মুমিনদের ভালোবাসা ও শত্রুতা কোন নির্দিষ্ট সীমানা, ভূখন্ড ও জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে না। বরং মুমিনরা আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে আর আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে বাধাদানকারী ও জুলুমকারী প্রতিটি ব্যক্তির সাথে শত্রুতা করে।
কাউকে দাওয়াহ দিতে হবে, হয়তো কারো সাথে জেহাদ করতে হবে। তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র ও শত্রু রাষ্ট্রের নামে কোন দেশের জালেম, ইসলামী বিরোধী আইন ও শাসকের সাথে মিত্রতা মুমিনদের হতে পারে না।
বিশ্বের যে কোন দেশের মুমিনরা পরস্পর বন্ধু হবে আবার জালেমরা যেদেশেরই হোক মুমিনরা তাদের আপন ভাববে না যতক্ষণ না জুলুম ছেড়ে সত্য দ্বীন গ্রহণ করে। কিন্তু পশ্চিমাদের ধরিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক নীতিতে আমরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ভুলে গিয়ে দেশ হিসেব করে বন্ধুত্ব/শত্রুতা নির্ধারণ করি।
ক্ষমতাসীনরা এই ক্ষেত্রে দুটি মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করে- দেশপ্রেম ও মিথ্যা ধর্মীয় আবেগ। অথচ তারা যদি দেশ, জাতি, ধর্মকে সত্যি ভালোবাসতো তাহলে শরীয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতো। কারণ মানবকল্যাণের জন্য দ্বীন ইসলাম এসেছে।
ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার প্রাপ্তি/টিকিয়ে রাখার ঢাল হলো মানুষকে প্রকৃত দ্বীন সম্পর্কে বিমুখ করা, রাষ্ট্র হতে দ্বীনকে আলাদা করা। অল্প কিছু ইসলামী নিয়মনীতি করে জনগণকে ধোকা দেয় যে ধর্মীয় নিয়মনীতি পালনে এই রাষ্ট্রে কোন বাঁধা নেই। অথচ প্রকৃত ইসলাম যারা চায় তাদের উপর জুলুম নির্যাতন ঠিকই চলে। এক্ষেত্রে তারা দ্বীনের ইলমের বদলে মানুষকে তাদের রচিত ইতিহাসমুখী করি। তাই ক্ষমতা পতনের সাথে সাথে ইতিহাসের বদল ঘটে। নতুন ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা টিকাতে নতুন ইতিহাস ও বীর তৈরি করে।
জালেম কাফের (ভারত) শাসক আমাদের যেমন শত্রু তেমনি ইসলামী (পাক) আবেগ ব্যবহার করে ক্ষমতা নেওয়া ও জুলুমকারী শাসক ও শাসনব্যবস্থাও আমাদের শত্রু।
রসুলের (সা:) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও ইসলাম গ্রহণ করে আবু সুফিয়ান (রা), ইকরিমা (রা) সাহাবীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। তেমনি মুমিন পরিচয়ধারী যাকাত অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে সাহাবীরা যুদ্ধ করেছিলেন।
দেশপ্রেম ঈমানের অংশ এটা ক্ষমতাসীনদের তৈরি করা মিথ্যাচার। বরং যেখানে দেশপ্রেমের নামে অন্ধ চেতনা ছড়ানো হয়েছে সেখানে মানবিক অধিকার, মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে। জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শাসকরা এমন সিদ্ধান্ত নেয় যা অন্য দেশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর। নিজ দেশের সামান্য পানি বাড়লে বাঁধ ছেড়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের মানুষকে মরতে দেওয়া হয়। পশ্চিমারা নিজ দেশের সমৃদ্ধির জন্য আফ্রিকা, আরব, শামসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ছড়ায়।
নিজ দেশের কুকুর মারলে বিচার করা লোকগুলো নিজ দেশ বা অন্যদেশের মুসলিম/সংখ্যালঘুর উপর আঘাত আসলে নিরব থাকে। ক্ষমতাসীনরা এসব ক্ষেত্রে ধর্মীয়, দেশীয় আবেগ ও চেতনাকে ব্যবহার করে। অথচ ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে সকল মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে।
আল্লাহ বলেন-
তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে। (সুরা আল ইমরান -১১০)
ভারতীয় ক্ষমতাসীনরা এরকম একটা আবেগকে কাজে লাগায় ক্ষমতার জন্য যার নাম অখন্ড ভারত। কিন্তু অখন্ড ভারত বলতে তারা যে সীমানা বুঝায় – তা শুধুমাত্র সম্রাট আশোক (দাক্ষিণাত্য ব্যতীত), মোঘলদের কিছু সময় আর ইংরেজদের শাসনামলে এক শাসক বা রাষ্ট্রের অধীনে ছিল। বাকী সময় ভারতবর্ষ খন্ড খন্ড অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত ছিল। সুতরাং পুরা ভারতবর্ষ কখনো হিন্দু রাজ্য ছিল না আর হবেও না।
ভারত কি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বই মনুসংহিতা দিয়ে শাসন হয়? অথবা বর্তমানে কেউ চালু করলে কেউ কি তা মেনে নিবে? বরং বহু হিন্দুরা এর বিরোধিতা করবে জাত প্রথার কারণে। অথচ ভারতের সংবিধানের মুখ্য লেখক ভীমরাও তাদের ধর্মগ্রন্থ/রাষ্ট্রীয়নীতির বই মনুসংহিতার হাজার হাজার কপি পুড়িয়েছেন এবং সংবিধানে কখনো যাতে মনুসংহিতা নীতি অনুসরণ করা না হয় এমন আইনগুলো রচনা করেন। এজন্য তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়। আজও তার লেখা অধিকাংশ আইনে বিদ্যমান। ভারতীয়রা তার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
অপরদিকে ইসলামের নামে ক্ষমতা নিলেও পাকিস্তানের শাসকগণ, সেনারা অধিকাংশই ছিল শিয়া ইশনে আশারী। পশ্চিমাদের সমর্থন পেতে হিন্দু, কাদেয়ানীদের পদ দেওয়া হয় বরং ওদের নেতৃত্বে সংবিধান রচনা করা হয় কুরআনের সংবিধান বাদ দিয়ে। আর পাক-বাংলা কি কুরআন দ্বারা শাসিত হয়েছিল নাকি মানবরচিত আইন দ্বারা? ওরা ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণে অন্য দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে জীবন দিতে রাজি অথচ নিজ দেশে ইসলাম কায়েম করতে চায় না।
রসুল (সা:) মদীনায় প্রথম ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন পরে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই ও এসবদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। খন্দকের যুদ্ধের পর আল্লাহ স্বয়ং জিবরাইল (আ) কে পাঠান মদীনা রাষ্ট্রের প্রথমে বিশ্বাসঘাতক ইহুদিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এরপর মক্কা বিজয়, রুম ও পারস্য বিজয় হয়েছিল। আবু বকর (রা:) যাকাত অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন, সালাউদ্দিন আইয়ুবী (রহ:) এর সময় ঘরের শত্রু মুনাফেকদের প্রতিরোধ না করলে আকসা বিজয় সম্ভব হতো না।
ঠিক তেমনি খলিফা মাহাদীর (হাফি) বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই হবে সুফিয়ানীর মুনাফেকদের সাথে। এই বিজয়ের পর অন্য বিজয়ের পথ তৈরি হবে। সংখ্যালঘু ভাইয়েরা চিন্তা করুন – ভারতে প্রতিনিয়ত দাঙ্গা, রাজনীতি, সংঘর্ষে হামলায় কত হিন্দু মারা যায়। কেউ কি বলে ভারতে হিন্দুদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ? আর পাক-বাংলায় কত মুসলিম দাবিদার মারা যায়, কয়টা মিডিয়া বলে এসবদেশে মুসলিমদের জীবন সংকটাপন্ন? অথচ বাংলা-পাকে একজন সংখ্যালঘু মরলে তখন মিডিয়া প্রচার করে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়। ভারতের গুলিতে যত লোক মারা গেছে পাক-বাংলায় তার চেয়ে শতগুন মারা গেছে দেশীয় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার লোভে। বরং এসব ক্ষমতাসীনরা ধর্মীয়, দেশীয় আবেগকে হাতিয়ার করে নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে।
ভারত যত মুসলিমের বিরুদ্ধে জুলুম ও নির্যাতন করবে ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিরাপদ নয় ঘোষণা করবে বা সংখ্যালঘুর উপর আঘাত আসবে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা লোকগুলো জনপ্রিয় হবে, ভোট ও ক্ষমতা পাবে। যারা ওদের ফাদে পড়ে ভাবেন- ভারত আপনাদের রক্ষায় অনেক কিছু করবে তাহলে মিথ্যা স্বপ্ন দেখে নিজেদের বিপদ ডাকছেন। অপরদিকে পাকিস্তান-বাংলাদেশের শাসকরা যত ভারত বিদ্বেষ ছড়াবে ততই তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সুবিধা হবে। অথচ চীনের উইঘুর, মায়ানমারের মুসলিমদের উপর কি পরিমাণ জুলুম হয়েছে, হচ্ছে তাদের সাথে এরা পরমবন্ধুতা বজায় রাখে।
আল্লাহ বলেন-
ইয়াহূদী ও নাসারারা তোমার প্রতি রাজী হবে না যে পর্যন্ত না তুমি তাদের ধর্মের আদর্শ গ্রহণ কর। বল, ‘আল্লাহর দেখানো পথই প্রকৃত সুপথ এবং তুমি যদি জ্ঞান আসার পরেও এদের ইচ্ছে অনুযায়ী চল, তাহলে তোমার জন্য আল্লাহর ক্রোধ হতে রক্ষা করার মত কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না’। (সুরা বাকারাহ)
তাই যখনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অরাজকতা, হত্যার বিচার বিভিন্ন ইস্যুতে শাসকদের জনপ্রিয়তা কমে যায়। তখনি কেউ স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগায়। অথচ নিজরাষ্ট্র কুফরী আইন দ্বারা পরিচালিত করে। কেউ ইসলামের আইন প্রতিষ্ঠা করতে বললে উগ্রবাদী বলে। ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণ চাইলে আগে নিজ রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েম করতো।
আমাদের আবার ভারতের দালাল উপাধি না দিয়ে বাস্তবতা দেখুন- ইংরেজরা মীর জাফরদের ব্যবহার করে ক্ষমতা নেয় এরপর তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়। হালাকু খানরা আব্বাসীদের সাম্রাজ্য শেষ করে মুনাফেকদের ষড়যন্ত্রে। যারা আফগানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজ স্বার্থে শত্রুদের দুর্বল বা পরাজিত করতে সহায়তা করেছিল, পরাজয়ের পর তারাই উল্টো আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। মালহামার পূর্বে যখন তৃতীয় শক্তি পরাজিত হবে তখন চুক্তি ভেঙ্গে রুমরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসবে।
ফ্রান্স, বিট্রেনের কারণে পুরো আফ্রিকা গৃহযুদ্ধ ও ধ্বংসের মুখে। ভারত নিজ সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে সাহায্য করে, পরে আমরা পাকিস্তানের প্রভুত্ব শেষ হলে ভারত নতুন প্রভু হয়ে উঠে। তাই চীন বা অন্য কারো মদদে যদি যুদ্ধে জয়ী হয় তখন তারা নতুন প্রভু হয়ে উঠবে।
শাম, লেভান্তে ৩৪ টা পতাকাতলে যুদ্ধ চলছে। ঐক্যহারা জাতি ধ্বংসের মুখে। বনু উমাইয়া, বনু আব্বাসী, উসমানী, মোঘল সাম্রাজ্যের শক্তিশালী বাহিনী থাকা স্বত্বেও পতন হয়েছিল। তাদের বিলাসী জীবন ছিল খেলাফাহ রাশেদীনের বিপরীত। খেলাফায়ে রাশেদীনের যুগে শাসকদের জবাবদিহিতা করা যেত। মুসলিমরা ইসলাম, খলিফাকে ভালোবাসতো, তাই জেহাদ করতো দ্বীন রক্ষায় ও প্রতিষ্ঠায়। শাহাদাত ছিল তাদের আকাঙ্ক্ষা। তাই সংখ্যায় কম হলেও কাফেররা এসব ভূমি আক্রমণ করার সাহস পায়নি।
অপরদিকে রাজতন্ত্রের কর্মকর্তা, সৈনিকদের (বেতনভুক্ত)
মধ্যে অনেকেই ছিল বিলাসী। তারা টাকা ও ক্ষমতার জন্য লড়াই করতো। তাই অর্থ, দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য কখনও হালাকু খানের সাহায্যকারী, কখনও কামাল আতাতুর্ক ও মীর জাফরদের মত ক্ষমতালোভী দ্বারা বিশাল ক্ষতিসাধন হয়।
নিজদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে বুঝবেন- কারা ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণ চায়। আর ইসলাম কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ড, চেতনা ও শত্রুতা মানে না। মদীনার রাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা যেমন একত্রিত হয়েছিল তেমনি নিজদেশের মুনাফেক ও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল।
বাংলাদেশ, পাক-ভারতসহ প্রতিটি দেশের মুমিন আমাদের ভাই ও বন্ধু। আবার সব দেশের ইসলাম বিরোধীরা ও ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বাধাদানকারীরা আমাদের শত্রু! আর ইনশাআল্লাহ অখন্ড ভারত নয় বরং অখন্ড শান্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠা হবে ঈসা (আ:) ও খলিফা মাহাদীর (হাফি:) হাত ধরে।