জিন ও শয়তান পর্ব-১১ (জিনের দাওয়াত)

জিন বহু আলোচিত বিষয়। এর ভয়ভীতি, অদ্ভুত তথ্য দিয়ে ওয়াজ ও গল্প বহুল প্রচলিত। এই পোস্টের উদ্দেশ্য শুধু কারো সমালোচনা নয় বরং সত্য প্রকাশ করে সতর্ক করা।

আমাদের দেশে জিনের নামে বহু ঘটনা প্রচলিত আছে। জিন কারো ল্যাপটপ খুলে ফেলে, কাউকে জিনের বাদশাহ দাওয়াত দেয়, জিন আবার কারো কাছে মিষ্টি খেতে চায়। অথচ বিসমিল্লাহ পড়লে শয়তান জিন গৃহে প্রবেশ করতে পারে না। ল্যাপটপ, কম্পিউটার খোলা তো দূরের কথা।

হাদীছে বর্ণিত হয়েছে – ‘যখন কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশের সময় ও খাবারের সময় আল্লাহকে স্মরণ করে তখন শয়তান (নিজ সঙ্গীদেরকে) বলে, তোমাদের রাত কাটানোর কোনো জায়গা নেই; তোমাদের রাতের কোনো খাবারও নেই।’ (মুসলিম)

আর বিসমিল্লাহ ব্যতীত কোন খাবার খেলে তাতে শয়তান জিন অংশ নেয়।

হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেছেন: রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে যখন আমরা কোনও খানার মজলিসে হাজির থাকতাম তখন তিনি শুরু না করা পর্যন্ত আমরা কেউ-ই খাবারে হাত দিতাম না। একবারের ঘটনা। আমরা (নবীজীর সঙ্গে) খাওয়ার মজলিসে হাযির আছি। এমন সময় এক বেদুঈন এল। যেন তাকে কেউ খাবারের দিকে তাড়িয়ে এনেছে। সে এসেই খাবারের দিকে হাত বাড়াল। নবীজী তার হাত ধরে ফেললেন এবং তাকে বসিয়ে দিলেন।

তারপর একটি মেয়ে (বালিকা) এল, তাকেও যেন হাঁকিয়ে আনা হলো। মেয়েটি এসে খাবারের পাত্রে হাত দিতে উদ্যত হলো। নবীজী তারও হাত ধরে ফেললেন। তারপর তিনি বললেনঃ
যে খাবারে আল্লাহর নাম নেওয়া (অর্থাৎ বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করা) হয় না, শয়তান তা নিজের জন্য হালাল করে নেয় (মানে, শয়তান সেই খাবরে শরীক হয়ে যায়)। (আমরা খাওয়া শুরু করিনি দেখে) শয়তান এই বেদুঈনের সাথে খেতে এসেছিল। আমি তার হাত ধরে ফেললাম। (ফলে শয়তান সুযোগ পেল না।) তাই সে ফের এই মেয়েটির সাথে এল এবং এর মাধ্যমে খাবারে ভাগ বসাতে চাইলে। এর হাতও আমি ধরে ফেললাম। যাঁর আয়ত্বে আমার জীবন সেই সত্তা (আল্লাহ্)-র কসম! এই দু’জনের হাতের সাথে শয়তানের হাতও (এখন) আমার মুঠোর মধ্যে।

হযরত উমাইয়া বিন মুখ্শী (রাঃ) বলেছেনঃ একবার রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপস্থিতিতে এক ব্যক্তি খানা খাচ্ছিল। (খাওয়ার শুরুতে) সে বিস্‌মিল্লাহ্ বলেনি। শেষ পর্যন্ত সে সবই খেয়ে ফেলল, কেবলমাত্র একটি লোকমা (বা গ্রাস) বাকি ছিল। সেই শেষ গ্রাসটি মুখে তোলার সময় সে বললঃ
“বিসমিল্লাহি আউওয়ালাহু অ আ-খিরাহু”
ভাবার্থ: এই খাবারের আগে ও পরে আল্লাহর নাম নেওয়া হলো।

