রমাদ্বান মাস শেষ হয়ে এলো, ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু রমাদ্বানের সবর, আত্মত্যাগ দানের শিক্ষা ঈদের সময় আমাদের মাঝ হতে হারিয়ে যায়। কেউ যাকাতের নামে লোক দেখানো আয়োজন করে আর অনেকে অতি ভূরিভোজনে ব্যস্ত অথচ হাজার ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কথা স্মরণ হয় না।
চিন্তা করুন- রমাদ্বানের ক্ষুধার্ত মুহূর্তগুলোর মত আশা ও কাতরে অপেক্ষায় ছিলেন কখন ইফতারের সময় আসবে। আর গরিব, ক্ষুধার্তদের সারাবছরই কাটে কখন একটু খাদ্য জোটবে। আমরা রসুল (সাঃ) ও সাহাবীদের সাথে জান্নাত চাই অথচ তাদের জীবনী জানি না তাদের জীবনী আমাদের ঠিক বিপরীত।
ঘটনা-১
ওতবা ইবনে ফারকাদ (রা.) বলেন, একবার আমি হযরত ওমর (রা.)-এর নিকট কয়েক টুকরা হালুয়া নিয়ে এলাম।
তিনি বললেন, এসব কি? আমি বললাম আপনার জন্য কিছু নাশতা এনেছি।
আপনি খুব সকালে কাজ শুরু করেন। আমি ভাবলাম এই হালুয়া আপনার জন্য শক্তির সহায়ক হবে। হযরত ওমর (রা.) পাত্র তুলে হালুয়া দেখে বললেন, হে ওতবা সত্যি করে বলতো, সকল মুসলমানকে এক টুকরা করে এই হালুয়া দিয়েছ কিনা। আমি বললাম হে আমীরুল মোমেনীন সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। হযরত ওমর (রা.) বললেন, এই খাবারের আমার কোন প্রয়োজন নাই।
একথা বলার পর তিনি একটি পাত্র টেনে নিলেন। সেই পাত্রে মোটা রুটি এবং শুকনো গোশত ছিল। তিনি পরম তৃপ্তির সাথে সেই খাবার খেতে লাগলেন। আমাকেও খেতে দিলেন। আমি খেতে বসলাম কিন্তু গোশত এতো শক্ত যে চিবাতে পারলাম না। তারপর এক পেয়ালা নাবিজ পান করলেন। নাবিজ এতো ঘন এতো বিস্বাদ ছিল যে, আমি খেতে পারলাম না। কিন্তু হযরত ওমর (রা.) পান করলেন।
তারপর আমাকে বললেন, হে ওতবা, প্রতিদিন আমি একটি উট জবাই করাই। সেই গোশতের ভালো অংশ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মুসলমানদের জন্য রাখা হয় আর ঘাড়ের শক্ত গোশত ওমরের পরিবারের লোকদের জন্য নেয়া হয়।
ওমর সেই মোটা গোশত খান এবং ঘন বিস্বাদ নাবিজ পান করেন। আমি বুঝতে পারি তোমরা আমার খাবার জিনিস অবহেলার চোখে দেখছো। কিন্তু শোনো যদি আমি ইচ্ছা করি তবে তোমাদের সকলের চেয়ে দামী এবং উন্নত খাবার খেতে পারি। ভূনা গোশ্ত, পাতলা নরম চাপাতি সম্পর্কে আমি যে জানি না তা নয়।
আমি সবই বুঝি। কিন্তু আল্লাহর একটি কথা আমি শুনেছি।
তিনি একটি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে তাদের লজ্জা দেয়ার জন্য বলেছেন, তোমরাতো পার্থিব জীবনে সুখ সম্ভার ভোগ করে শেষ করেছ কাজেই আজ তোমাদের দেয়া হবে অবমাননাকর শাস্তি।
চিন্তা করুন- যাদের জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল তবুও তারা খাদ্য গ্রহণে কতটা সর্তক ছিল!! দানের ক্ষেত্রে কতটা উদার ছিল! ঈদের দিন আপনি, আমি আয়েশী খাবার খাবো অথচ আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশী শিশু সন্তান নিয়ে দুঃখে লজ্জায় দিন কাটাবে!! আমরা মুসলিম জাতি, এক ভাই কষ্টে রইবে আর আমরা আনন্দ পাবো এটা নিষ্ঠুরতা!!!
ঘটনা-২
মদীনার ঈদগাহে কয়েকটি তাঁবু পেতে দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ী হিসাবে আগন্তুক এবং বিভিন্ন দেশের লোকেরা সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করছে। এক রাতে খলীফা আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)-সহ একটি তাঁবুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন । হঠাৎ তাঁবুর ভেতর থেকে শিশুর কান্না তাঁর কানে ভেসে এলো।
দয়ার্দচিত্ত ওমর (রা.) শিশুর মাকে সম্বোধন করে বললেন, শিশুকে সান্ত্বনা দাও মা, অমন কাঁদিও না। কিছুদূর যাওয়ার পরও তিনি শিশুর কান্না শুনতে পেলেন।
দ্বিতীয়বার এসে’
জননীকে একই ফরমায়েশ করলেন। খলীফা তৃতীয়বার ফরমায়েশ করতেই শিশুর জননী ক্ষেপে গিয়ে বলল, তুমি নিজের পথ দেখো তো বাপু, আমাকে জ্বালিয়ো না, তিনবার তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
:তুমি শিশুর কান্না বন্ধ করছ না কেন?
