দানের প্রশংসা ও বিড়ম্বনা (উম্মাহর সমস্যার সমাধান ও মুক্তি যে পথে)

আলী বানাত নামটা শুনলে তার জীবন ইতিহাস মনে পড়ে আর দুচোখে অশ্রু ভরে যায়। বানাত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে বসবাসকারী একজন প্রয়াত মুসলিম ধনকুবের, যুব উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী, যিনি প্রায় তিন বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে ২০১৮ এর ২৯ মে মাত্র ৩২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ক্যান্সার ধরা পড়ার আগে তিনি তার স্ত্রী এবং পরিবার নিয়ে সিডনীতে বসবাস করতেন। ২০১৫ সালে প্রথম তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল। ডাক্তার তার জীবনের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন মাত্র ৭ মাস। তবে তিনি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে বেঁচে ছিলেন ৩ বছর।

কিন্তু এই ৩ বছরে তিনি এমন কিছু করে গেছেন যা তাঁকে আরো শত শত বছর পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মুসলিমদেকে সাহায্য করার লক্ষ্যে তাঁর সমস্ত অর্থ-সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন।

তাঁকে যখন জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, তিনি কেন ক্যান্সারকে আল্লাহর উপহার হিসেবে দেখছেন, আলী অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, “ক্যান্সার আমাকে পরিবর্তিত হবার সুযোগ দিয়েছে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। ক্যান্সার না হলে হয়ত আমি জীবনটাকে ভিন্নভাবে দেখতে পারতাম না। এমনকি আরো ভুল পথে এগিয়ে যেতাম।”

২০১৫ সালে, তার শরীরে ক্যান্সার শনাক্ত হবার বছরই, তিনি বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত মুসলিমদের সাহায্যার্থে ‘মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (এমএটিডব্লিউ)’ নামক একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। আলী বানাতের মৃত্যুর পর থেকে এখন পর্যন্ত, এই দাতব্য সংস্থা প্রায় ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ডোনেশন সংগ্রহ করেছে এবং প্রতি মুহূর্তেই এই ডোনেশনের পরিমাণ বাড়ছেই।

Ali Banat in Africa MATW Project

আফ্রিকায় মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড প্রজেক্টে আলী বানাত মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড সংস্থাটির মাধ্যমে আফ্রিকা, টোগো, বুরকিনা ফাসো সহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশের হাজার হাজার দুস্থ মানুষের জন্য মানবসেবা করে গিয়েছেন। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে গরীব-দুঃখীদের জন্য কাজ করেছেন, এবং তার সংস্থায় দান করার জন্য দাতা খুঁজেছেন। এর পাশাপাশি তাঁর দান করা অর্থ যেন সংস্থার প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত না হয় সেটি নিশ্চিত করেছেন। বর্তমানে এই দাতব্য সংস্থাটি আফ্রিকায় ২০০ জন বিধবা এবং ৬০০ এতিম বাচ্চার পুনর্বাসনের জন্য একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা এবং তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। অনুদান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে হাসপাতাল এবং স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা স্থাপন করা হচ্ছে।

আলী বানাত যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনি সশরীরে থেকে এবং নিজের মাধ্যমে মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ‘গো ফান্ড মি’ নামক একটি অনুদান সংগ্রাহক সংস্থা এই কাজগুলো অব্যাহত রেখেছে। আলীর রেখে যাওয়া তিনটি প্রজেক্টের জন্য ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান সংগ্রহের লক্ষ্যে তারা তিন-চতুর্থাংশ অনুদান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রতিদিন নতুন নতুন অনুদান জমা পড়ছে। ইতোমধ্যে আফ্রিকায় বিধবা এবং এতিমদের জন্য একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেখানে স্কুল, হাসপাতাল এবং মসজিদ নির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।

আলী বানাত যে সদকা করে গেছেন ও যে পথ দেখিয়ে গেছেন – সেই পথ ধরে হাজারও মানুষ চলবে, অনুপ্রেরণা জাগাবে। আজও বিশ্বের বহুদেশের লেকচার, খুতবা, ইউটিউব বক্তারা তার দানের উদার প্রশংসা করে মসজিদ, মাদ্রাসা ও যাকাতে দানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। আলী বানাতের বদৌলতে বহু মসজিদ গেড়ে উঠছে, বহু দরিদ্র্যের মুখে হাসি ফুটেছে।

অপরদিকে, ধরুন বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, যিনি আলী বানাতের চেয়ে অনেকবেশি সম্পদের মালিক। যিনি তরুন ও সুস্থ, নিজের জীবন, সম্পদ উম্মাহর কল্যানে উৎসর্গ করেছেন কুরআন এই আয়াতের অনুসরণ করে-

“তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের (উদ্ধারের) জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! অত্যাচারী অধিবাসীদের এই নগর হতে আমাদেরকে বাহির করে অন্যত্র নিয়ে যাও এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের সহায় নিযুক্ত কর।”

সুরা নিসা

তার জীবনের সমস্ত সম্পদ, নিরাপদ আশ্রয়, প্রিয়জন ত্যাগ করে অসহায়, মজলুম মুসলিমদের সাহায্যে সারাজীবন ময়দানে কাটিয়ে দিলেন। তার জীবনী হাজারো যুবক, মুসলিমকে আকৃষ্ট করলো। তার দাওয়াত, দান, আত্মত্যাগের বদলে হাজারও মুজাহিদ তৈরি হল যারা যুগ যুগ ধরে জেহাদের পথে অবিচল থাকবে ইনশাআল্লাহ!!

ধরুন জালেমরা তাকে শহীদ করলো হাজার মসজিদ, আলেমরা তার প্রশংসা করা স্বাভাবিক!! কিন্তু না যেসব মিডিয়া, মসজিদের মিম্বার, আলেমরা আলী বানাতের দানের উদার প্রশংসা করেছে তারাই প্রিয় শহীদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছে!! তাকে উগ্রবাদী, পথভ্রষ্ট ঘোষণা করে অন্যদের সতর্ক করা হচ্ছে – কেউ যেন এরকম ভুলপথে না হাটে।

প্রতিবেশী, অভিভাবক, প্রশাসনকে সতর্ক করা হচ্ছে কারো মধ্যে নির্দিষ্ট এরূপ আকীদা, আচরন বিদ্যমান থাকলে ওরা হলো অমুক খারেজী, উগ্রবাদী, পথভ্রষ্ট, ইহুদি খ্রিস্টানের দালালের অনুসারী!! অথচ সাহাবীদের জীবনী দেখুন- তারা জেহাদ, মুজাহিদদের কল্যানে সবচেয়ে বেশি দান করে আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়েছিলেন। তাদের মসজিদ পাকা দালান ছিল না, কিন্তু তাদের ঈমান পরিপক্ক ছিল। কেউ তাদের মসজিদ ভেঙ্গে ফেলবে, নারী-শিশুদের উপর নির্যাতন করবে তা ভাবা যেত!? তখন বুঝে নিবেন- প্রকৃত ইসলাম অপরিচিত হয়ে গেছে, একশ্রেণির মানুষ শুধু চায় আমাদের ইসলাম ও দান মসজিদের নির্দিষ্ট খাতে হোক যাতে নেতৃত্ব ও প্রশংসা তাদের মিলে!!

আলী বানাতের দান মসজিদ, দ্বীনের প্রচার, প্রসার, দারিদ্র্যদের মুখে হাসি ফুটেয়িছিল। অপরদিকে প্রিয় শহীদ ভাই নিজের সবকিছু উৎসর্গ করেছেন। মসজিদ, মুসলিমদের রক্ষায় তার দান ও জেহাদ যেসব নিয়মনীতি (এসব নীতির ধারক ও পরিচালক) গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল যেন মুসলিমরা চিরন্তন দাসত্ব হতে মুক্তি পায় ও দারিদ্র্যতার শেকল থেকে বের হয়!! শুধু এক আল্লাহর ভয়, ইবাদত ছাড়া কোন জালেমের ভয় থাকবে না, তাগুতের ইবাদত চলবে না এমন এক ভূখন্ডের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন!!

কারন তিনি বুঝেছিলেন মুসলিমরা মসজিদ, মাদ্রাসা যদি স্বর্ন দিয়েও তৈরি করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও মুজাহিদ না থাকে ইসলাম বিরোধিরা তা ভেঙ্গে ফেলবে!! তিনি বুঝেছিলেন – এই পথে শাহাদাত আসলে তার স্বজাতি তার নিন্দা, বিরোধিতা করবে তবু আল্লাহকে ভালোবেসে কোনকিছুকে পরোয়া না করে শাহাদাত বরন করেছেন, কুরআনের আয়াতের অনুসরণে। আল্লাহ বলেন –

“হে ঈমানদার গণ! তোমাদের মধ্যে হতে যে ব্যক্তি স্বীয় ধর্ম হইতে ফিরে যায়, তবে (ইসলামের কোন ক্ষতি নাই। (কেননা) আল্লাহ তা’আলা সত্বরই (তাদের স্থলে) এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবে, তারা মুসলমানের প্রতি মেহেরবান থাকবে, কাফেদের প্রতি কঠোর হবে, তারা জেহাদ করবে আল্লাহর পথে, আর তারা কোন নিন্দুকের নিন্দায় পরোয়া করবে না। ইহা আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা প্রদান করেন। বস্তুতঃ আল্লাহ তা’আলা সুপ্রশান্ত, মহাজ্ঞানী।”

সুরা মায়েদাহ

এখন সিদ্ধান্ত আপনার কার জীবনী আপনার কাছে সবচেয়ে উত্তম লাগবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *