার অনুরূপ হয়, আবার কখনো মায়ের মত হয়? নবী করীম (সাঃ) বললেন, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিবরাঈল এইমাত্র আমাকে বলে গেলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম বলেন, ফেরেশতাদের মধ্যে তিনিই তো ইহুদীদের শত্রু। নবী করীম (সাঃ) বললেন, ক্বিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত হ’ল আগুন, যা মানুষকে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে নিয়ে সমবেত করবে। আর জান্নাতবাসীগণ সর্বপ্রথম যে খাদ্য খাবে তা হ’ল মাছের কলিজার অতিরিক্ত টুকরো, যা কলিজার সাথে লেগে থাকে।
আর সন্তানের ব্যাপারটা হ’ল এই- নারী-পুরুষের মিলনকালে যদি নারীর আগে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান বাপের অনুরূপ হয়, আর যদি পুরুষের আগে নারীর বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান মায়ের আকৃতি ধারণ করে। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল।
তিনি বললেন, হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! ইহুদীরা এমন একটি জাতি যারা অপবাদ রটনায় অত্যন্ত পটু। কাজেই আমার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে তারা জ্ঞাত হবার আগে আপনি আমার ব্যাপারে তাদের নিকট জিজ্ঞেস করুন। তারপর ইহুদীরা এলে নবী করীম (সাঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম কেমন লোক? তারা বলল, তিনি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং সর্বোত্তম ব্যক্তির ছেলে। তিনি আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির ছেলে।
তখন নবী করীম (সাঃ) বললেন, আচ্ছা আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তবে কেমন ব্যক্তি হবে? তারা বলল, আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন। তিনি পুনরায় একথা বললেন। তারাও সেই একই জবাব দিল। এমন সময় আব্দুল্লাহ ভেতর থেকে তাদের সামনে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা‘বূদ নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তখন তারা বলতে লাগল, এ লোকটা আমাদের মধ্য সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তি এবং সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তির ছেলে। তারপর তারা তাকে খুব হেয় প্রতিপন্ন করল। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের ব্যাপারে আমি এটাই আশংকা করছিলাম (ছহীহ বুখারী হা/৩৩২৯)।
কুরআনে বনী ইসরায়েল ও ইহুদিদের এরূপ আচরনের উল্লেখ রয়েছে –
“বলুন, যদি এ (কুরআন) আল্লাহর নিকট হতে (অবতীর্ণ) হয়ে থাকে, আর তোমরা এতে অবিশ্বাস কর, অথচ বনী ইসরাইলের একজন এর (অর্থাৎ তাওরাতের) অনুরূপ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে এতে বিশ্বাস স্থাপন করল, আর তোমরা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, (তাহলে তোমাদের পরিণাম কী হবে) তা ভেবে দেখেছ কি? নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।” (সূরা আল আহকাফঃ ১০)
আজও একই নীতি তারা অনুসরণ করে চলছে। ধরুন কোন রাজনৈতিক দলের বড় নেতা বা বড় আলেম চরিত্রবান ব্যক্তি যদি গণতন্ত্র, দল, ফির্কা ছেড়ে তওবা করে যদি ইসলামের পথে চলতে শুরু করে। পূর্বে তার দলের লোকগুলো তাকে নিয়ে গর্ব করতো এখন শত অপবাদ দিবে ও দালাল ঘোষণা করবে। অথচ যখন সে কুফরী রাজনীতি করতো তারা তার নেতৃত্ব, কতৃত্ব মানতো এবং তিনি ছিলেন প্রশংসিত। ইসলাম গ্রহণের পর ওরা তাদের নিকৃষ্ট বলে প্রচার করে। অথচ আমরা অপ্রপ্রচারগুলো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই বিশ্বাস করি।