:কান্না বন্ধ হবে কি? আমি তো তাকে দুধ খেতে দিচ্ছি না।
:কেন দিচ্ছ না?
:খলীফা ওমর নির্দেশ দিয়েছেন দুগ্ধপোষ্য ভাতা দেয়া হবে না, সে অনুযায়ী এর ভাতা পেতে এখনও নিমাস দেরী। কিন্তু আমি এখন থেকেই এর নামে ভাতা বরাদ্দ করতে চাই। এ কারণেই দুধ খেতে না দেয়ায় শিশুর কান্না থামাতে পারছি না ।
: শিশুকে দুধ দাও, আল্লাহ্ সাহায্য করবেন।
পরদিন ওমর ফারুক (রা.) ফরমান জারী করে দিলেন যে, দুগ্ধ-পোষ্য শিশুরাও যথারীতি ভাতা পাবে। নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বে কোন শিশুকে দুধ পান করানো যেন বন্ধ করা না হয়।
আহ!! এখন সেসব শাসন কল্পনা করা যায় না। অনেক কাফের দেশ ইসলামের এই শিক্ষা গ্রহণ করে শিশুর ভাতার ব্যবস্হা করেছে। আর ইসলামের প্রাণকেন্দ্র সৌদী খাদ্য বিলীসিতায় মাতছে অথচ পাশ্ববর্তী দেশ ইয়েমেনের শিশুগুলো ক্ষুধায় মরছে।
ঘটনা -৩
মসজিদে নববীতে বিভিন্ন প্রদেশের কতিপয় গভর্নর হযরত ওমর (রা.)-এর আতিথ্য গ্রহণ করে আহার করছিলেন। হঠাৎ খলীফা লক্ষ্য করলেন একজন লোক বাম হাতে আহার করছেন। খলীফা মধ্য বয়স্ক লোকটিকে বিস্ময়ভরে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি জানালো যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সে ডান হাত হারিয়েছে। খলীফা দুঃখ প্রকাশ করে বললেনঃ “নাও ভাই, আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। উপস্থিত সবাই দেখল যে, একজন সাধারণ মুসলমানকে হযরত ওমর (রা.) খাবার মুখে তুলে দিয়ে আহার করাচ্ছেন।
ইয়েমেনের গভর্নর সা’দ ইবনে কয়েস (রা.)-ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খলীফা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কতো বেতন গ্রহণ করো?
:দু’হাজার দিরহাম।
:কি কাজে খরচ করো?
:নিজের পরিবারের জন্য খরচ করি, বাকিটা গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেই। খলীফাকে দেখা গেল যে, তিনি উটের একটা মোটা হাড় চুষে চিবিয়ে খাচ্ছেন। সা’দ (রাঃ) বললেন : আমিরুল মু’মিনীন, আপনার ভোজ্য দ্রব্য নরম হওয়া উচিত।
খলীফা বললেনঃ তুমি বলতে চাও আমি ভুনা গোশত এবং চাপাতি রুটি খেতে শুরু করব?
সা’দ বললেনঃ হ্যাঁ।
খলীফা বললেন: কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহ্কে কি করে মুখ দেখাব? তারপর তিনি গভর্নরদের উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রসঙ্গে বললেনঃ হে লোক সকল তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা আহার করার সময়ে যখন তোমাদের দুয়ারে ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে থেকে সাহায্য চায় তা কি তোমরা খেয়াল রাখো?
হযরত ওমর (রা.)-এর খাদ্য তালিকার মধ্যে ছিল অ-চালা আটার খসখসে রুটি রওগন এবং জয়তুন। পনির, গোশত, দুধ, ঘি এগুলো তিনি মাঝে মাঝে খেতেন। দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিলে তিনি যবের রুটি খেতেন। তিনি কাউকে দাওয়াত করলে খুব কম লোকই তাঁর আতিথ্যে খুশী হতো।
সামরিক ক্ষেত্রে কার্যরত সৈন্যদের ভাতা নির্ধারণের নিয়মানুযায়ী খলীফার জন্যও তাদের সমান অর্থাৎ বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম নির্ধারিত হয়।
আজ সারাবিশ্বে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর ক্ষমতাসীনদের ভাতা, আয়, সম্পদ দেখুন!! আর মুসলিম উম্মাহর অবস্থা তুলনা করুন!! আর সাধারণ কর্মচারীদের সাথে উচ্চস্তরের লোকদের আচরন ভাবুন!!
আপনার আমার চারপাশে ভিক্ষুক, পথশিশু, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সম্মানের সহিত অতিথি হিসেবে বরণ করুন।
অসহায়, মিসকীনদের ফেতরাহ, যাকাত, সদকা পৌছিয়ে দিন যেন আপনার আমার নিকটবর্তী ঘরগুলোতে ঈদের আনন্দ পৌঁছে যায়।
আল্লাহর কসম!! সাহাবীরা এজন্য শ্রেষ্ঠ ছিলেন তারা নিজেদের খুশি, সন্তুষ্টি নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি, খুশির জন্য দান করতেন। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের সুমহান মর্যাদা দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহানদাতা।