ইংরেজদের জুলুম, নির্যাতনে ভারত উপমহাদেশে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের থাবা শেষে ইংরেজরা বিদায় নিল। স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র তৈরী হলো। এরপর পাক-ভারত বিভক্তি উভয়ই এটাকে স্বাধীনতার নাম দিলো। এরপর আবার পাকিস্তানের জুলুম, নির্যাতনে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ হলো। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সবাই স্বাধীনতার চেতনায়- আলাদা আলাদা জাতীয় সংগীত, পতাকা, জাতীয় সংবিধান গড়লো।
যদিও উদ্দেশ্য, আদর্শ, লক্ষ্য কাছাকাছি – স্বাধীনতা তাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, মানবরচিত সংবিধান তাদের আদর্শ এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক যা সকল কিছুর সঠিক সমাধান। মুসলিম হওয়া আমাদের ইহজীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। রসুল (সা:) আমাদের আদর্শ। তার দেখানো কুরআনের সংবিধান হলো সকলকিছুর সমাধান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাক্ষাৎ আমাদের লক্ষ্য ও শ্রেষ্ঠ অর্জন।
এরপর কত জালেম শাসক এল গেল, সদ্য আবার স্বাধীনতা পেয়েছি। আসলে এই স্বাধীনতার শেষ কোথায়! স্বাধীনতার নামে ও ধোকায় বার বার আমাদের নির্দিষ্ট শাসক ও মানবরচিত নিয়মের অধীন করা হচ্ছে। আমাদের রক্তে কিছু লোকই লাভবান হচ্ছে বার বার! ইংরেজদের আমলে যারা মজলুম ছিল তারা একসময় ভারতবর্ষে ক্ষমতা পায়, তেমনি পাকিস্তান আমলের মজলুম অনেকেই বাংলার ক্ষমতা পায়। ক্ষমতা পেয়ে একসময়ের মজলুমরা জালেম হয়ে উঠে। ফলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তারাই কারারুদ্ধ করলো, রক্ত ঝরিয়েছিল। ক্ষমতা পাবার পর তারাই হয়ে উঠলো অন্যায় ও জুলুমের বাহন।
ভয় হয়! একসময় যারা মজলুম ছিল তারা মানবরচিত আইন বা খেয়ালখুশির আইনে শাসন করে আবার যেন জালেম না হয়ে যায়। ইসলাম প্রত্যাশী বা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে যেন জুলুম না চালায়। তারপর ওদের বিরুদ্ধেই যেন আবার স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত না হতে হয়!? অনেকে দু-একটা ভালো কাজ (মসজিদ, মাদ্রাসায় উন্নয়ন) দেখলে মিছে আশা করে, ওদের মুসলিম ও ইসলামের সেবক দাবি করে।
শুধুমাত্র একটা আইন ইসলামী হোক দাবি করে দেখুন- পরকিয়ার শাস্তি কুরআন দ্বারা হোক তাহলে দেখবেন যারা মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করে প্রশংসায় ভাসছে, তাদের লাঠির আঘাতে রক্তে ভাসছে বা মুসলিমদের জেলে ভরবে। কারন শাসকদের অনেকে ও তাদের স্বজনদের অনেকে জেনা, পরকিয়ায় লিপ্ত। আইন করলে শাস্তি ওদের উপরও বর্তাবে।
তারপরও আমরা বার বার স্বাধীনতার অহংকারে মত্ত।
অথচ একদল ক্ষমতা পেলে অন্যদল বা বিরোধীদলের মজলুমদের আবার স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হয়। একটু বুঝেন – এই স্বাধীনতা পশ্চিমাদের ধরিয়ে দেওয়া চেতনা নয় কি!
সাহাবীরা কি কোন ভূখন্ড দখল করলে বা জালেমমুক্ত করলে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে গর্ব করতো? শরীয়া আইন প্রয়োগে তাকে খেলা-ফাত বা খেলাফাহর অংশ ইমারত হিসেবে ঘোষণা করতো।
এই মহাবিশ্বে একমাত্র স্বাধীন হল আল্লাহ। তিনি যা ইচ্ছে করেন, সবকিছুই তার অধীন। আল্লাহ মানুষকে কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন আল্লাহর ইচ্ছেই সে তা কর্মে পরিণত করতে পারে। তবে আল্লাহর কাছে প্রিয় হল মুসলিম যারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী।
মুসলিম অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনকারী। মানুষ হয় ইসলামী নিয়মনীতি মেনে আল্লাহর অধীন হয়ে মুসলিম হবে না হয় নিজের মনমতো চলে নফসের অধীন হয়ে শিরকে লিপ্ত হবে।
ইসলামি রাষ্ট্র বলতে বুঝায় এমন রাষ্ট্রব্যবস্হা যা আল্লাহর আইন ও একমাত্র সংবিধান কুরআন-সুন্নাহর অধীন যেখানে সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহর আর তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র বলতে বুঝায় জনগনের পছন্দনীয় শাসক, শাসন ও তার আইন বা সংবিধানের অধীন যা প্রয়োজনে আল্লাহর আইনকে বাতিল করে নিজেরা মনমতো আইন রচনা করতে পারবে। এভাবে আল্লাহর বিধানদাতা সত্তার সাথে শিরকে লিপ্ত হয়। যারা এই ধরনের নিয়মনীতিকে ভালোবাসবে, সর্মথন করবে তারা আল্লাহর শত্রুকে ভালোবাসা ও সমর্থন দিয়ে আল্লাহর শত্রুতে পরিণত হয়।
মুসলিম অধ্যুষিত দেশ যদি কুরআনের আইন দ্বারা পরিচালিত না হয় আল্লাহ সেখানে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্নিত- “যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তার রসুলের সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করেন এবং সে তাদের সহায় সম্পদ কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহন করে না, তখন আল্লাহ পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন।” (ইবনু মাজাহ- ৪০১৯)
স্বাধীনতার চেতনায়- বিজয় দিবস পালনের নামে কুফর, শিরকী, অশ্লীল নাচ-গান সবই চলছে। রমনা, ধানমন্ডিসহ সারাদেশে গান ও বিজয় দিবসের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হয়। অথচ ফুটপাতে হাজারও শিশু, বৃদ্ধ আশ্রয়হীন, বস্ত্রহীন, খাদ্যহীন থাকে। যাকাতের রহমত উম্মত পাচ্ছে না, উল্টো করের বোঝা চাপছে। মানবরচিত আইনগুলো অদ্ভুত – এখানে অধিকাংশ জনগণের চাহিদার অর্থনীতির প্রাধান্য ঘটে, ন্যায়নীতির নয়।
একটু ভাবুন- যারা সীমানা পাহারা দিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় তাদের বেতন কত, কতটা প্রশংসা পায়। আর কারো চার, ছক্কা, উইকেটের মূল্য ও প্রশংসা তারচেয়ে অনেক বেশি।
বহু ব্যবসায়ী কর, যাকাত ফাকি দিয়ে এসব খেলায় বিনিয়োগ করে অবৈধ টাকা বৈধ করে নেয়। যে কৃষক জমির কল্যানে শ্রম-ঘাম ঢেলে দেয়, পরিশেষে মূল্য পায় না অথচ সুবিধাবাদীরা বহুগুন লাভ করে চলছে।
আমাদের করের টাকায় ইংরেজরা মূর্তি তৈরি করতো আজও বহু চেতনা, স্বাধীনতার নামে মূর্তিসহ শিরকের প্রসার আমাদের করের টাকায় হয়। আর প্রতিবাদ করলে আমাদের স্বদেশীয় প্রশাসনের লোককে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবুও আমরা স্বাধীনতার দাবিদার গর্বিত যদিও আমাদের মতবাদের কোন মূল্য তারা দেয় না।
এবার ইসলাম ও কর নিয়ে আলোচনা করি!
ইসলামী রাষ্ট্রের কার্যক্রম ও উন্নয়ন চালানোর খাত হল- যাকাত, গনিমত, উসুর, জিজিয়া ও বহিঃবিশ্বের লোকেরা ব্যবসা করতে এলে কর দিত। ভোগ্যপন্যের করের নামে নির্যাতন, দাসত্ব ছিল না। যাকাত সামর্থবানরা দিত সবাই নয়। ধরুন- একজন হতদরিদ্র রিকশাওয়ালা, ফকির বাজার হতে ৫০০ টাকার জামা, পন্য কিনতে যে পরিমান কর দেয়। সেই একই পরিমান কর মিলিনিয়ার ব্যবাসায়ী দেয় অথচ সেই বাধ্যতামূলক যাকাত তার হতে নেওয়া হয় না। (ইনকাম ট্যাক্স ভিন্ন হিসাব আর বেশিরভাগ লোকই প্রকৃত ইনকাম ট্যাক্স দেয় না)। একই এলাকায় বস্তিবাসী, ডুপ্লেক্সের বাসিন্দার বিদ্যুৎ, গ্যাস বিলের করের পরিমাণ একই। তাই গরিবের ছেলে অভুক্ত থাকে আর তাদের দেওয়া করের টাকায় আমলা, মন্ত্রীর ছেলে দামী গাড়ি, বাড়ীর বিলাসীতা করে। অথচ খেলাফায়ে রাশেদীনের যুগে- খলিফার পোষাক, আহার সাধারণ জনগণের মত বা অনেকক্ষেত্রে (তাকওয়ার কারনে) আরও নিম্ন পর্যায়ের ছিল। সামান্যই তারা ভাতা নিতেন।
আরবদেশগুলোতে আমাদের স্বদেশীয় লোকদের উপর আকামার বোঝা চাপানো হয়। কিন্তু তাদের দেশে জন্মগ্রহণকারী কাফেরদের হতে জিজিয়া নেওয়া হচ্ছে না, আকামাই যেন একপ্রকার জিজিয়া যা অন্যদেশের মুসলিমরা দিচ্ছে। অথচ মুসলিমরা পরস্পর ভাই। রসুল (সা:) সাহাবীদের মদীনার রাষ্ট্রে ইয়েমেন, শাম, পারস্য বহুদেশের লোকেরা একইরকম অধিকার নিয়ে থাকতো।
কেউ যদি বেড়াতে আসতো তাকে মুসাফির গন্য করে অতিথিয়তা করা হতো। এই কর, আকামার জন্য যেখানে হয়তো সপ্তাহে ৫ দিন ৭ ঘন্টা কাজ করলে একজন ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারতো, তার বদলে আরও বহু ঘন্টা কাজ করতে হচ্ছে। এভাবে দ্বীন চর্চা, পরিবারের সঙ্গ হতে দীর্ঘসময় দূরে থাকতে হচ্ছে। আমাদের সময়গুলো অতিবাহিত হচ্ছে – জালেমদের বিলাসীতা পূরনে।
এরপর সুদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ সিন্ডিকেট, লোভ ও সুদ। বছরের পর বছর টকশো আলোচনা হয় অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণই বাদ যায়, আলেমরা যেন বলতে ভুলে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ সুদভিত্তিক অর্থনীতি ব্যবস্হা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- বেলাল সাহেব একজন বৃহৎ পাইকারী ব্যবসায়ী। তিনি একটি পণ্য কিনলেন যার মোট খরচ হল ১০০ টাকা। এই পণ্য ১০৫ টাকা বিক্রি করলেও তার লাভ থাকতো!! যেহেতু তিনি ব্যাংক হতে সুদে টাকা নিয়ে পণ্য কিনেছেন যে কারণে ব্যাংকে ৬-৭ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হবে সেজন্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে তাকে বিক্রি করতে হবে ১১০-১১২ টাকা। বেলাল সাহেব হতে ১১০ টাকায় কিনলেন ক্ষুদ্র পাইকারী ব্যবসায়ী। সেও ব্যাংক, সমবায় সমিতি হতে সুদে ধার নিয়ে পণ্য কিনলো ফলে যে পণ্য ১১৫ টাকা বিক্রি করলে তার লাভ হতো কিন্তু সুদের টাকা দিতে হবে তাই ১২০ টাকা বিক্রি করতে হবে। ১২০ টাকায় খুচরো বিক্রেতা কিনলো সেও সমবায় সমিতি হতে সুদের টাকা ধার নিল। ফলে তাকেও অধিক দামে বিক্রি করতে হবে। ফলে সমস্ত সুদ ও লাভ বহন করতে হবে সাধারণ ক্রেতাকে। এভাবে ব্যাংকগুলো, সুদের কোম্পানিগুলো বিনা পরিশ্রমে লাভ করতে থাকে আর তার ভার বহন করতে হয় সাধারণ ভোক্তাদের। আর এভাবে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে দ্রব্যমূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। সুদ সম্পদের বরকত নষ্ট করে দেয়।
ইসলাম ছাড়া যত মানবরচিত আইন আছে – প্রয়োগ করলে কারো না কারো উপর জুলুম হবে একমাত্র ইসলামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
রক্ত আমরা ঠিকই ঝরাচ্ছে কিন্তু শান্তি, সমৃদ্ধির স্বপ্ন বৃথা যাচ্ছে বার বার। দ্বীনের পথে জীবন দিলে জান্নাত, বেচে থাকলে ন্যায়নীতির রাষ্ট্র হতো।