ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনবিধান। পবিত্র কুরআন, রসুলের (সাঃ) সুন্নাহ ও সাহাবীদের জীবনী আমাদের আদর্শ। এখানে যেমন স্বজনদের সাথে ভালো ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তেমনি ইসলামের জন্য স্বজনদের আদেশ অমান্য করার নির্দেশও রয়েছে।
১ম ঘটনা
হজরত সা’দের (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাঁর মা পুত্রের মুসলমান হওয়ার খবর শুনে চিৎকার শুরু করে দেন। তাঁর চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। সাদ মায়ের কাণ্ড দেখে ঘরের এক কোণে নীরব অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর মা কিছুক্ষণ শোরগোল করার পর ছেলেকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য চরমপত্র ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, ‘সে যতক্ষণ না মুহাম্মদের ধর্ম থেকে ফিরে আসবে, ততক্ষণ আমি কোনো কিছু খাব না, পান করব না এবং রোদ থেকে ছায়াতেও আসব না।’ মায়ের ঘোষণা শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিন দিন কেটে গেল, সা’দের মা খাবার বা পানীয় কোনো কিছু স্পর্শ করলেন না, কারো সঙ্গে কথাও বললেন না, রোদ থেকে ছায়াতেও এলেন না। সাদ অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি রাসুল (সা.) এর দরবারে হাজির হলেন। ঘটনা বিস্তারিত রাসুল (সা.) কে অবহিত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হলো, ‘আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সঙ্গে এমন কিছুকে শরীক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি সে বিষয়ে তাদের আনুগত্য কোরো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এরপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব তোমাদের কর্মফল।’ (সুরা আল-আনকাবুত, আয়াত ৮)।
২য় ঘটনা
তালহা’র (রা) শৈশব-কৈশোর সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানা যায় না। এটুকু জানা যায় যে, তিনি রাসূল (সা) এর মদীনায় হিজরতের চব্বিশ কি পঁচিশ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন। আর একটা ব্যাপারে সবাই একমত –তা হলো তিনি খুব শৈশবকাল থেকেই ব্যবসার সাথে জড়িত হন এবং একটু বড় হলেই ব্যবসায়িক কাজে দেশে-বিদেশে গমন করেন। অন্যান্যের মতো হযরত তালহা (রা) ইসলাম গ্রহণ করার পর নানাভাবে অত্যাচারিত হন। বিশেষ করে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয় বেশী। এ ব্যাপারে তাঁর মা সোবাহও কম ছিলেন না। মাসউদ ইবন খারাশ বলেন, ‘একদিন আমি সাফা মারওয়ার মাঝখানে দৌড়াচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, একদল লোক হাত পা বাঁধা একটি যুবককে ধরে টেনে নিয়ে আসছে। তারপর তাকে উপুড় করে শুইয়ে তাঁর পিঠে ও মাথায় বেদম মার শুরু করলো। তাদের পেছনে একজন বৃদ্ধা মহিলা চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে তাকে গাল দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম –ছেলেটির এ অবস্থা কেন? তারা বললো, এ হচ্ছে তালহা ইবন ওবাইদুল্লাহ। পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বানূ হাশিমের সেই লোকটির অনুসারী হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এই মহিলাটি কে? তারা বললো, সোবাহ বিনতু আল হাদরামী, যুবকটির মা।
৩য় ঘটনা
মক্কার প্রখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুসআব ইবনে উমাইর (রাঃ)। সমস্ত আরব অঞ্চলে যে সকল পরিবার সম্পদ ও বিত্তের দিক থেকে শীর্ষে ছিল, মুসআবের পরিবার ছিল তাদেরই একটি। বিপুল প্রাচুর্য্য আর বিলাসিতার মধ্য দিয়ে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল। তিনি ছিলেন ধনী বাবা-মার সন্তান। ভীষণ আদর আর যত্নে তারা তাদের সন্তানকে বড় করছিলেন।
আরব অঞ্চলের সকলের চেয়ে দামী জামা তিনি পরতেন। সে সময়কার সবচেয়ে স্টাইলিশ জুতা থাকতো তাঁর পায়ে। তখনকার যুগে ইয়ামেনী জুতা ছিল সারা বিশ্বে বিখ্যাত। আর মুসআবের পায়ে থাকত ইয়ামেনী জুতার মধ্যেও সবচেয়ে দামী জোড়াটি। মোটকথা তৎকালীন আরবে যত ধরনের দামী চমকপ্রদ পোষাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে কোনভাবে তার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলতেন, “মক্কায় মুসআবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোষাকধারী আর কেউ ছিল না।” ঐতিহাসিকেরা বলেছেনঃ “তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারী।”
একসময় মুসাইব (রাঃ) ঈমান আনেন এবং এই সংবাদ ছড়িয়ে গেল। এটা কোরাইশদের চিন্তা-চেতনায় ছিল বড় আঘাত। ঘটনার পরিক্রমায় মুসাইব (রাঃ) গৃহবন্দী। আল্লাহকে একমাত্র রব্ব মেনে নিয়ে ঈমান আনার কারণে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল মেনে তাঁর আনুগত্য করার কারণে মুসআব ইবনে উমাইর আজ গৃহবন্দী। মক্কার যে সমাজ তাদের প্রতিটি বৈঠকে মুসআবের (রাঃ) সরব উপস্থিতির আকাঙ্ক্ষী ছিল, যার উপস্থিতির কারণে তাদের অনুষ্ঠান প্রাণ ফিরে পেতো, যে ছিলো তাদের আদরের দুলাল সেই সমাজের লোকদের হাতেই আজ বন্দী মুসআব।
তাঁর মা ঘর পাহারা দেবার জন্য চতুর এবং শক্তিশালী কয়েকজন লোককে নিয়োগ করলেন। তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেয়া হলো যাতে মুসআব আর কোনভাবেই মুহাম্মাদের সাথে কোন যোগাযোগ না রাখতে পারে এবং নতুন বিশ্বাস সম্বন্ধে আর কোন কিছু জানতে না পারে। দীর্ঘদিন ধরে মুসআব এদের তীক্ষ্ণ পাহারায় বন্দী অবস্থায় থাকলেন। কিন্তু আল্লাহর প্রতি মুসআবের ঈমান এতটাই দৃঢ় ছিল যে, তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন আল্লাহ্ নিশ্চিতভাবেই তার অন্তরের অবস্থা জানেন। সুতরাং খুব বেশিদিন এ বন্দী জীবন-যাপন করতে হবে না। এরপরও রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং অন্যান্য মুসলিমদের খবর জানার জন্য তার হৃদয় উদগ্রীব হয়ে উঠলো। যেভাবেই হোক তার এ খবর জোগাড় করতেই হবে।
তিনি সেই মুসাইব (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পর তার জীর্ন পোষাক স্বয়ং রসুলের (সাঃ) চোখে পানি এনেছিল। ইসলামের প্রথম দাঈ যার দাওয়াতে মদীনার শত শত সাহাবী মুসলিম হয়ে রসুলের (সাঃ) পক্ষে দাড়িয়েছিল। অথচ উহুদে তিনি যখন শাহাদাত বরন করেন তার জন্য পরিপূর্ন কাফনের কাপড় ছিল না, কিছু অংশ ঘাস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
এই ছিল সাহাবীদের ঈমানদীপ্ত জীবনী ইসলামের জন্য নিজের সম্পদ, পরিবার সব ত্যাগ দিতে দ্বিধা করেননি। এজন্যই তারা ছিলেন বিজয়ী চিরস্থায়ী জান্নাতের সম্মানিত অধিবাসী।
অথচ বহু তরুনকে দেখলাম মাশাল্লাহ লম্বা দাড়ি রেখেছে এরপর কিছুদিন পর ক্লিন শেভ। জিগাস করলে জানায়- আম্মু, আব্বু রাগ করবে ও মানা করেছে তাই আপাতত ফেলে দিয়েছে। বহুলোক আত্মীয়-স্বজন, সন্তানের মায়ায় দ্বীন হতে বহুদূরে চলে যায়। এর অন্যতম কারণ আমাদের দেশে পিতামাতা ও স্বজনের প্রতি ভালো ব্যবহার, সেবার ওয়াজ তো হয়। কিন্তু ইসলামের জন্য তাদের বিরোধিতা করতে হয় তা ওয়াজ হয় না।