রসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদের নিজ নাম ও পিতার নামে ডাকা হবে। সুতরাং তোমরা সুন্দর নাম রাখো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৩০০)।
তবে ইসলামে নাম রাখার কয়েকটি স্তর আছে। এক. ‘আবদুল্লাহ’ ও ‘আবদুর রহমান’—এ দুটি নাম রাখা সর্বোত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় নাম হলো আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৯৮)। ইসলামে নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর আল্লাহর কাছে যে নামগুলো প্রিয় সেইগুলা রাখাই উত্তম।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন – সন্তানের সুন্দর নাম রাখা ও তার উত্তম তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা বাবার উপর সন্তানের হক। -মুসনাদে বাযযার (আলবাহরুয যাখখার), হাদীস ৮৫৪০।
মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে আতা বলেন, আমি আমার মেয়ের নাম রাখলাম- বাররা (নেককার, ভালো মানুষ)। তখন যয়নব বিনতে আবি সালামা বললেন-
আমার নাম ছিল, বাররা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা ঘোষণা কোরো না। (কারণ, বাররা অর্থ, ভালো, নেককার, পূত-পবিত্র) আল্লাহই জানেন তোমাদের মধ্যে ভালো ও পূত-পবিত্র কারা। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে আমরা তার কী নাম রাখতে পারি? তখন নবীজী বললেন, তার নাম যয়নাব রাখ। (নবীজীর আদেশে তখন বাররা নাম পরিবর্তন করে তার নাম যয়নাব রাখা হল।) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৪২
অনেক আলেম মত প্রকাশ করেন – বাররা বা পবিত্র হল উপাধি যা আল্লাহর তরফ হতে ঘোষিত হবে। তাই সিদ্দিক, ফারুক, গনী এগুলোও আল্লাহর তরফ হতে সাহাবীদের উপাধি দান করা হয়েছে। এই নাম রাখার ব্যাপারে কিছু আলেমরা আপত্তি প্রকাশ করেন।
যয়নাব হচ্ছে উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা.-এর মেয়ে। আবু সালামার ইন্তেকালের পর উম্মে সালামা রা. নবীজীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এজন্য উম্মে সালামা রা.-এর সন্তানগণ নবীজীর কাছে থেকে তারবিয়াত লাভের সৌভাগ্যে ধন্য হন। যয়নাব রা. ছিলেন অনেক বুদ্ধিমতী এবং নেককার নারী। হাদীসের কিতাবে তার থেকে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে। যয়নাবের পাশাপাশি তার ভাই ওমর ইবনে আবী সালামাও নবীজীর তারবিয়াত লাভে ধন্য হন।
যয়নাব বিনতে আবী সালামার মত উম্মুল মুমিনীন হযরত জুওয়াইরিয়া রা.-এর নামও ছিল বাররা। এ নাম পরিবর্তন করে নবীজী (সাঃ) তার নাম রাখেন জুওয়াইরিয়া।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, জুওয়াইরিয়া রা.-এর নাম ছিল বাররা। নবীজী(সাঃ) তার নাম পরিবর্তন করে জুওয়াইরিয়া রাখেন (জুওয়াইরিয়া অর্থ ছোট্ট বালিকা)। কেউ যদি বলত- “বাররা এর কাছ থেকে বের হয়েছে” তাহলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা অপছন্দ করতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৪০
এ রেওয়ায়েতে নাম পরিবর্তন করার অন্য একটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তা হল, “বাররা-এর কাছ থেকে এ বের হয়ে এসেছে”- নবীজী এ বাক্যটিকে নেকফালির বিপরীতে মনে করতেন। কারণ, বাররা অর্থ নেক, ভালো। সুতরাং বাররা (নেক)-এর কাছ থেকে বের হওয়া কেমন যেন ভালো কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নামান্তর। তাই এমন নাম রাখা উচিত নয়, যার কারণে এরূপ নেতিবাচক বাক্য ব্যবহার করতে হয়।
নেকফালির (শুভ লক্ষণ গ্রহণের) সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার দরুন অন্য আরো কিছু নামও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করেছেন।
আমাদের দেশে অনেকের নাম রাখে শহীদ, গাজী অথচ ইসলামের জন্য জেহাদে কেউ জীবন দিলে শহীদ বা বিজয়ী হয়ে ফিরলে গাজী উপাধি হয়।
হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সন্তানের নাম ইয়াসার, রাবাহ, নাজীহ, আফলাহ রেখো না। কারণ তুমি জিজ্ঞেস করবে সে কি ঘরে আছে? অনুপস্থিত থাকলে উত্তর দেয়া হবে- না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫৮
এ হাদীসের ব্যাখ্যা হল, ইয়াসার অর্থ-সহজ, সুখ ও প্রাচুর্য। রাবাহ-অর্থ উপকার, লাভ। নাজিহ অর্থ সফল। আর যে ব্যক্তি সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তাকে বলা হয় আফলাহ। তো কোনো ব্যক্তির নাম যদি এ চারটি থেকে কোনো একটি রাখা হয়, আর কেউ জানতে চাইল- ঘরে কি ইয়াসার আছে? বা রাবাহ, নাজিহ অথবা আফলাহ আছে? উত্তর দেয়া হল- না, নেই। তো যেন ঘরে সুখ, প্রাচুর্য ও কল্যাণের উপস্থিতিকে অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, ঘরে কল্যাণ নেই, সুখ ও প্রাচুর্য নেই। এজন্যই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের নাম অপছন্দ করতেন।
কিছু নাম অপছন্দনীয় হওয়ার কারণ
অহংকার ও নিজের বড়ত্বের দিকে ইঙ্গিত থাকায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু কিছু নাম অপছন্দ করতেন।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হবে ঐ ব্যক্তির নাম, যে মালিকুল আমলাক (রাজাধিরাজ) নাম ধারণ করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪০৩।
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় আছে, কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার অনেক বেশি গোস্বার পাত্র হবে, যাকে মালিকুল আমলাক (বাদশাহদের বাদশাহ) নামে ডাকা হত। আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত বাদশাহ আর কেউ নেই।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৪৩
অথচ অনেকে নাম রাখেন শাহানশাহ, আবার কেউ কেউ রাজা, বাদশাহ রাখেন অথচ ইসলামে রাজা, বাদশাহী জায়েজ নয়। আলেমদের অভিমত, শাহজাহান, আলমগীর, জাহাঙ্গীর, শাহ আলম ইত্যাদি নাম রাখা উচিত নয়। নবীরা ছিল আল্লাহর মননোনীত খলিফা বা প্রতিনিধি তারা আল্লাহর আইন দ্বারা রাষ্ট্র চালাতেন।
আয়েশা রা. বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্দ ও অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিতেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৩৯
রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকট একবার এক ব্যক্তির আলোচনা উঠলো, যাকে শিহাব নামে ডাকা হতো। রাসূলুল্লাহ সাঃ শুনে বললেন, না বরং তুমি হেশাম। (আল-আদাবুল-মুফরাদ, ইমাম বোখারী-পৃষ্টা:৪৪৪, হাদীস নংঃ ৮২৫)।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত নাম গুলোও পরিবর্তন করে দিয়েছেনঃ আছ (অবাধ্য), উতলাহ (রূঢ়), শয়তান, শিহাব (উল্কাপিন্ড)। -মিশকাত শরীফ
অথচ অনেকে এখন ফেইসবুক আইডিতে নাম দেয় – Evil bone, devil, শয়তানের সাথে সম্পর্কিত এসকল অভিশপ্ত নামগুলো। অথচ শয়তান আল্লাহর শত্রু ও অভিশপ্ত আর আল্লাহর বান্দা হয়ে তার শত্রুর সাথে নাম মিল রেখে আল্লাহর শত্রুতে পরিনত হচ্ছেন না তো??
আরবি ভাষায় শয়তান মানে সীমা লঙ্ঘনকারী, দাম্ভিক ও স্বৈরাচারী। এই বৈশিষ্ট্যের জিন ও মানুষ উভয়ের জন্যই শয়তান পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। কোরআন মজিদে উভয়ের জন্য শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন—সুরা বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতে ইসলামের বিরুদ্ধাচারী নেতাদের শয়তান বলা হয়েছে। ‘শয়তান’ শব্দের বহুবচন ‘শায়াত্বিন’। পবিত্র কোরআনে শয়তান শব্দ একবচন ও বহুবচনে ৮৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। কোরআনে শয়তানকে ইবলিসও বলা হয়েছে। আরবি ‘বালাসুন’ ও ‘ইবলাসুন’ শব্দমূল থেকে ইবলিস শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো, বিস্মিত হওয়া, আতঙ্কে নিথর হয়ে যাওয়া, দুঃখে ও শোকে মনমরা হয়ে যাওয়া এবং সব দিক থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া। শয়তানকে ইবলিস বলার কারণ হলো, হতাশা ও নিরাশার ফলে তার অহমিকা প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সব ধরনের অপরাধ সংঘটনে উদ্ধত হয়। কোরআন মজিদে ইবলিস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১১ বার।