তখন নবীজী (সাঃ) হেসে ফেললেন এবং বললেনঃ
শয়তান ওর সাথে খাবারে শরীক ছিল, কিন্তু যখনই ও আল্লাহর নাম নিয়েছে, অমনই শয়তান যা কিছু তার পেটে গিয়েছিল সব বমি করে দিয়েছে। (মুসলিম- কিতাবুল আশরিবাহ, সুনানে আবুদাউদ, মুসনাদে আহমেদ)

সাধারণত জিনের খাদ্য মানুষ হতে একটু ভিন্ন। হাড় ও গোবর হলো জিনের খাদ্য।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উযু ও ইস্তিঞ্জার ব্যবহারের জন্য পানি ভর্তি একটি পাত্র নিয়ে পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি তাকিয়ে বললেন, কে? আমি বললাম, আমি আবূ হুরাইরাহ। তিনি বললেন, আমাকে কয়েকটি পাথর তালাশ করে দাও। আমি তা দিয়ে ইস্তিঞ্জা করব। তবে, হাড় এবং গোবর আনবে না। আমি আমার কাপড়ের কিনারায় কয়েকটি পাথর এনে তাঁর কাছে রেখে দিলাম এবং আমি সেখান থেকে কিছুটা দূরে গেলাম। তিনি যখন ইস্তিঞ্জা হতে বেরোলেন, তখন আমি এগিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হাড় ও গোবর এর ব্যাপার কী? তিনি বললেন, এগুলো জিনের খাবার। আমার কাছে নাসীবীন নামের জায়গা হতে জিনের একটি প্রতিনিধি দল এসেছিল। তারা ভাল জিন ছিল। তারা আমার কাছে খাদ্যদ্রব্যের আবেদন জানাল। তখন আমি আল্লাহর নিকট দু‘আ করলাম যে, যখন কোন হাড্ডি বা গোবর তারা লাভ করে তখন তারা যেন তাতে খাদ্য পায়। (বুখারী)

আর সাহাবীরা (রা:) উপোস ছিলেন কতবেলা। জিনরা দাওয়াত দিয়েছে এমন নজির পাওয়া যায় না। আর মুমিন জিনরা অবশ্যই রসুলের (সা:) সুন্নাহ মানবে – অর্থাৎ ধরলাম কাউকে দাওয়াত দিল, মুমিন জিনেরা তাহলে পরিমিত আয়োজন করবে।

খেলাফায়ে রাশেদীনের যুগে মুসলিমদের মাঝে স্বচ্ছলতা এসেছিল- তারা অতিথিপরায়ণ ছিলেন। অতিথিরা যেমন পরিমিত খাওয়ার সুন্নাহ অনুসরণ করতো, তারাও দাওয়াত খাওয়ানোর নামে অপব্যয় করতেন না।

আর রসুলের (সা:) কাছে জিনরা ইসলাম শিখতে এসেছেন। আজও কারো আছে আসতে পারে- কিন্তু যারা তাদের কাছে জিন আসার কথা বলে, খেয়াল করবেন তাদের অধিকাংশেরই আকীদায় সমস্যা। ওদের কাছে শয়তান জিন আসে না মুমিন জিন আসে?

জিনদের যেভাবে দাওয়াহ দিয়েছেন:

জিন জাতি আল্লাহর বিস্ময়কর ও রহস্যঘেরা সৃষ্টি। কোরআনের শতাধিক আয়াতে জিন শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানুষের মতো তারাও আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য আদিষ্ট।

যেমন ইরশাদ হয়েছে,

‘আমি মানুষ ও জিন জাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা: জুররিয়্যাত, আয়াত : ৫৬)

আল্লাহ বলেন,

‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসুল আসেনি, যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করেছে।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৩০)

কোরআনের বর্ণনায় জিন জাতির ইসলাম গ্রহণ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও জিনদের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। কোরআন ও হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে জিনদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর সাক্ষাৎ প্রমাণিত হয়। হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, রাসুল (সা.) জিন জাতির কাছে একাধিকবার দ্বিনের দাওয়াত নিয়ে যান এবং তাঁর হাতে জিনদের এক ও একাধিক দল ইসলামও গ্রহণ করে। পবিত্র কোরআনে ‘জিন’ নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা রয়েছে।

কুরআনে বর্নিত আছে-

‘বলুন! আমার প্রতি ওহি অবতীর্ণ হয়েছে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে (কোরআন) শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথের নির্দেশ করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা আমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে কাউকে শরিক করব না।’ (সুরা: জিন, আয়াত : ১-২)

আজও জ্বিনেরা দ্বীন জানার জন্য আলেমদের কাছে আসতে পারে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু জ্বিনরা গায়েব জানে না, আর শয়তান জ্বিনরা সত্যের সাথে মিথ্যা মিশ্রণ করে।

কিভাবে বুঝবেন জিন সত্যি বলছে না মিথ্যা?

সোলেমান (আঃ) জিনদের বন্দী করে। শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা স্বত্বেও তিনি হুদহুদ পাখিকে বার্তাবাহক ব্যবহার করেছেন। রসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীরা জ্বিনদের হাজির করে বার্তা নিতেন না বরং ওহী নিয়ে মালাইকা (ফেরেশতা) আসতো আর দ্বীন শেখার জন্য জ্বিনরা আসতো।

কিভাবে বুঝবেন খোনার বা হুজুর যে জ্বিন উপস্থিত করেছে তা মুসলিম না শয়তান?

জ্বিন উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আযান, আয়াতুল কুরসী, সুরা ফালাক ও নাস, সুরা বাকারাহ পড়ুন দেখবেন শয়তান জ্বিন পালিয়ে যাবে আর মুসলিম জ্বিন কুরআন শুনবে মনযোগ দিয়ে।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘর-বাড়িগুলো কবরে পরিণত করো না। যে বাড়িতে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়, অবশ্যই সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে’। [মুসলিম]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা) যাকাতুল ফিতর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিলেন। আমি তিন রাত চোর আটক করলাম।

বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সে ২ রাতে ছুটে গেল। তৃতীয় রাতে সে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও তোমাকে কিছু বাক্য শিখিয়ে দিব, যা দ্বারা তোমার উপকার হবে। আমি বললাম, সেগুলো কি? সে বলল, যখন তুমি ঘুমাতে যাবে তখন ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করবে। তাহ’লে তোমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত করা হয়। আর সকাল পর্যন্ত তার নিকট শয়তান আসতে পারে না।

ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বর্ণনা করার পর তিনি বললেন, হে আবু হুরায়রা। তুমি কি জান সে কে? সে হ’ল চিরমিথ্যাবাদী কিন্তু তোমার সাথে সত্য বলেছে। সে হ’ল শয়তান’। [বুখারী]

হাদীসে উল্লেখ রয়েছে –

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্‌র রসূল (সঃ) বলেছেনঃ যখন সালাতের জন্য আযান দেয়া হয়, তখন শয়তান হাওয়া ছেড়ে পলায়ন করে, যাতে সে আযানের শব্দ না শুনে। যখন আযান শেষ হয়ে যায়, তখন সে আবার ফিরে আসে। আবার যখন সালাতের জন্য ইক্বামাত বলা হয়, তখন আবার দূরে সরে যায়। ইক্বামাত শেষ হলে সে পুনরায় ফিরে এসে লোকের মনে কুমন্ত্রণা দেয় এবং বলে এটা স্মরণ কর, ওটা স্মরণ কর, বিস্মৃত বিষয়গুলো সে মনে করিয়ে দেয়। এভাবে লোকটি এমন পর্যায়ে পোঁছে যে, সে কয় রাক’আত সালাত আদায় করেছে তা মনে করতে পারে না। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬০৮)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *