সোশ্যাল মিডিয়ার আয়ের ফেতনা (হক্ব ও গীবত)

রসুল (সা:) ও খেলাফায়ে রাশেদীনের সময়কাল ছিল এমন- উম্মাহ যেকোন সমস্যায় কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে সমাধান করতেন। সাহাবীরা রসুলের (সা:) নিকট সমাধান জানতে চাইতেন, ওহী নাযিল হতো। রসুলের (সা:) পরবর্তীতে কোন সমস্যা হলো জনগন খলিফা বা বিদ্বান সাহাবীদের কাছে জানতে চাইতেন! খলিফারা অন্য সাহাবিদের সাথে আলোচনা করে কুরআন, সুন্নাহর ভিত্তিতে রায় দিতেন। ব্যক্তিজীবন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সবকিছুর সমাধান চাওয়া হতো ইসলামের মাধ্যমে।

মসজিদের মিম্বার হতে এই বিষয়ে খুতবা বা বক্তব্য, জানানো হতো। ধীরে ধীরে উম্মাহর রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তন ঘটল – আর বর্তমানে কোন সমস্যা হলে মানুষ সমাধান খুজে এমন কারো কাছে যারা না ইসলামের বিদ্যা অর্জন করেছে, না ইসলামিক নিয়ম কানুন মেনে চলে বরং বিভিন্ন তারকা বা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে মানুষ সমাধান জানতে চায়!!

যাদের প্রায় সবাই কুফর, শিরক বা জেনার মত ভয়াবহ গোনাহে লিপ্ত। বিভিন্ন টক শো, টিকটক, ফেইসবুক, ইউটিউবে এসব বিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তব্য দেয়। অনেকের আয়ের উৎস হল এসব মিডিয়াগুলো। অনেকে গালি দিয়ে কথা বলে অথচ মানুষ তাকে বর্জন না করে জনপ্রিয় করে তুলছে! কারো অদ্ভুত আচরন, হুমকি, অশ্লীলতার ফেতনা ছড়ানোর পরও মানুষ তাদের সম্পর্কে সদাগ্রহী থাকে এতে তাদের আয় ও জনপ্রিয়তা বাড়ে।

হাদীসে এসেছে –

উমর বিন সাঈদ বিন আস রা. একদা পিতা বরাবর খুবই পাণ্ডিত্য ও সাহিত্য-পূর্ণ ভাষায় একটি আবেদন পেশ করলেন। আবেদন পাঠ শেষ হলে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন- তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? ছেলে বলল- জ্বি হ্যাঁ..! পিতা বললেন – (ওহে বৎস! ভেবো না যে, তোমাকে আমি অবহেলা করছি অথবা তোমার আবেদন পূরণে আমি অসম্মত। তবে শুনে রাখ-) নবী করীম সা.কে আমি বলতে শুনেছি- “অচিরেই এমন জাতির আবির্ভাব হবে, যারা গরু-গাভীর মত মুখ ব্যবহার করে উপার্জন করবে।” (মুসনাদে আহমদ)

আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ঐ সত্তার শপথ- যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত! কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না অশ্লীলতা ও কার্পণ্যতা বৃদ্ধি পাবে, বিশ্বস্তকে ঘাতক এবং ঘাতককে বিশ্বস্ত মনে করা হবে, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বিলুপ্তি ঘটবে। মূর্খদের জনপ্রিয়তা ও মাতব্বরি বেড়ে যাবে।” (মুস্তাদরাকে হাকিম)

উম্মত ভুলে যাচ্ছে – মুসলিম সমাধান খুজবে কুরআন, সুন্নাহর মাঝে, কোন তাগুত বা ব্যক্তি মতবাদে নয়।

আল্লাহ বলেন-

আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন-যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন। অনন্তর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে নিন, আল্লাহ তাদেরকে তাদের গোনাহের কিছু শাস্তি দিতেই চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে অনেকেই নাফরমান। তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে!

সুরা মায়েদাহ, ৫০-৫১

ইসলামের বিপরীত সকল মতবাদই জাহেলিয়াত! তার চেয়ে দুঃখজনক হল- নবী, রসুলগন, সাহাবীরা নিজেরা দ্বীনের দাওয়াত ও ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নিজ জান, মাল ব্যয় করেছেন আর বর্তমান আলেমরাই জনগন হতে অনেক ভালো অর্থ নেয় অথচ ওয়াজের নামে অশ্লীল বাক্যপ্রয়োগ, অঙ্গভঙ্গি, একজন আরেকজনের বিষাদগার করে সময় কাটায়। অথচ ইসলামের মূল বিষয় কুরআন, সুন্নাহ, আহলে বায়াত আলোচনায় আসে না। জালেম শাসক, কোন পথভ্রষ্ট আলেমের বিরোধিতা বা ভুল ধরিয়ে দিলে তার ভক্তরা গীবত ছড়ায় বলে অপবাদ দেয়। আসলে উম্মতের অনেকে গীবত ও হক্ব বাক্যের মধ্যে পার্থক্য বুঝেনি।

নিচে সামান্য আলোচনা করবো যেসবক্ষেত্রে গীবত হয় না

১. জালেমের বিরুদ্ধে হক্ব বলা

হাদীসে বর্ণিত আছে- “জালেম শাসকের সামনে ন্যায় বা সত্য বলা সর্বোত্তম জেহাদ।” অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলে।’ [মুসনাদ আহমদ : ১৮৮৩০; ইবন মাজাহ, ৪০১২; নাসাঈ : ৪২০৯]

এছাড়াও রয়েছে
“অতঃপর অযোগ্য লোকেরা তাদের স্হানে বসবে। তারা এমন সব কথা বলবে, যা নিজেরা করবে না। এমন সব কাজ করবে, যার নির্দেশ দেওয়া হয় নি তাদেরকে। যে হাতের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করবে, সে মুমিন। যে জিহ্বার সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করবে, সে মুমিন। অন্তর দিয়ে যে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ (পরিবর্তনের চেষ্টা) করবে, সে মুমিন। ঈমানের এর চেয়ে ক্ষুদ্র সামান্যতম পর্যায়ও নেই।” (মুসলিম- কিতাবুল ঈমান)

শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম আর সবচেয়ে বড় জালেম শাসক হল সে- যারা শিরক চাপিয়ে দেয়। মুসা (আ:), ইব্রাহিম (আ:) তৎকালীন জালেম শাসকের বিরুদ্ধে হক্ব বলেছেন আর রসুল (স:) সত্য বলেছেন ও জেহাদ করেছেন। দাজ্জালের যুগে একজন দাজ্জালের সামনে হক্ব তুলে ধরবে ও শহীদ হবেন। তিনি হবেন উত্তম শহীদ। (মুসলিম- ৭১০৫)

কুরআন, সুন্নাহে বর্নিত এসব জালেমের ইতিহাস যা উম্মাহর জন্য শিক্ষা তা বললে গীবতের গোনাহ হয় না বরং জানানো ফরজ। ঠিক তেমনি যারা উম্মাহর ও ইসলামের ক্ষতি করেছে- সত্য স্পষ্ট করার সাপেক্ষে বা নির্দোষকে অপবাদ হতে বাচাতে, তাদের দুষ্কর্ম তুলে ধরলে তা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

যুগে যুগে আলেমরা ইয়াজিদ, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আলোচনা এনেছেন- কেউ কি গীবত ফাতওয়া দিয়ে বিরত থেকেছে? কারন ওদের জুলমের ইতিহাস জানানোর মূল কারন- আহলে বায়াতের ফজিলত জানানো ও অপবাদ মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। তাহলে বর্তমানে জালেমের বিরুদ্ধে বললে গীবত আ্যখায়িত করা মূর্খতা।

২. কুরআন ও হাদীসের শিক্ষনীয় আলোচনা

কুরআন, সু্ন্নাহে যেসব ঘটনার বর্ননা রয়েছে তন্মধ্যে সাহাবিদের জাহেলী জীবনের ভুল ও আদমের (আ) ফল খাওয়ার কাহিনী এসব বর্ননা করার উদ্দেশ্য হল – যেন উম্মাহ ভুল করে নিরাশ না হয়ে তাদের মত তওবা করে আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারে। সেজন্য স্বয়ং আল্লাহ কুরআনে ও রসুলের (সা:) হাদীসে এরূপ ঘটনা বর্নিত হয়েছে।

৩. পথভ্রষ্ট আলেম

আবু যার (রা:) বলেছেন, “আমি নবী ﷺ -এর নিকটে একদিন উপস্থিত ছিলাম এবং আমি তাকে বলতে শুনেছি, ‘এমন কিছু রয়েছে যেটির ব্যাপারে আমি আমার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের অপেক্ষাও অধিক ভয় করি।’ তখন আমি ভীত হয়ে পড়লাম, তাই আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! এটি কোন জিনিস, যার ব্যাপারে আপনি আপনার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের চাইতেও অধিক ভয় করেন?’ তিনি [নবী ﷺ ] বললেন, ‘পথভ্রষ্ট আলিমগণ।’” (মুসনাদ আহমদ,২০৩৩৫)

পথভ্রষ্ট আলেমের ফেতনা হতে বাচাতে তার অসৎ উদ্দেশ্য, ভুলগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করা ফরজ তা গীবত হয় না। রসুল (সা:) নিজে খ্রিস্টান আলেমদের সাথে মুবাহালায় অংশগ্রহণ করেন। কাদেয়ানীসহ বহু পথভ্রষ্ট আলেমের ব্যাপারে হক্বপন্থীরা যুগে যুগে স্বোচ্ছার ছিল।

৪. (শরীয়াভিত্তিক) বিচারকের কাছে বিচার চাইলে

কারো উপর জুলুম, নির্যাতন হয় বা কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফায়সালার জন্য কারো চরিত্রের দোষ, পাপ বর্ননা করলে গীবতের গোনাহ হয় না। সাহাবিদের জীবনীতে বহু উদাহরণ আছে তাদের কাছে বিচার চাওয়া হতো নাহলে রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা কিভাবে চলবে!

৫. ফাতওয়ার আলোচনা

কোন আলেমের দোষক্রুটি ধরে বদনাম করা মূল উদ্দেশ্য নয় বরং তাদের ভুল ফাতওয়া হলে সুন্দরভাবে ব্যাখা করে বুঝান যেন উম্মত সমাধান পায়। বহুবছর হতে ফেকাহ শাস্ত্রে আলোচনা আসছে- কোথাও ঈমাম আবু হানিফার (রহ:) ফাতওয়া কেন শক্তিশালী অন্য ঈমামদের চেয়ে তার আলোচনা এসেছে কোথাও বাকী ঈমামদের অধিক গ্রহনযোগ্য আলোচনা হয়েছে। আবার কোন আলেমের কাছে কোন ফাতওয়া জানতে চাইলে সত্য বলা যায় যদিও তাতে চরিত্রের দোষক্রটি উঠে আসে। যেমন- কুরআন, হাদীসের বিধান বা যিহারের ফাতওয়া এসেছে যা রসুলর (সা:) কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল!

আল্লাহ বলেন-

আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সে নারীর কথা; যে তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর কাছেও ফরিয়াদ করছে। আল্লাহ তোমাদের কথোপকথন শুনেন; নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।

সুরা মুজদালাহ-১

আল্লাহ তা’আলা খাওলা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার ফরিয়াদ শুনে তার জন্য তার সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। তার খাতিরে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এসব আয়াত নাযিল করেছেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ সেই সত্তা পবিত্র, যার শোনা সবকিছুকে শামিল করে।

যিনি সব আওয়ায ও প্রত্যেকের ফরিয়াদ শুনেন; খাওলা বিনতে সালাবাহ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করছিল, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু এত নিকটে থাকা সত্বেও আমি তার কোনো কোনো কথা শুনতে পারিনি। অথচ আল্লাহ তা’আলা সব শুনেছেন এবং বলেছেনঃ (قَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ) [বুখারী: ৭৩৮৫, নাসায়ী: ৩৪৬০]।

কিছু জিনিস রসুলের (সা:) জন্য বিশেষ, যেমন – উম্মাহ যিহারের বিধান জানতো না, তাদের জানানোর উদ্দেশ্যে এরূপ আলোচনা এসেছে! কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তির নাম ও পরিচয় লুকিয়ে ফাতওয়া চাওয়া উত্তম ও ফাতওয়াদাতা যত সম্ভব উক্ত ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখা উচিত।

তাছাড়া এমন কোন পাপ যা প্রকাশ্যে ঘটছে তা প্রতিরোধ করা বা তার ফেতনা সম্পর্কে সচেতন করতে সত্য বলায় গীবতের গোনাহ হয় না বরং এটা দায়িত্ব। আজও কেউ যদি ইসলাম ও রসুেলের (সা:) অবমাননা করে প্রকাশ্যে আলেমদের সত্য ফাতওয়া দেওয়া এবং ওদের উদ্দেশ্য, চরিত্র সুস্পষ্ট করা উচিত।

৫. বিবাহের ক্ষেত্রে

বিবাহ প্রার্থী ইচ্ছুক এমন নারী, পুরুষের যাচাই বাচাই করার ক্ষেত্রে তার কোন দোষ, ক্রুটি আছে কিনা জানার ক্ষেত্রে গোনাহ হয় না।

আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি কোথাও বিয়ের পয়গাম দেয়। নবী বলেনঃ “মেয়েটিকে দেখে নাও। কারণ আনসারদের চোখে কিছু দোষ থাকে।” (মুসলিম, নাসাঈ, আহমাদ)

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ বলেছেনঃ

“তোমাদের কেউ যখন কোন মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা করে তখন যতদূর সম্ভব তাকে দেখে নিয়ে এ মর্মে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত যে, মেয়েটির মধ্যে এমন কোন গুণ আছে যা তাকে বিয়ে করার প্রতি আকৃষ্ট করে।” (আহমাদ ও আবু দাউদ)

এক্ষেত্রে বিবাহপ্রার্থী কারো কাছে সত্য তথ্য চাইলে জানানো উচিত বলে আলেমদের অভিমত। কারন বিবাহের সাথে বহুজীবন ও দ্বীনী আমল জড়িত। আল্লাহ বলেন-

ব্যভিচারী বিয়ে করে না ব্যভিচারিণী বা মুশরিকা নারী ছাড়া। আর ব্যভিচারিণী- তাকে বিয়ে করে না ব্যভিচারী বা মুশরিক পুরুষ ছাড়া, মু’মিনদের জন্য এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সুরা নুর

এছাড়া আরও কিছু বিধান রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে- প্রত্যেকের নিয়ত ও অন্তরের ব্যাপারে আল্লাহ জানেন। কেউ ইসলামী উদ্দেশ্যে সত্যি তুলে ধরছে না ব্যক্তি শত্রুতা, ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা ও অর্থ অর্জনের জন্য কারো চরিত্রের দোষ তুলে ধরছে, আল্লাহ সবাই জানেন। প্রত্যেকে তার কৃর্তকর্ম অনুযায়ী হিসাব দিতে হবে!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *