যে অল্প কয়েকজনের সাথে রসুলের (সা:) চেহারার সাদৃশ্য ছিল তার মধ্যে একজন হলেন জাফর ইবনে আবু তালেব (রা:)। ইসলামের শুরুতে ঈমান আনয়নকারী ও হাবশায় হিজরতকারী।
আল-বারাআ ইবনু আযিব (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফার ইবনু আবী তলিব (রাযিঃ)-কে বলেনঃ তুমি দৈহিক গঠনে ও স্বভাব-চরিত্রে আমার মতো। (সহীহঃ বুখারী ও মুসলিম)। এ হাদীসে একটি ঘটনা আছে। মক্কায় জুলুম নির্যাতন শুরু হলে তিনিই হিজরত করার ফজিলত অর্জন করেন।
জাফর ইবনু আবূ তালিব, আসমা বিনতু উমায়স ও তাদের নৌ সফর-সঙ্গীদের ফাযীলাত
আবদুল্লাহ ইবনু বাররাদ আশ’আরী ও মুহাম্মাদ ইবনুল আলা আল-হামদানী (রহঃ) …… আবূ মূসা আশ’আরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন আমাদের নিকট রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরাতের সংবাদ পৌঁছল তখন আমরা ইয়ামানে ছিলাম। তারপর আমি ও আমার দু’ ভাই তার নিকট মিলিত হওয়ার জন্য হিজরাত করলাম। আমি ছিলাম সে দু’জনের ছোট। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল আবূ বুরদাহ (রাযিঃ), অন্যজন ছিলেন আবূ রুহম (রাযিঃ)। তিনি হয়ত বলেছেন, তখন পঞ্চাশ জনের কিছু বেশি, নয়ত বলেছেন তিপ্পান্ন জন অথবা বায়ান্নজন ব্যক্তি আমাদের সম্প্রদায়ে ছিল। আমরা একটি নৌকায় আরোহিত হলাম। নৌকাটি আমাদের নিয়ে আবিসিনিয়ায় সন্নিকটে উপস্থিত হলো, যেখানে বাদশাহ ছিলেন নাজাশী। তখন আমরা তার নিকট জাফার ইবনু আবূ তালিব (রাযিঃ) ও তার সাথীদের দেখা পেলাম।
তারপর জাফার (রাযিঃ) বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছেন এবং অবস্থান করার আদেশ দিয়েছেন। অতএব আপনারা আমাদের সাথে অবস্থান করুন। তিনি বলেন, আমরা তার সাথে থাকতে লাগলাম, পরিশেষে আমরা সকলে একসাথে মাদীনাহ প্রত্যাবর্তন করলাম। তিনি বলেন, তারপর খাইবার বিজয়কালে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে একত্রিত হলাম। তিনি আমাদেরও গনীমাতের সম্পদের অংশ দিলেন কিংবা তিনি বলেছেন, তিনি তা হতে আমাদেরও প্রদান করেছেন। তিনি তার সাথে যারা যুদ্ধের মাঠে সমবেত হয়েছিলেন তাদের ছাড়া কাউকে গনীমাতের অংশ দান করেননি। তবে জাফার ও তার সাথীদের সাথে আমাদের নৌকায় আরোহী সাথীদেরও তাদের সাথে অংশ প্রদান করেছিলেন। রাবী বলেন, লোকদের মধ্যে কেউ আমাদের অর্থাৎ- নৌকা আরোহীদের বলে বেড়াত যে, আমরা তোমাদের অগ্রে হিজরাতকারী। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬১৮৫, ইসলামিক সেন্টার ৬২২৯)
হাবশায় নাজ্জাশী দরবারে ভয়াবহ পরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে তিনি সুস্পষ্ট সত্য বক্তব্য দেন – যা উম্মাহর জন্য আজও আদর্শ পরিস্থিতি, যতই কঠিন হোক কুরআনের সত্য সুস্পষ্ট বলতে হবে – এটাই উম্মাহর মুক্তির পথ।
সীরাত ও হাদীস হতে জানা যায়
মক্কার কোরাইশরা সাহাবীদের হাবশায় হিজরতের ঘটনা জানতে পেরে তাদের মধ্য থেকে শক্তিমান ও তাগড়া জোয়ান দু’ব্যক্তিকে নির্বাচন করে নাজ্জাশীর কাছে পাঠাল। এ দু’ব্যক্তি হল, আমর ইবনুল ’আস ও আবদুল্লাহ ইবন আবী রাবীয়া। তারা তাদের দু’জনের সংগে নাজ্জাশী ও তার দরবারের চাটুকার পাদ্রীদের জন্য প্রচুর মূল্যবান উপঢৌকন পাঠাল। তাদেরকে বলে দেওয়া হয়েছিল, হাবশার রাজার সাথে আমাদের বিষয়টি আলোচনার পূর্বেই প্রত্যেক পাদ্রীর জন্য নির্ধারিত হাদিয়া তাদের পৌঁছে দেবে।
তারা দু’জন হাবশায় পৌঁছে নাজ্জাশীর পাদ্রীদের সাথে মিলিত হল এবং তাদের প্রত্যেককে তার জন্য নির্ধারিত উপঢৌকন পৌছে দিয়ে বলল, ‘‘বাদশাহর সাম্রাজ্যে আমাদের কিছু বিভ্রান্ত সন্তান আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করেছে। আমরা যখন তাদের সম্পর্কে বাদশাহর সংগে কথা বলবো, আপনারা তাদের দ্বীন সম্পর্কে কোন রকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই তাদেরকে আমাদের নিকট ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাদশাহকে একটু অনুরোধ করবেন। কারণ, তাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দইতো তাদের বিশ্বাস ও আচরণ সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তারাই তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন।’’ দরবারী পাদ্রীরা তাদের কথায় সায় দিল। উম্মু সালামা বলেন, ‘বাদশাহ আমাদের কাউকে ডেকে তার কথা শুনুক, এর চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছু ’আমর ইবনুল আস ও তার সংগীর নিকট ছিলনা।’
তারা দু’জন নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে উপঢৌকন পেশ করল। উপঢৌকনগুলি নাজ্জাশীর খুবই পছন্দ হল। তিনি সেগুলির ভূয়সী প্রশংসা করলেন। অতঃপর তারা বাদশাহকে বললঃ ‘‘মহামান্য বাদশাহ, আমাদের কিছু দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে আপনার সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেছে। তারা এমন একটি ধর্ম আবিষ্কার করেছে যা আমরাও জানিনে এবং আপনিও জানেন না। তারা আমাদের দ্বীন পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু আপনাদের দ্বীনও গ্রহণ করেনি। তাদের পিতা, পিতৃব্য ও গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। তাদের সৃষ্ট অশান্তি ও বিপর্যয় সম্পর্কে তাদের গোত্রীয় নেতারাই অধিক জ্ঞাত।’’
নাজ্জাশী তাঁর দরবারে উপস্থিত পাদ্রীদের দিকে তাকালেন। তারা বললঃ ‘মহামান্য বাদশাহ, তারা সত্য কথাই বলেছে। কারণ তাদের গোত্রীয় নেতারাই তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। গোত্রীয় নেতাদের নিকট আপনি তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিন, যাতে গোত্রীয় নেতারা তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’ পাদ্রীদের কথায় বাদশাহ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হলেন। বললেনঃ ‘‘আল্লাহর কসম! তা হতে পারেনা। তাদের প্রতি যে অভিযোগ আরোপ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ না করা পর্যন্ত একজনকেও আমি সমর্পণ করব না। সত্যিই তারা যদি এমনই হয় যেমন এ দু’ব্যক্তি বলছে, তাহলে তাদেরকে সমর্পণ করব। তা না হলে তারা যতদিন আমার আশ্রয়ে থাকতে চায়, আমি তাদেরকে নিরাপত্তার সাথে থাকতে দেব।’’
উম্মু সালাম বলেনঃ ‘‘অতঃপর নাজ্জাশী আমাদেরকে ডেকে পাঠালেন তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য। যাওয়ার আগে আমরা সকলে একস্থানে সমবেত হলাম। আমরা অনুমান করলাম, নিশ্চয় বাদশাহ আমাদের নিকট আমাদের দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যা আমরা বিশ্বাস করি তা প্রকাশ করে দেব। আর সবার পক্ষ থেকে জা’ফর ইবন আবী তালিব কথা বলবেন। অন্য কেউ কোন কথা বলবে না।’’
উম্মু সালামা বলেনঃ অতঃপর নাজ্জাশীর নিকট গিয়ে দেখতে পেলাম, তিনি তাঁর সকল পাদ্রীদের ডেকেছেন। তারা তাদের বিশেষ অভিজাত পোশাক পরে সাথে ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ মেলে ধরে বাদশাহর ডান ও বাম দিকে বসে আছে। আমর ইবনুল আস ও আবদুল্লাহ ইবন আবী রাবীয়াকেও আমরা বাদশাহর নিকট দেখতে পেলাম। মজলিসে আমরা স্থির হয়ে বসার পর, নাজ্জাশী আমাদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সে কোন্ ধর্মমত- যা তোমরা নতুন আবিষ্কার করেছ এবং যার কারণে তোমরা তোমাদের খান্দানী ধর্মকেও পরিত্যাগ করেছ, অথচ আমার অথবা অন্যকোন ধর্মও গ্রহণ করনি?’
জা’ফর ইবন আবী তালিব সবার পক্ষ থেকে বললেনঃ ‘‘মহামান্য বাদশাহ! আমরা ছিলাম একটি মূর্খ জাতি। মূর্তির উপাসনা করতাম, মৃত জন্তু ভক্ষণ করতাম, অশ্লীল কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলাম, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতাম, এবং প্রতিবেশীর সাথে অসদ্ব্যবহার করতাম। আমাদের সবলরা দুর্বলদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করত। আমরা ছিলাম এমনি এক অবস্থায়। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা আমাদের নিকট একজন রাসূল পাঠালেন। আমরা তাঁর বংশ, সততা, আমানতদারী, পবিত্রতা ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত। তিনি আমাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানালেন, যেন আমরা তার একত্বে বিশ্বাস করি, তাঁর ইবাদত করি এবং আমরা ও আমাদের পূর্ব পুরুষরা যেসব গাছ, পাথর ও মূর্তির পূজা করতাম তা পরিত্যাগ করি।
তিনি আমাদের নির্দেশ দিলেন সত্য বলার, গচ্ছিত সম্পদ যথাযথ প্রত্যর্পণের, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখার, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করার, হারাম কাজ ও অবৈধ রক্তপাত থেকে বিরত থাকার। তাছাড়া অশ্লীল কাজ, মিথ্যা বলা, ইয়াতিমের সম্পদ ভক্ষণ ও নিষ্কলূষ চরিত্রের নারীর প্রতি অপবাদ দেয়া থেকে নিষেধ করলেন। তিনি আমাদের আরও আদেশ করেছেন এক আল্লাহর ইবাদত করার, তাঁর সাথে অন্য কিছু শরীক না করার, নামায কায়েম করার, যাকাত দানের এবং রমযান মাসে রোযা রাখার।
আমরা তাঁকে সত্যবাদী জেনে তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি এবং আল্লাহর কাছ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার অনুসরণ করেছি। সুতরাং যা তিনি আমাদের জন্য হালাল এবং হারাম ঘোষণা করেছেন, আমরা তা হালাল ও হারাম বলে বিশ্বাস করেছি।
মহামান্য বাদশাহ! অতঃপর আমাদের জাতির সকলেই আমাদের ওপর বাড়াবাড়ি আরম্ভ করল। তারা আমাদের দ্বীন থেকে পুনরায় মূর্তিপূজার দিকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের ওপর অত্যাচার চালাল। তারা যখন আমাদেরকে অত্যাচার উৎপীড়নে জর্জরিত করে তুলল এবং আমাদের ও আমাদের দ্বীনের মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল, তখন আমরা অন্য কোথাও না গিয়ে আপনার এখানেই আসাকেই প্রাধান্য দিলাম এই আশায় যে, আপনার এখানে আমরা অত্যাচারিত হব না।’’
উম্মু সালামা বলেনঃ অতঃপর নাজ্জাশী জা’ফর ইবন আবী তালিবের দিকে একটু তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের নবী আল্লাহর নিকট থেকে যা নিয়ে এসেছেন তার কিছু অংশ কি তোমাদের সংগে আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। ‘আমাকে একটু পাঠ করে শুনাও তো।’ জা’ফর (রা) পাঠ করলেনঃ ‘‘কাফ্-হা-ইয়া-আইন-সাদ। এ তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়ার প্রতি। যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করেছিল গোপনে। সে বলেছিল, ‘আমার অস্থি দুর্বল হয়েছে, বার্ধক্যে আমার মস্তক সাদা হয়েছে; হে আমার প্রতিপালক! তোমাকে আহ্বান করে আমি কখনও ব্যর্থকাম হইনি।’’
এভাবে তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা মরিয়মের প্রথম অংশ পাঠ করে শুনালেন।
আল্লাহর কালাম শুনে নাজ্জাশী এত কাঁদলেন যে অশ্রুধারায় তার শ্মশ্রু সিক্ত হয়ে গেল এবং দরবারে উপস্থিত পাদ্রীরা কেঁদে তাদের সম্মুখে উন্মুক্ত ধর্মগ্রন্থসমূহ ভিজিয়ে দিল। কিছুটা শান্ত হয়ে নাজ্জাশী বললেনঃ ‘তোমাদের নবী যা নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্বে ঈসা (আ) যা নিয়ে এসেছিলেন উভয়ের উৎস এক। অতঃপর আমর ও তার সংগীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা চলে যাও। আল্লাহর কসম! তোমাদের হাতে আমি তাদেরকে সমর্পণ করব না।’
উম্মু সালামা বলেনঃ আমরা নাজ্জাশীর দরবার থেকে বেরিয়ে এলে আমর ইবনুল আস আমাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার সংগীকে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আগামীকাল আবার আমরা বাদশাহর নিকট আসব এবং তাঁর নিকটে তাদের এমন সব কার্যকলাপ তুলে ধরব যাতে তাঁর হৃদয়ে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে এবং তাদের প্রতি ঘৃণায় তাঁর অন্তর পূর্ণ হয়ে যায়। তাদেরকে সম্পূর্ণ উৎখাত করার জন্য আমরা অবশ্যই বাদশাহকে উৎসাহিত করব।’
একথা শুনে তার সংগী আবদুল্লাহ ইবন আবী রাবীয়া বললঃ ‘আমর, এমনটি করা উচিত হবে না। ধর্মীয় ব্যাপারে আমাদের বিরোধিতা করলেও তারা তো আমাদের আত্মীয়।’ আমর বললঃ ‘তুমি রাখ তো এসব কথা। আমি অবশ্যই বাদশাহকে এমন সব কথা অবহিত করব যা তাদের অন্তরকে কাঁপিয়ে তুলবে। বাদশাহকে আমি বলবঃ তারা মনে করে ঈসা ইবন মরিয়ম অন্যদের মতই একজন বান্দা।’
পরদিন সত্যি সত্যিই আমর নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললঃ ‘মহামান্য বাদশাহ! এসব লোক, যাদেরকে আপনি আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করছেন, তারা ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে একটা মারাত্মক কথা বলে থাকে। আপনি তাদের কাছে লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখুন তারা তাঁর সম্পর্কে কি বলে।’
উম্মু সালামা বলেনঃ আমরা একথা জানতে পেয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় পড়লাম। আমরা পরস্পর পরস্পরকে জিজ্ঞেস করলামঃ ‘বাদশাহ যখন ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা তখন কি বলবে? ‘সবাই ঐকমত্যে পৌছলাম; তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ যা বলেছেন তার অতিরিক্ত আর কিছুই আমরা বলব না। আমাদের নবী তাঁর সম্পর্কে যা কিছু এনেছেন তা থেকে আমরা এক আংগুলের ডগা পরিমাণও বাড়িয়ে বলবনা। তাতে আমাদের ভাগ্যে যা থাকে তা-ই হবে।
আমাদের পক্ষ থেকে এবারও জা’ফর ইবন আবী তালিব কথা বলবেন। নাজ্জাশী আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমরা তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, পাদ্রীরা পূর্বের দিনের মত একই বেশভূষায় বসে আছে। আমর ইবনুল আস ও তার সংগী সেখানে উপস্থিত হতেই বাদশাহ আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে তোমরা কি বলে থাক?’
জা’ফর ইবন আবী তালিব বললেনঃ ‘আমাদের নবী তাঁর সম্পর্কে যা বলেন তার অতিরিক্ত আমরা কিছুই বলিনে।’
‘তিনি কি বলে থাকেন?’
‘তিনি বলেনঃ তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি তার রূহ ও কালাম- যা তিনি কুমারী ও পবিত্র মরিয়মের প্রতি নিক্ষেপ করেছেন।’
জা’ফরের কথা শুনে নাজ্জাশী হাত দ্বারা মাটিতে আঘাত করতে করতে বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম! ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে তোমাদের নবী যা বলেছেন তা একটি লোম পরিমাণও অতিরঞ্জন নয়।’ একথা শুনে নাজ্জাশীর আশেপাশে উপবিষ্ট পেট্রিয়ার্করা তাদের নাসিকাছিদ্র দিয়ে ঘৃণাসূচক শব্দ বের করল।
বাদশাহ বললেনঃ ‘তা তোমরা যতই ঘৃণা কর না কেন।’ তারপর তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ যাও, তোমরা স্বাধীন ও নিরাপদ। কেউ তোমাদের গালি দিলে বা কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তার বদলা নেওয়া হবে। আল্লাহর কসম! আমি সোনার পাহাড় লাভ করি, আর তার বিনিময়ে তোমাদের কারও ওপর সামান্য বিপদ আপতিত হোক- এটাও আমার পছন্দনীয় নয়। এরপর তিনি আমর ও তার সংগীর দিকে ফিরে বললেনঃ ‘এ দু’ব্যক্তির উপঢৌকন তাদেরকে ফেরত দাও। আমার সেগুলি প্রয়োজন নেই।’
উম্মু সালামা বলেনঃ এভাবে আমর ও তাঁর সংগীর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হল এবং তারা ভগ্ন হৃদয়ে পরাজিত ও হতাশ অবস্থায় দরবার থেকে বেয়ে গেল। আর আমরা উত্তম বাসগৃহে সম্মানিত প্রতিবেশীর মত নাজ্জাশীর নিকট বসবাস করতে লাগলাম।
আহ!! আজ আমরা সামান্য ভয়ে কুরআনের বানী লুকিয়ে রাখি অথচ সেদিন ছিল সাহাবীদের সর্বোচ্চ হারানোর ভয়।
সপ্তম হিজরীতে তাঁরা দু’জন এবং আরও কিছু মুসলমান হাবশা থেকে ইয়াসরিবের (মদীনা) দিকে রওয়ানা হলেন। তাঁরাও মদীনায় পৌঁছলেন, আর এদিকে রাসূল (সা) খাইবার বিজয় শেষ করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। রাসূল (সা) জা’ফরকে দেখে এত খুশী হলেন যে, তাঁর দু’চোখের মাঝখানে চুমু দিযে বললেনঃ ‘আমি জানিনে, খাইবার বিজয় আর জা’ফরের আগমণ- দু’টির কোনটির কারণে আমি বেশী খুশী।’
সাধারণভাবে সমগ্র মুসলিম সমাজ এবং বিশেষভাবে গরীব মুসলমানদের আনন্দ ও খুশী জা’ফরের আগমণে রাসূলুল্লাহর (সা) থেকে বিন্দুমাত্র কম ছিল না। কারণ জা’ফর ছিলেন গরীব-মিসকীনদের প্রতি ভীষণ দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। এ কারণে তাঁকে ডাকা হত আবূল মাসাকীন বা মিসকীনদের পিতা বলে।
মুতার যুদ্ধ উম্মাহর জন্য ভয়াবহ পরীক্ষা
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ ইবনে হারেছা (রা.) কে এই সেনাদলের সেনাপতি মনোনীত করেন। এরপর বলেন যে, যায়েদ যদি নিহত হন তবে জাফর এবং জাফর যদি নিহত হন, তবে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) হবে সেনাপতি।
মুতা নামক জায়গায় উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে অত্যন্ত তিক্ত লড়াই হয়। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিস্ময়কর ছিলো এ যুদ্ধ। দুনিয়ার মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। ঈমানের বাহাদুরি চলতে থাকলে এ ধরনের বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে।
সর্বপ্রথম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় পাত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রা.) পতাকা গ্রহণ করেন। অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি শাহাদাত করণ করেন। এ ধরনের বীরত্বের পরিচয় মুসলমান ব্যতীত অন্য কারো ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি। হযরত যায়েদ-এর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে নেন হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও তুলনাহীন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি নিজের সাদাকালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর আঘাত করতে থাকেন। শত্রুদের আঘাতে তাঁর ডানহাত কেটে গেলে তিনি বাঁ হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। বাঁ হাত কেটে গেলে দুই বাহু দিয়ে ইসলামের পতাকা বুকের সাথে জড়িয়ে রাখেন। শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত এভাবে পতাকা ধরে রাখেন।
সহীহ হাদীসে বর্নিত -আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
সেদিন (মূতার যুদ্ধের দিন) তিনি শাহাদাত প্রাপ্ত জা’ফার ইবনু আবূ ত্বলিব (রাঃ)-এর লাশের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। (তিনি বলেন) আমি জা’ফার (রাঃ)-এর দেহে তখন বর্শা ও তরবারীর পঞ্চাশটি আঘাতের চিহ্ন গুনেছি। তার মধ্যে কোনটাই তাঁর পশ্চাৎ দিকে ছিল না। [৪২৬১] (আ.প্র. ৩৯২৭, ই.ফা. ৩৯৩১)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪২৬০
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
জাফার ইবনু আবী ত্বালিব (রাযিঃ)-এর মর্যাদা
আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি (স্বপ্নে) জাফারকে জান্নাতের মধ্যে ফেরেশতাদের সঙ্গে উড়ে বেড়াতে দেখেছি।
সহীহঃ সহীহাহ (১২২৬), মিশকাত (৬১৬২)
তিরমিজি ৩৭৬৩
আবূ ঈসা বলেন, আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ)-এর বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে এ হাদীসটি গারীব। এ হাদীস আমরা শুধুমাত্র আবদুল্লাহ ইবনু জাফরের সনদে জানতে পেরেছি। ইয়াহইয়া ইবনু মুঈন প্রমুখ তাকে যঈফ বলেছেন। ’আবদুল্লাহ ইবনু জাফার হলেন ’আলী ইবনুল মাদীনীর বাবা। এ অনুচ্ছেদে ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) কর্তৃকও হাদীস বর্ণিত আছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ
জাফর (রা) অজীবন কুরআনের পথে অটল থাকেন। উম্মাহর জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ, প্রয়োজনে সত্যবাদী দাঈ আবার হক্বের পথে অটল মুজাহিদ হতেন। তার শাহাদাতের পর রসুল (সা:) তার পরিবারের সাথে দেখা করতে যান। ইবন ইসহাক আসমা বিন্ত মায়স (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন জা’ফর (রা) ও তাঁর সংগীরা শাহাদত বরণ করেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার ঘরে আসেন । আমি ইতোমধ্যে চল্লিশটি কাঁচা চামড়া পাকা করেছি, আটার খামীর তৈরী করেছি এবং আমার ছেলে মেয়েদের গোসল করিয়েছি। তেল দেই ও তাদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “জা’ফর (রা)-এর ছেলে মেয়েদেরকে আমার কাছে নিয়ে আস।” আমি তাদেরকে তাঁর কাছে নিয়ে আসলাম । তিনি তাদের ঘ্রাণ নিলেন তখন তাঁর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি আমার মা বাপ কুরবান হোন, আপনার . কাঁদার কারণ কী ? জা’ফর (রা) ও তাঁর সংগীদের কোন সংবাদ আপনার কাছে পৌঁছেছে নাকি ? ” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আজ তারা শাহাদত বরণ করেছে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর পরিবারের কাছে চলে গেলেন এবং বললেন, “জা’ফর (রা)-এর পরিবার-পরিজনের জন্যে খাদ্য তৈরী করতে তোমাদের যেন ভুল না হয়। কেননা, তারা তার ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ঈমাম আহমেদ)
আহ!! কতটা না ভালোবাসতেন রসুল (সা:) তার সাহাবী ও স্বজনদের। ঠিক এরকমই ছিল সাহাবীদের আদর্শ। যখন আল্লাহর পথে কুরবানী দেওয়ার প্রয়োজন হত – সবকিছুর উর্ধ্বে দ্বীন ও শাহাদাতকে প্রাধান্য দিতো। তারা জানতেন আল্লাহ ও তার রসুলুল্লাহর (সা:) দ্বীনের পথকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হয়। প্রতিটি জেহাদে প্রিয় সঙ্গীদের হারাতেন, শোক-কষ্টের মাঝে দ্বীনের পথে গাফেলতি করতেন না।
ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল দাওয়াত এবং দাওয়াতের পর নির্যাতন শুরু হওয়ায় হিজরত করতে হয়েছিল, যেখানে উম্মাহ একত্রিত হয়ে জেহাদ করেছিল আজও সেই পথেই হবে। যারা শুধু মিঠা ওয়াজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায় – তারা রাসুল (সা:) ও সাহাবীদের আত্মত্যাগ কি বুঝেছে!?
সুরা তওবায় বর্নিত হয়েছে –
“বলুন, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তার রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশী প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।”
সুরা তওবা-২৪