জিন ও শয়তান পর্ব-১ (শয়তানের পরিচয় ও জাদু)

● হযরত ইবনে দুরাইদ (রহঃ) বলেছেনঃ ‘জ্বিনজাতি মানুষদের থেকে আলাদা এক সৃষ্টি। জ্বিন শব্দের (মোটামুটি) অর্থ গুপ্ত, অদৃশ্য, লুক্কায়িত, আবৃত প্রভৃতি। জ্বিন্নাহ্, জ্বিন ও জ্বান বলতে একই জিনিস বোঝালেও ‘জ্বিন’ হলো জ্বিন্নাত বা জ্বিনজাতির এক বিশেষ প্রজাতি।

● হযরত ইবনে আকীল হাম্বালী (রহঃ) বলেছেনঃ লুকিয়ে থাকা ও চোখের আড়ালে থাকার কারণে জ্বিনকে জ্বিন বলা হয়। আল্লামা ইবনে আকীল বলেছেনঃ শয়তানরা হলো এক শ্রেণীর জ্বিন যারা আল্লাহর অবাধ্য এবং এরা (অভিশপ্ত) ইবলীসের বংশধরদের অন্তর্গত।

হাফিয ইবনে আবদুল বার বলেছেনঃ ভাষাবিশারদদের মতে, জ্বিনদের কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। যেমনঃ
১. জ্বিন : অর্থাৎ সাধারণ জ্বিন
২. ক্বারিন : মানুষের সাথে থাকে
৩. আওয়াহ্ঃ সামনে আসে
৪. শয়তানঃ উদ্ধৃত, অবাধ্য
৫. ইফ্রীত্বঃ শয়তানের চাইতেও বিপজ্জনক।

● হযরত রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ (সালাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে) কালো কুকুর গেলে সালাত ভেঙে যায়। (সাহাবীদের তরফ থেকে) তাঁকে নিবেদন করা হলোঃ লাল ও সাদার তুলনায় কালো কুকুরের অপরাধ কী, জনাব? তিনি বললেনঃ – কালো কুকুর হলো শয়তান। (সহীহ আবুদাউদ)।

তার মানে এই নয় সব কালো কুকুর শয়তান বরং সালাতে ব্যাঘাত ঘটনার জন্য জ্বিন শয়তান কালো কুকুরের ছদ্মবেশ নিয়ে আসে। জ্বিনরা বহুরূপী হতে পারে এবং মানুষ, চতুষ্পদ পশু, সাপ, বিচ্ছু, উট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, খচ্চর, গাধা এবং বিভিন্ন পশুপাখি প্রভৃতির আকার-আকৃতি ধারণ করতে পারে।

● হযরত আলকামাহ (রহঃ) বলেছেনঃ আমি হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে নিবেদন করি, আপনাদের মধ্যে কেউ ‘লাইলাতুল জ্বিন’ (অর্থাৎ জ্বিনের রাত)-এ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে ছিলেন কি?’ তো উনি বললেনঃ “আমাদের মধ্যে কেউ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন না। কিন্তু এক রাতে আমরা তাঁকে মক্কায় অনুপস্থিত পেলাম। আমরা বললাম, (হয়তো) তিনি আচমকা (কাফিরদের হাতে) ধরা পড়েছেন এবং তাঁকে গুম করে ফেলা হয়েছে। আমাদের মুসলমান সম্প্রদায়ের ওই রাতটা কাটল খুবই খারাপ অবস্থায়। যখন সকাল হলো, দেখা গেল, তিনি হিরা পর্বতের দিক থেকে আগমন করছেন। তারপর আমরা (সাহবীগণ) গত রাতের উদ্বেগের কথা তাঁকে জানালাম। তিনি বললেনঃ
একটি জ্বিন এসে আমাকে দাওয়াত দিয়েছে, সুতরাং আমি তার সাথে চলে গিয়েছি এবং তাদেরকে পবিত্র কোরআন পড়ে শুনিয়েছি। এরপর তিনি (নবীজী) (সাঃ) আমাদের নিয়ে গেলেন। জ্বিনদের নিদর্শন দেখালেন। ওদের আগুনের চিহ্ন দেখালেন। ওই জ্বিনরা তাঁর কাছে সফরের সামান (বা পাথেয়) চেয়েছিল, কেননা ওরা ছিল (বহুদূরের) কোনও দ্বীপের জ্বিন। তো প্রিয় নবীজী (সাঃ) বলেনঃ
তোমাদের খাদ্য এমন সব হাড়, যার প্রতি আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে। (অর্থাৎ আল্লাহর নাম নিয়ে বা বিস্‌মিল্লাহ বলে যবাহ্ করা পশুর হাড় জ্বিনরা খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করবে।)
…… এবং সর্বপ্রকার গোবর হলো তোমাদের চতুষ্পদদের খাবার। (মুসলিম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ তিরমিযী শরীফে আছে, জ্বিনদের খাদ্য সেই পশুর হাড়, যে পশু যবাহ্ করার সময় বিসমিল্লাহ্ বলা হয় না। সুতরাং মুসলিম ও তিরমিযীর হাদীসদ্বয়ের মধ্যে সমতা হবে এভাবে যে মুসলিম শরীফের (উপরে বর্ণিত) হাদীসে মুসলমান জ্বিনদের খাবার এবং তিরমিযী শরীফের হাদীসে কাফির জ্বিনদের খাবারের কথা বলা হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
তোমরা এই দু’টো জিনিস (হাড় ও গোবর) দিয়ে এসতেজা করো না, কেননা এ দু’টো হলো তোমাদের জ্বিন ভাইদের খোরাক।  আল্লামা সুহাইলী বলেছেন: উপরে বর্ণিত উক্তি (অর্থাৎ হাড় ও গোবর জ্বিনদের খাবার) সহীহ্ হাদীসে এর সমর্থন আছে।

হাদীসগুলো হতে বুঝা যায় – জ্বিনদের খাদ্যের প্রয়োজন আছে। তাই আলাউদ্দিনের চেরাগ কাহিনিগুলো আজগুবি গল্প ছাড়া কিছু নয়, কারণ খাদ্যের অভাবে জ্বিন হয়তো মারা যেত অথচ আমাদের দেশে অনেকে দাবি করে তারা জ্বিনকে বোতলবন্দী করে রাখতে পারে- অথচ রাসুল (সাঃ), সাহাবী দ্বারা এমন কোন নজির নেই বরং কুরআনের সুরা তেলাওয়াত করলে খারাপ জ্বিন পালায়।

মানুষের সাথে খাওয়ায় অংশগ্রহণ

● হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেছেন : রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে যখন আমরা কোনও খানার মজলিসে হাজির থাকতাম তখন তিনি শুরু না করা পর্যন্ত আমরা কেউ-ই খাবারে হাত দিতাম না। একবারের ঘটনা। আমরা (নবীজীর সঙ্গে) খাওয়ার মজলিসে হাযির আছি। এমন সময় এক বেদুঈন এল। যেন তাকে কেউ খাবারের দিকে তাড়িয়ে এনেছে। সে এসেই খাবারের দিকে হাত বাড়াল। নবীজী তার হাত ধরে ফেললেন এবং তাকে বসিয়ে দিলেন।
তারপর একটি মেয়ে (বালিকা) এল, তাকেও যেন হাঁকিয়ে আনা হলো। মেয়েটি এসে খাবারের পাত্রে হাত দিতে উদ্যত হলো। নবীজী তারও হাত ধরে ফেললেন। তারপর তিনি বললেনঃ
যে খাবারে আল্লাহর নাম নেওয়া (অর্থাৎ বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করা) হয় না, শয়তান তা নিজের জন্য হালাল করে নেয় (মানে, শয়তান সেই খাবরে শরীক হয়ে যায়)। (আমরা খাওয়া শুরু করিনি দেখে) শয়তান এই বেদুঈনের সাথে খেতে এসেছিল। আমি তার হাত ধরে ফেললাম। (ফলে শয়তান সুযোগ পেল না।) তাই সে ফের এই মেয়েটির সাথে এল এবং এর মাধ্যমে খাবারে ভাগ বসাতে চাইলে। এর হাতও আমি ধরে ফেললাম। যাঁর আয়ত্বে আমার জীবন সেই সত্তা (আল্লাহ্)-র কসম! এই দু’জনের হাতের সাথে শয়তানের হাতও (এখন) আমার মুঠোর মধ্যে।

● হযরত উমাইয়া বিন মুখ্শী (রাঃ) বলেছেনঃ একবার রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপস্থিতিতে এক ব্যক্তি খানা খাচ্ছিল। (খাওয়ার শুরুতে) সে বিস্‌মিল্লাহ্ বলেনি। শেষ পর্যন্ত সে সবই খেয়ে ফেলল, কেবলমাত্র একটি লোকমা (বা গ্রাস) বাকি ছিল । সেই শেষ গ্রাসটি মুখে তোলার সময় সে বললঃ
“বিসমিল্লাহি আউওয়ালাহু অ আ-খিরাহু”
ভাবার্থ: এই খাবারের আগে ও পরে আল্লাহর নাম নেওয়া হলো। তখন নবীজী (সাঃ) হেসে ফেললেন এবং বললেনঃ
শয়তান ওর সাথে খাবারে শরীক ছিল, কিন্তু যখনই ও আল্লাহর নাম নিয়েছে, অমনই শয়তান যা কিছু তার পেটে গিয়েছিল সব বমি করে দিয়েছে। (মুসলিম- কিতাবুল আশরিবাহ,সুনানে আবুদাউদ, মুসনাদে আহমেদ)

যখন কোনও মানুষ নিজের বাড়িতে প্রবেশ করার সময় এবং খাওয়ার সময় ‘বিস্‌মিল্লাহ্’ বলে, তখন শয়তান (অন্যান্য শয়তানের উদ্দেশে) বলে, তোমাদের জন্য (এখানে) থাকা-খাওয়ার কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু কোনও মানুষ বাড়িতে প্রবেশের সময় যদি আল্লাহর নাম না নেয়, তাহলে শয়তান বলে, তোমরা রাতে থাকার ও সাঁঝে খাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলে। (আবুদাউদ – কিতাবুল আতইমাহ, মুসনাদে আহমদ)

বিশেষত নোংরা ও অন্যান্য স্থানে বসবাস

● হযরত যাঈদ বিন্ আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
এই নোংরা জায়গাগুলো জ্বিন ও শয়তানদের থাকার জায়গা। অতএব তোমাদের মধ্যে কেউ যখন প্রস্রাব-পায়খানায় যায়, সে যেন (এই দু’আ) বলে- আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল খুবুসি অল্ খাবায়িস।- হে আল্লাহ্, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুষ্ট পুরুষ জ্বিন ও দুষ্ট নারী জ্বিনের অনিষ্ট থেকে। প্রস্রাব-পায়খানায় যাবার সময় কোনও ব্যক্তি এই দু’আটি পড়লে তার ও জ্বিনদের মধ্যে আড়াল স্থাপিত হয়, ফলে জ্বিনরা তার লজ্জাস্থান বা নগ্ন অবস্থা দেখতে পায় না।

● হযরত আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেনঃ
এই নোংরা জায়গাগুলো শয়তানদের থাকার জায়গা, সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ যখন পায়খানায় যাবে, সে যেন ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে।

● হযরত আলী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, জনাব রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
তোমাদের মধ্যে কেউ পায়খানায় যাবার সময় ‘বিসমিল্লাহ্’ বললে, তা হবে জ্বিনদের চোখ আর আদম সন্তানের লজ্জাস্থানের মধ্যে আবরণ।

● হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন, জনাব রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) পায়খানায় যাবার সময় বলতেনঃ
[আল্লাহুম্মা ইন্নী আঊযুবিকা মিনাল খুবুসি অল-খাবায়িস) হে আল্লাহ্! দুষ্ট পুরষ জ্বিন ও দুষ্ট মহিলা জ্বিনের (অনিষ্ট) থেকে আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হযরত বিলাল বিন হারিস (রাঃ) বলেছেন: আমরা নবীজীর সাথে এক সফরে কোন এক জায়গায় যাত্রা বিরতি দিলাম। তিনি পায়খানায় গেলেন। আমি তাঁর কাছে পানির পাত্র নিয়ে গেলাম। (সেখানে) আমি কিছু লোকের ঝগড়া-বিবাদ ও চেঁচামেচি শুনলাম। ওই ধরনের চেঁচামেচি আগে কখনও শুনিনি। তো নবীজী ফিরে আসতে আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রসূল (সাঃ)! আমি আপনার কাছে লোকজনের ঝগড়া ও চেঁচামেচি শুনেছি। ওই ধরনের আওয়াজ মানুষের থেকে কখনও শুনিনি। নবীজী বললেনঃ

إخـتـصـم عندى  الجن والمسلمون والجن المشركون فسألوني أن أسكنهم ، فأسكنت الجن المسلمين الجلس وأسكنت الجن المشركيـن الغـور –

আমার কাছে মুসলমান জ্বিন ও মুশরিক জ্বিনরা ঝগড়া করছিল। তারা আমার কাছে আবেদন করল যে, আমি যেন ওদের বাসস্থান ঠিক করে দিই। তো আমি মুসলিম জ্বিনদের ‘জালস’ দিয়েছি এবং মুশরিক জ্বিনদের ‘গওর’ দিয়েছি। আমি (আবদুল্লাহ্ বিন কাসীর, রাবী) জিজ্ঞাসা করলাম, এই ‘জালস’ ও ‘গওর’ কী? (হযরত বিলাল বিন হারীস) বললেন, জালস মানে বস্তি ও পাহাড় আর ‘গওর মানে খাদ, গুহা ও সামুদ্রিক দ্বীপ। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

তার মানে এই নয় মুশিরক জ্বিনরা আমাদের আশেপাশে থাকে না বরং রসুল (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন এখানে- কারন মুশিরক জ্বিন দ্বারা মুমিনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকে আর মুমিন জ্বিনগণ মুমিন মানুষের সাথে থাকলে দ্বীন শিখতে পারবে। অথচ এখন ভূত, জ্বিন দেখা ও ধরা নাম করে অনুষ্ঠান করছে এগুলো ফেতনা ছাড়া কিছুই নয়।

● হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সারজাস থেকে বর্ণিত : রসূলুল্লাহ (সাঃ) গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। লোকেরা হযরত কাতাদাহ্ (রাঃ) (এই হাদীসের রাবী)-কে জিজ্ঞাসা করে, গর্তে পেশাব করার অসুবিধার কারণ কী? তিনি বলেন, কথিত আছে, গর্তে জ্বিনরা থাকে।

● হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেছেনঃ আমি হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ) কে (সম্ভবত গোসল করার সময়) দু’টি চাদরে জড়ানো অবস্থায় দেখে কৌতূহল বোধ করি (এবং ওঁদের কাছে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করি)। ওঁরা বলেন, হে আবূ সাঈদ! তুমি কি জান না, পানিতে কিছু মাখলুক থাকে।

● হযরত (ইমাম বাকির) মুহাম্মদ বিন আলী থেকে বর্ণিত : হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ) একবার সকালে এলেন। ওঁরা চাদর গায়ে দিয়েছিলেন। ওঁরা বলেন, পানিতেও (জ্বিন ও শয়তানরা) থাকে।

● হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ)-র বাচনিকে এ মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, জনাব রসূলুল্লাহ (সাঃ) মানুষকে নিষেধ করেছেন জলাভূমির মাঝে অবস্থিত তলায় চারাগাছ-ঘাস প্রভৃতি জন্মে থাকে- এমন ছোট ছোট বিলে ডুব দিতে, কেননা ওখানে জ্বিনরা থাকে।

মিথ্যাচার

“যার যবেহকালে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, তা তোমরা ভক্ষণ করো না। কেননা, তা পাপ। আর নিশ্চয় শয়তান তার বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়। যদি তোমরা তাদের কথামত চল, তাহলে অবশ্যই তোমরা অংশীবাদী হয়ে যাবে।” (সুরা আল আনআম-১২১)।

শয়তান জ্বিন মিথ্যাচার ছড়িয়ে ফেতনা সৃষ্টি করে।
কেয়ামতের পূর্বে তা আরও মারত্মাক হবে।

● হযরত ওয়াসিলাহ্ বিন আসক্বঅ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, জনাব রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

لا تقوم الساعة حتى يطوف إبليس في الأسواق ويقول حدثنى فلان ابن فلان بكذا وكذا

ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত ঘটবে না যতক্ষণ না ইবলীস হাটে-বাজারে ঘুরে ঘুরে বলবে ‘অমুকের পুত্র অমুক আমাকে বর্ণনা করেছেন এই এই হাদীস।

● হযরত আবদুল্লাহ্ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

يوشك أن تظهر فيكم شياطين كان سليمان بن داود أو ثقها في البحر يصلون معكم في مساجدكم وبقر ون معكم القران ويجادلونكم في الدين وانهم تشيا عين في صورة الإنسان

হযরত দাউদের (আঃ) পুত্র সুলাইমান (আঃ) শয়তানদেরকে সমুদ্রে নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেই জামানা নিকটবর্তী, যাতে শয়তানরা তোমাদের মধ্যে প্রকাশ পাবে। তোমাদের সাথে তোমাদের মসজিদে সালাত পড়বে। তোমাদের সাথে কোরআন পাঠ করবে এবং তোমাদের সাথে দ্বীনে ইসলামের বিষয়ে ঝগড়া-দ্বন্দ্ব করবে। সাবধান! ওরা হবে মানুষরূপী শয়তান।

● উপরোক্ত বর্ণনার অতিরিক্ত বিবরণ হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

إن سليمان بن داود أوثـق شـيـا طـيـن فـي الـبـحـر فـإذا كانت سنة خمس وثلايـيـن ومـانـة خـرجـوفـي صـور الـنـاس وايـشـارهـم فـي المجالس والمساجد ونازعوهم القرآن والحديث

হযরত সুলাইমান বিন দাউদ (আঃ) শয়তানদেরকে সমুদ্রে অন্তরীন করে দিয়েছিলেন। ১৩৫ সাল হলে ওই শয়তানরা মানুষের আকার আকৃতিতে মসজিদে ও মজলিসে প্রকাশ পাবে এবং মসজিদ-মাদ্রাসার লোকদের সাথে কোরআন-হাদীস নিয়ে দ্বন্দ্ব বিবাদ করবে।

● হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনাব রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
যে শয়তানগুলোকে হযরত দাউদের পুত্র হযরত সুলাইমান (আঃ) সমুদ্রের দ্বীপপুঞ্জে বন্দী করে রেখেছিলেন, তারা বের হবে। তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ইরাকের দিকে মুখ করবে ও ইরাকবাসীদের সাথে কোরআন নিয়ে অশান্তি ছড়াবে এবং ১০ শতাংশ শয়তান যাবে সিরিয়ার দিকে।

আমাদের উপমহাদেশে মানুষ রিযিকের পেরেশানী, স্বামী-স্ত্রী সুসম্পর্কের জন্য এমন খোনার বা আলেমের কাছে যায় যারা দাবি করে তাদের কাছে জ্বিন আছে। অথচ সাহাবী, তাবেয়ী দ্বারা এমন কোন উদাহরণ নেই!?

জ্বিনরা মানুষের মত চলাফেরা করে না, কিভাবে বুঝবেন তা মুমিন জ্বিন না শয়তান জ্বিন। বরং হাদীস বলে – শয়তান তালাক হলে খুশি হয়।

● জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শয়তান পানির ওপর তার সিংহাসন স্থাপন করে, তারপর (সারা দুনিয়াব্যাপী) তার বাহিনী পাঠিয়ে দেয়। আর (ওই শয়তান) সবচেয়ে বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত, যে (মানুষের মাঝে) সবচেয়ে বেশি ফেতনা সৃষ্টি করে।
শয়তান সিংহাসনে বসে সবার ঘটানো ফেতনার বর্ণনা শোনে। একজন এসে বলে আমি অমুক কাজ করেছি, শয়তান বলে তুমি তেমন কোনো কাজ করনি।
এভাবে শয়তান তার পাঠানো অন্যদের (শয়তানের) মন্দ কাজের বিবরণ শুনতে থাকে। অতপর একজন এসে বলে- ‘আমি অমুকের সঙ্গে ধোঁকার আচরণ করেছি, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছি। এ (ফেতনার) কথা শুনে শয়তান তাকে তার কাছাকাছি (বুকে) টেনে নেয়।
আর বলে তুমিই বড় কাজ করেছ। হাদিস বর্ণনাকারী আমাশ বলেন, আমার মনে হয় তিনি বলেছেন, অতপর শয়তান তাকে তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়।’ (মুসলিম)

এছাড়া কুরআনে আছে – “আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফরী করেনি; বরং শয়তানরা কুফরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাত এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর। আর তারা কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফরী করো না।’ এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা নিশ্চয় জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা বুঝত।” (সুরা বাকারাহ -১০২)

আজও তারা সুলেয়মানি বিদ্যার নামে এসব করে। আসলে আমাদের সবার নিকট ক্বারিন জ্বিন থাকে। কারিন (قرين) আরবি শব্দ। কারিন দ্বারা সঙ্গী, সাথী ও সহচর বুঝায়। উল্লেখিত কারিন জিন/শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করে, অন্যায়-অশ্লীল কাজের দিকে প্ররোচিত করে। কুকর্ম ছাড়া ভালোকাজে উৎসাহ দেয় না। এই জিনকে কারিন জিন বা সহচর শতয়ান বলা হয়। হাদিসের একটি বর্ণনা থেকে তা সুস্পষ্ট-

● হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তি (অবশিষ্ট) নেই; যার সঙ্গে তার সহচর (কারিন) জিন (শয়তান সহচর) নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি।
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার সঙ্গেও কি?
তিনি বললেন- আমার সঙ্গেও। তবে আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে ( বা আমার অনুগত হয়ে গেছে)। ফলে সে আমাকে শুধু ভাল কাজেরই পরামর্শ দেয়।

● অন্য এক হাদিসে সুফিয়ানের বর্ণনায় এসেছে-

وقد وكِّل به قرينُه من الجنِّ وقرينُه من الملائ

‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সঙ্গে তার সহচর জিন (শয়তান) এবং সহচর ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি।’ (মুসলিম)

মানুষকে কুমন্ত্রণা দেওয়া কিংবা প্ররোচনা প্রদানকারী জিন শয়তান মানুষের সঙ্গে থাকার বিষয়টি কুরআনুল কারিমেও সুস্পষ্ট। কেয়ামতের দিন মানুষের সঙ্গী এ শয়তান বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

قَالَ قَرِیۡنُهٗ رَبَّنَا مَاۤ اَطۡغَیۡتُهٗ وَ لٰکِنۡ کَانَ فِیۡ ضَلٰلٍۭ بَعِیۡدٍ –  قَالَ لَا تَخۡتَصِمُوۡا لَدَیَّ وَ قَدۡ قَدَّمۡتُ اِلَیۡکُمۡ بِالۡوَعِیۡدِ

“তার সহচর (শয়তান) বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি তাকে অবাধ্য হতে প্ররোচিত করিনি। বস্তুতঃ সে নিজেই ছিল ঘোর বিভ্রান্ত। আল্লাহ বলবেন, তোমরা আমার কাছে বাক-বিতণ্ডা করো না। অবশ্যই আমি আগেই তোমাদের সতর্ক করেছিলাম।” (সুরা কাফ : আয়াত ২৭-২৮)।

যেহেতু দীর্ঘকাল হতে সে আমাদের সাথে থাকে  আমাদের অনেক কিছু সে জানে, খোনাররা আমাদের ক্বারিন হতে অনেক তথ্য জেনে অবাক করে দেয় ও আস্থা অর্জন করে পরে বিভিন্ন মিথ্যা ছড়িয়ে অর্থ ও ঈমান কেড়ে নেয়। এই নিয়ে দাজ্জাল, জিন, ক্বারিন পোস্টে আলোচনা রয়েছে।

যেমন ধরুন- কেউ বললো তার স্বামী  ইদানীং খারাপ ব্যবহার করে তখন খোনার কিছুদিন পূর্বের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বলে আস্থা অর্জন করবে। আর ক্বারিন কুফরী করা ছাড়া সাহায্য করে না। এরপর হয়তো বলবে প্রতিকার স্বরূপ আল্লাহর নাম বাদে মোরগ জবাই  করতে। আর কারণ হল- আল্লাহর নাম বাদে জবাই হারাম আর মোরগ মালাইকা দেখে।

● রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“তোমরা যখন মোরগের ডাক শুনো তখন আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। কারণ সে মালাইকা দেখে।” (উৎস: আল মানারুল মুনিফ, হা/৭৯- মূলত: এ হাদিসটি সহিহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

● রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা মোরগকে গালি দিও না। কারণ সে সালাতের জন্য ঘুম থেকে জাগায়।” (উৎস: যাদুল মাআদ: ২/৪৩১। শাইখ আলবানী রহ.ও উক্ত হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন: দ্রষ্টব্য: সহিহ)

ফলে মোরগ যত কমবে তত মানুষ সুবিধা হতে বঞ্চিত হবে। ওরা কখনও বয়লার মোরগ জবাই করতে বলে না। এমন হয় খোনাররা বলবে- পরিবারের কেউ কুফরী কালাম বা তাবিজ করেছে তাই সংসারে অশান্তি, পেরেশানি কিন্তু সরাসরি নাম বলবে না।

তখন আপনি নাম জানতে আগ্রহী হবেন – তখন আশেপাশের জ্বিনদের মাধ্যমে উক্ত পরিবারের যেকোন সদস্যের নাম ও দৈহিক আকৃতি জেনে বলে দিবে ও করছে যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়। ফলে ভুক্তভোগীর মনে আপন স্বজন সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকবে সে স্বজনের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে এজন্য হয়তো একসময় তা তালাকে পরিণত হবে।

হয়তো ওরা ভুক্তভোগীকে বলবে আপনার যাকে সন্দেহ হয় এরকম তিনজন ব্যক্তির নাম লিখে আনেন – ফলে সে নাম লিখে আনবে তখন খোনার নামগুলো তিনটা আটার গোলার ভিতরে রেখে পানিতে ছেড়ে দিবে ফলে দুটো  গোলা ভাসবে আর একটা ডুবে  যাবে।

তখন বলবে ডুবে যাওয়া গোলার ভিতরের লেখা নাম যার সে করেছে। আসলে ওরা দুটো আটার গোলায় একধরনের ক্যাপসুল দেয় যাতে ভাসতে সাহায্য করে আর আরেকটাতে দেয় না।

অথবা ভুক্তভোগীকে ডিম আনতে বলবে পরে ভুক্তভোগীর সামনে ডিম ভাঙ্গবে যার হতে রক্তের মত বের হবে তখন বলবে আপনার ঘরে খারাপ জ্বিন বা কুফরী তাবিজ করা হয়েছে তার প্রমান।এভাবে অর্থ ও ঈমান দুটোই নেয়।

আসলে তারা ডিমকে ভিনেগার বা অন্য কেমিক্যালে ডুবিয়ে রাখে কিছুক্ষণ। এরপর তার উপরে খোলস একেবার নরম হয়ে যায় তারপর ইনজেকশনের সিরিজ দিয়ে রং ঢুকায় এরপর ডিমকে কেমিক্যাল হতে উঠিয়ে রাখলে তা আগের রূপে ফিরে আসে। যখন ভুক্তভোগী ডিম নিয়ে আসে তারা আগোচরে তা বদলিয়ে দেয়।

যেকোন সমস্যার সমাধান কুরআনে রয়েছে – সুরা নাস, সুরা ফালাক, সুরা বাকারাহ’, আয়াতুল কুরসী তেলাওয়াত ও আমল করলে জ্বিন শয়তান হতে সুরক্ষিত থাকা যায়। রসুলের (সাঃ) উপর জাদু করা হয়েছে তা ওহী বা স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়েছেন এসব খোনররা কিভাবে জানবে ওদের নিকট কি ওহী আসে?

অনেকে বলবে – রসুলের (সাঃ) উপর জাদুর প্রকোপ হয়েছে তাহলে জাদু ও শয়তান কত শক্তিশালী নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। শয়তানের সকল ষড়যন্ত্র আল্লাহ জানেন ও ব্যর্থ করেন। আসলে আল্লাহ রসুল (সাঃ) এর মাধ্যমে উম্মতকে শেখাতে চেয়েছেন কিভাবে জাদু হতে বাচতে আমল করতে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুরা ফালাক, নাস নাযিল হয়েছিল। এরপর হতে সাহাবীরা নিয়মিত তা তেলাওয়াত ও বাকী আমলগুলো করতো, ফলে সুরক্ষিত ছিল।

জিন ও শয়তান সিরিজের সকল পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *