দ্বীনি ক্ষেত্রে কেন দ্বৈত নীতি?

আহলে বায়াতের ফজিলত বর্ননা করলে শিয়া, রাফেজী উপাধি মিলে। আবার রাফেজীদের নেতার মৃত্যুতে শোককারী বা শহীদ ঘোষণাকারীদের আবার আমীরুল মুমিনীন ভাবে।

তাগুত, বিদআত, কুফরের বিরোধীতা করলে উগ্রবাদী, রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করবে। অথচ নাস্তিক, ইসলাম বিদ্বেষীদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করবে। আবার মুসলিম পরিচয় দেওয়া লোকগুলো এক দল আরেক দলকে কাফের, মুনাফেক বলবে। সামান্য নেতৃত্ব নিয়ে মারমুখী সংঘর্ষ করছে। অথচ তখন উদার আলোচনা করে সমাধান করে না।

রসুল (সা), সাহাবী (রা:), তাবেয়ীরা (রহ:) কি এরূপ আলোচনায় বসেছেন যেখানে রসুল (সা:) ও তার পবিত্র স্ত্রীদের চরিত্র নিয়ে সমালোচনা করা হবে। বরং তারা দাওয়াহ দিয়েছেন তাওহীদের ও কুরআনের। যে কুরআন জেনে মেনেছে সে জীবন্ত কুরআন রসুলের (সা:) অনুসারী হয়েছে, তার ও উম্মুল মোমিনদের পবিত্রতা মেনে নিয়েছে যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আর যারা দ্বীন মানেনি স্বীয় ধর্ম মেনে চলতো কিন্তু রসুলের (সা:) চরিত্র নিয়ে সমালোচনা করার সাহস পেত না।

হক্ব কথা বললে নিজেদের দল/আলেমের বিরুদ্ধে গেলে মিথ্যা অপবাদ দিবেন, দাওয়াহ-এ বাঁধা দিবেন। ভাই, আমাদের পাঠক বা সমর্থক কয়জন! না আমরা অর্থ নিয়ে দ্বীন প্রচার করি, না কোন দলের দিকে আহ্বান করছি। অথচ হাজার টাকায় মিথ্যা ওয়াজ করা, ইসলামের নামে কুফর, শির্ক শিখানো বক্তার অভাব নেই তাদের কি অনুরূপ বাঁধা দেন?

না দুর্বল দেখে যত অপবাদ, বাধা আমাদের দিচ্ছেন? যাদের ভক্ত, ক্ষমতা বেশি নিরবতা পালন করছেন। এতটা বাঁধা যদি জালেম, ঘুষখোর, নেশাখোর, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে দিতেন- দেশে জালেম, দুর্নীতিবাজ থাকতো না। পথেঘাটে নেশার ছড়াছড়ি হতো না।

শুধু একটা সহজ কাজ করেন দেখি- নিজের এলাকা নেশা হতে মুক্ত করেন, দেখবেন জীবন কত জটিল হয়ে যাবে। তবুও আমরা হেদায়েতের দোয়া করবো ও আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন মুসলিম হয়ে মরতে পারি।

কুরআনে বর্নিত –

আর তুমি তো আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছ শুধু এ জন্যে যে, আমরা আমাদের রবের নিদর্শনে ঈমান এনেছি যখন তা আমাদের কাছে এসেছে। হে আমাদের রব! আমাদেরকে পরিপূর্ণ ধৈর্য দান করুন এবং মুসলিমরূপে আমাদেরকে মৃত্যু দিন। (সুরা আরাফ – ১২৬)

আর যদি সত্য, মিথ্যা ফেতনার কারণে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তাহলে এই দোয়া করুন-

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এভাবে দোয়া করতেন-

‘আল্লাহুম্মানফানি বিমা আল্লামতানি ওয়া আল্লিমনি মা ইয়ানফাউনি ওয়া যিদনি ইলমা’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ, যা কিছু আমাকে শিখিয়েছেন তার মাধ্যমে আমাকে উপকৃত করুন এবং আমাকে সেই জ্ঞান দান করুন, যা আমাকে উপকৃত করবে। আর আমার ইলম আরও বৃদ্ধি করুন’ (ইবনে মাজা : ৩৮৩৩)।

আর আল্লাহ দ্বীনের নামে ফেতনা ছড়ানো যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমাদের ধ্বংস করুন আর যারা ইসলামের কারণে আমাদের দাওয়াহ-এ বাধা দিচ্ছে তাদের হয় হেদায়েত বা ধ্বংস করুন।

হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিটি কষ্ট, আত্মত্যাগের স্বাক্ষী আপনি।

দাওয়াহ দিলে বহু দলিল যুক্তি, তর্কের পরও তা যদি কারো মত বা কারো পছন্দনীয় আলেমের বিরুদ্ধে যায় তাহলে পরস্পরকে কাফের, ইহুদির দালাল, ফেতনাবাজ বিভিন্ন উপাধি দিতে থাকে।

অথচ হক্ব বাতিলের দলিল হল- কুরআন ও সুন্নাহ।

আসুন কুরআন হতে দেখি – ইহুদি, খ্রিস্টানরা নিজেকে সত্য ও নাজাতপ্রাপ্ত একমাত্র দল দাবি করত। কুরআনের দাওয়াতকে প্রত্যাখান করে পূর্বসূরীদের নামে মিথ্যা দ্বীনের অনুসরণ করতো।

আল্লাহপাক বলেন-

অতঃপর আপনার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে আপনার সাথে তর্ক করে তাকে বলুন, এস, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদেরকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে, আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে, তারপর আমরা মুবাহালা (বিনীত প্রার্থনা) করি, অতঃপর মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা’নত।(সুরা আল ইমরান -৬১)

এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুবাহালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুবাহালা হলো, যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আল্লাহর লানতের অধিকারী হয়।

মূলত: লা’নত অৰ্থ আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া। আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া মানেই আল্লাহর ক্রোধে পড়া। এর সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর ক্রোধ বর্ষিত হোক। এরূপ করার পর যে পক্ষ মিথ্যাবাদী, সে তার প্রতিফল ভোগ করবে। সে সময় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয় অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এতে বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করলেই চলে। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু একত্রিত করলে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়।

৯ম হিজরীতে নাজরান থেকে খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধিদল নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে এসে তারা যে ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে অতিরঞ্জনমূলক আকীদা রাখত, সে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয় এবং মহানবী (সাঃ) তাদেরকে মুবাহালার আহ্বান জানান।

তিনি আলী, ফাতিমা এবং হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-দেরকে সাথে নিয়ে মুবাহালার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসেন এবং খ্রিষ্টানদেরকে বলেন যে, তোমরাও তোমাদের পরিবারের লোকদের সাথে নিয়ে এসো। তারপর আমরা মিথ্যাবাদীর উপর অভিশাপ বর্ষণের বদ দুআ করব। খ্রিষ্টানরা আপোসে পরামর্শ করে মুবাহালা করার পথ ত্যাগ করে বলল যে, আপনি আমাদের কাছে যা চাইবেন, আমরা তা-ই দিব। সুতরাং রসূল (সাঃ) তাদের উপর জিযিয়া-কর ধার্য করে দেন। আর এই কর আদায়ের জন্য তিনি আমীনে উম্মত (উম্মতের বিশ্বস্তজন উপাধি লাভকারী) আবূ উবায়দা ইবনে জাররাহ (রাঃ)-কে তিনি তাদের সাথে পাঠিয়ে দেন। (ইবনে কাসীর এর সারাংশ)

বুখারীর হাদীসে রয়েছে হুযাইফাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নাজরান এলাকার দু’জন সরদার আকিব এবং সাইয়িদ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর কাছে এসে তাঁর সঙ্গে মুবাহালা করতে চেয়েছিল। বর্ণনাকারী হুযাইফাহ (রাঃ) বলেন, তখন তাদের একজন তার সঙ্গীকে বলল, এরুপ করো না। কারণ আল্লাহ্‌র কসম! তিনি যদি নবী হয়ে থাকেন আর আমরা তাঁর সঙ্গে মুবাহালা করি তাহলে আমরা এবং আমাদের পরবর্তী সন্তান-সন্ততি (কেউ) রক্ষা পাবে না।

তারা উভয়ে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলল, আপনি আমাদের নিকট হতে যা চাবেন আপনাকে আমরা তা-ই দেব। তবে এর জন্য আপনি আমাদের সঙ্গে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিন। আমানতদার ব্যাতীত অন্য কোন ব্যক্তিকে আমাদের সঙ্গে পাঠাবেন না। তিন বললেন, আমি তোমাদের সঙ্গে এমন একজন আমানতদার পাঠাবো যে প্রকৃতই আমানতদার এবং পাক্কা আমানতদার।
এ পদে ভূষিত হওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর সাহাবীগণ আগ্রহান্বিত হলেন। তখন তিনি বললেন, হে আবূ ‘উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ্‌! তুমি উঠে দাঁড়াও। তিনি যখন দাঁড়ালেন, তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এ হচ্ছে উম্মতের সত্যিকার আমানতদার। [৩৭৪৫]

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৩৮০
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো – মুবাহালা হয়েছিল আকীদাগত, কারণ তারা মুশরিক ছিল, মাসায়ালাগত নয়। মাসায়ালাগত একতেলাফ থাকা স্বাভাবিক। আজ চারপাশে মুসলিম দাবিদারেরর মধ্যে আকীদাগত দ্বন্দই বিদ্যমান, একদল যেটাকে শিরক, বিদআত, কুফর বলছে আরেক দলের নিকট এটা হালাল, সুন্নত।

যুগ যুগ ধরে পরস্পরকে দোষারোপ না করে বরং আকীদা নিয়ে মুবাহালা করুন দেখবেন খুব কম লোকই রাজি হবে।
কারণ সুনিশ্চিতভাবে জানে- তারা অধিকাংশ ভুল পথে আছে আর আল্লাহর কিতাব আর আল্লাহর আযাব সত্য। আমরা বলি- আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল বা জানার ভুল থাকলে আল্লাহ ক্ষমা ও হেদায়েত করুক আর যারা জেনেশুনে মিথ্যা ছড়ায় তারা আল্লাহর আযাবকে স্মরণ করুন।

প্রায় একই নীতি ইহুদিদের ছিল- তারা নিজেদের হক্ব দাবি করত এবং মরলে জান্নাত নিশ্চিত বলত অথচ দীর্ঘজীবন ছিল ওদের আকাঙ্ক্ষা।

আল্লাহ বলেন-

বলে দিন, যদি আখেরাতের বাসস্থান আল্লাহর কাছে একমাত্র তোমাদের জন্যই বরাদ্দ হয়ে থাকে-অন্য লোকদের বাদ দিয়ে, তবে মৃত্যু কামনা কর, যদি সত্যবাদী হয়ে থাক। কস্মিনকালেও তারা মৃত্যু কামনা করবে না ঐসব গোনাহর কারণে, যা তাদের হাত পাঠিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ গোনাহগারদের সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছে।
আপনি তাদেরকে জীবনের প্রতি সবার চাইতে, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও অধিক লোভী দেখবেন। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ দেখেন যা কিছু তারা করে। (সুরা বাকারহ, আয়াত: ৯৪-৯৬)

আজও বহু দল, বহু মতের অনুসারীরা আছে যারা বলে তাদের পথে চললে জান্নাত। এমনকি মুরীদকে জান্নাতের সুপারিশের স্বপ্ন দেখায় অথচ দীর্ঘ হায়াতের দোয়া করে, শহীদী মৃত্যু কামনা করে না। অথচ রসুলুল্লাহ (সা:) এর সাহাবীরা শহীদী মৃত্যু কামনা করতেন। এমনকি চার প্রধান সাহাবীর মধ্যে তিনজনই শহীদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *