আহলে বায়াত পর্ব-১

কুরআন, সুন্নাহের পর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আহলে বায়াত। অথচ এই ব্যাপারে উম্মত উদাসীন ও বিভ্রান্তিতে আছে। শিয়া ও ভন্ডপীরদের বাড়াবাড়ি এবং হক্ব দাবীদার আলেমরা আড়াল রেখে চলছে আহলে বায়াত প্রসঙ্গ। এখানে আহলে বায়াত বলতে মূলত রসুল (সাঃ), আলী (রাঃ) ও ফাতেমা (রাঃ) এর বংশধারা নিয়ে আলোচনা করা হবে যার সম্পর্ক পরবর্তীতে খলিফা মাহাদীর সাথে হবে।

সহিহ মুসলিম শরিফের হাদিসে এসেছে – হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সকালে বের হলেন। তাঁর পরনে ছিল কালো নকশি দ্বারা আবৃত একটি পশমি চাদর। হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) এলেন, তিনি তাঁকে চাদরের ভেতর প্রবেশ করিয়ে নিলেন। হজরত হোসাইন ইবনে আলী (রা.) এলেন, তিনিও চাদরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লেন। হজরত ফাতিমা (রা.) এলেন, তাকেও ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললেন। তারপর হজরত আলী (রা.) এলেন তাকেও ভেতরে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর বললেন (সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াত পাঠ করলেন)- হে আহলে বাইত! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূর করে তোমাদের পবিত্র করতে চান।

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী (মূল্যবান) জিনিস (আমানত হিসেবে) রেখে যাচ্ছি। যদি তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধর তবে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। সেগুলো একটি অপরটির উপর প্রধান্য রাখে। (সেগুলো হচ্ছে) আল্লাহর কিতাব যা আসমান হতে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত (রহমতের) ঝুলন্ত রশির ন্যায় এবং অপরটি হলো আমার বংশধর; আমার আহলে বাইত। এরা হাউযে কাওসারে আমার সঙ্গে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও একে অপর হতে আলাদা হবে না। অতএব, তোমরা লক্ষ্য রেখ যে, আমার (ছেড়ে যাওয়া) আমানতের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করো। (সূত্র: সুনানে তিরমিযি, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৬৬৩)।

ইবনে আদি ‘আল ইক্বলীল’ গ্রন্থে হযরত আবু সাঈদ খুদুরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের আহলে বাইতকে ঘৃণা করে সে মুনাফিক। (মুসনাদে আহমদ)। এই হাদীসগুলো বর্ণনা করে শিয়ারা আয়েশা (রাঃ) সহ বহু সাহাবীকে কাফের বলে আ্যাখায়িত করে। অথচ আহলে বায়াতকে প্রকৃত সাহাবীরা কেউ ঘৃণা করতো না বরং ভালোবাসতো। জঙ্গে জামাল সংঘটিত হয় মুনাফেকদের ষড়যন্ত্র ও কুরআন, সুন্নাহ অনুযায়ী একতেলাফী সিদ্ধান্তের কারণে।

আয়েশা (রাঃ) সহ সাহাবীরা ভেবেছিলেন উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীরা আলী (রাঃ) এর দলে তার কারণে তারা আশ্রয় পাচ্ছে। তাই তারা কুরআনের আয়াতের অনুসরণ করেন-

“আর মুমিনদের দু’দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও; অতঃপর তাদের একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে, যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহ্‌র নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি তারা ফিরে আসে, তবে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে আপোষ মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ন্যায়বিচারকদেরকে ভালবাসেন।” (সুরা হুজুরাত -৯)।

তাই আলী (রাঃ), আয়েশা (রাঃ) সহ সাহাবীরা প্রথমে আলোচনা ও সন্ধি করতে চেয়েছিলেন পরবর্তীতে মুনাফেকদের ষড়যন্ত্রে যুদ্ধে পরিণত হয়। কারণ সাহাবীরা জানতেন প্রথমে কুরআন, এরপর সুন্নাহ, এরপর আহলে বায়াতকে মানতে হবে। কোন হাদীস কুরআনের বিপরীত প্রামাণিত হলে তা যেমন গ্রহনযোগ্য নয় তেমনি আহলে বায়াতের কোন সিদ্ধান্ত যদি কুরআন, হাদীসের বিপরীত মনে হয় তা গ্রহণ করা যাবে না। জঙ্গে জামাল উম্মতকে এই শিক্ষা দেয়। আর পরবর্তী ঘটনাচক্রে হাদীসগুলো একে একে প্রমাণ করে আলী (রাঃ) হক্বের পথে ছিলেন। ফলে যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধ ত্যাগ করে শহীদ হন, আয়েশা (রাঃ) তার ভূমিকার জন্য আফসোস করেন।

নবী ও রসুলদের পর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন আবুবকর (রাঃ)। অথচ খেলাফতকালে আবুবকর (রাঃ) এর কিছু সিদ্ধান্তে উমর (রাঃ) ভিন্নমত পোষণ করেন। পরে আবুবকর (রাঃ), উমর (রাঃ) এর সিদ্ধান্তকে সঠিক ভেবে মেনে নেন। উমর (রাঃ) অনেক সময় আলী (রা) এর মতকে মেনে নিতেন। কারণ একমাত্র রসুল (সাঃ) সব হাদীস জানতেন, বাকীরা অনেক হাদীস জানলেও সব হাদীস সবাই জানতেন না। তাই তারা পরস্পর আলোচনা করে জেনে নিতেন রসুলের (সাঃ) হাদীস অনুযায়ী সিদ্ধান্ত কি হবে!! এই বিষয়ে কে কতটা হাদীস জানে। ইসলামে এই ধরনের পরামর্শ বিভক্তি নয় বরং পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে। ফলে তারা কারো মুখে নতুন হাদীস শুনলে তার জন্য দোয়া করতেন তার বদৌলতে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে রক্ষা পেয়েছেন। অথচ আজ এগুলো নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। আহলে বায়াতের ক্ষেত্রেও সে নিয়মনীতিই ছিল।

জঙ্গে জামাল যুদ্ধের মূল ঘটনা হল- উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীর সন্দেহের তালিকায় অন্যতম প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ বিন আবুবকর (রহঃ)। মাতা ভিন্ন হলেও পিতার দিক হতে আয়েশা (রা) এর আপন ভাই। তার মাতার নাম আসমা বিনতে উনাইস। আবুবকর (রাঃ) এর মৃত্যুর পর আলী (রাঃ) তাকে বিয়ে করেন এবং মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর (রাঃ) তার গৃহে বড় হয়। ইতিহাস হতে যতটুকু জানা যায় – উসমানের (রাঃ) হত্যার দিন তিনিও উসমানের (রাঃ) গৃহে প্রবেশ করেন। কিন্তু যখন উসমান (রাঃ) তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন আবুবকর (রাঃ), উসমানকে (রাঃ) কিরূপ ভালোবাসতো তা শুনে তিনি গৃহ ত্যাগ করেন। কিন্তু ঘটনা ছড়িয়ে যায় – তিনি হত্যাকান্ডে শামিল হয়েছিলেন। তাই আয়েশা (রাঃ) তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধা করেননি। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ বিন আবুবকর (রাঃ) ছিলেন আলী (রাঃ) এর অন্যতম সেনাপতি। তারা জানতেন আলী (রাঃ) হক্বের পথে। জঙ্গে জামাল শেষে আলী (রাঃ) তাকেই দায়িত্ব দেন আয়েশাকে (রাঃ) সস্মানে পৌছিয়ে দিতে।

ঘটনাপ্রবাহ যখন হাদীসের সাথে সুস্পষ্ট মিলে যায় তখন আয়েশা (রাঃ) বুঝেন আলী (রাঃ) সত্যের পথে অটল আছেন। তাই পরবর্তীতে তিনি তা ঘোষণা করতেও দ্বিধা করেননি।

এটাই ইসলামের শিক্ষা, শত্রুতা ও ভালোবাসা শুধু ইসলামের জন্য।

উষ্ট্রের যুদ্ধের পর যখন হযরত আয়েশা (রাঃ) বসরায় অবস্থান করছিলেন তখন তাঁর ভাই মুহম্মদ বিন আবুবকর উম্মুল মুমেনীনকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনি আমাকে ঐ কথা বলুন যা আপনি এক সময় আমাকে রসুলের (সাঃ) বরাত দিয়ে বলেছিলেন যে, সত্য সব সময় আলীর সাথে থাকবে এবং এই দুই কখনো একে অন্য থেকে আলাদা হবে না। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ ইহা অবশ্যই সত্যি কথা। লোকেরা তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করল তাহলে আপনি আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন কেন? উত্তরে উম্মুল মুমেনীন বল্লেন : আল্লাহ আলী (আঃ) এর উপর দয়া করুন, তিনি অবশ্যই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত কিন্তু আমি এমন একজন স্ত্রীলোক ছিলাম যে পিতৃকূলের লোকদের প্রভাবাধীনে ছিলাম।

হযরত আলী (আঃ) এর মাহাত্ম সম্পর্কে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস এই হাদিস বর্ণনা করলে মুয়াবিয়া (রাঃ) এই হাদিসের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করেন এবং তাকে উম্মুল মুমেনীন হযরত সালমা (রাঃ) এর নিকট ইহার সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে হযরত সালমাও (রাঃ) হযরত আলীর (আঃ) সত্যের পথে অধিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসটি অবশ্যই সত্য বলে প্রত্যায়ন করেন।

বেশিরভাগ আলেম সমাজ ইতিহাস হতে জঙ্গে জামাল আলোচনা করতে গিয়ে এমন একটা ধারণা দেয় – এগুলো আলোচনা করলে ফেতনা ছড়াবে। অথচ রসুলুল্লাহর (সাঃ) হাদীস উম্মতকে ফেতনা মেকাবেলার পথ দেখায় এটা মুসলিমদের আকীদা।

শিয়ারা আবুবকর (রাঃ) সহ অনেককে কাফের বলে। অথচ আবুবকরের (রাঃ) ছেলে মুহাম্মদ বিন আবুবকর (রহঃ), তার ছেলে কাসিম (রহঃ) এবং কাসিমের (রহঃ) মেয়ে ফাতেমা, যিনি ছিলেন শিয়াদের সবচেয়ে বড় ঈমাম জাফর সাদিকের (রহঃ) মা। এই হতে বুঝা যায় প্রথম দিকে শিয়ারা আবুবকর (রাঃ), উমর (রাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করত।

আজ আহলে বায়াতের ভালোবাসার নামে একদল শিরক ছড়াচ্ছে আর শিয়ারা অনেকে (বিশেষ করে বনু কাল্বের বাশারের সৈন্যরা) ইরাক, সিরিয়ায় প্রকৃত আহলে বায়াতকে হত্যা করছে। আর একদল আলেম মুখে আহলে বায়াতকে ভালোবাসে দাবি করে অথচ আহলে বায়াতের সুন্নাহ বাদ দিয়ে মনগড়া ওয়াজ করে।

অথচ জঙ্গে জামাল ও যুবাইর (রাঃ) এর জীবন হতে শিক্ষা হল- যখন হাদীসের নির্দেশ মিলে যাবে মিডিয়া, লোকচক্ষু, প্রচারণা বাদ দিয়ে হাদীসের অনুসরণ করা উচিত।

অবাক করা ব্যাপার হল ঈমাম মাহাদী (হাফিঃ) এর সাথে ১ম যার যুদ্ধ হবে সে সুফিয়ানী নামে জনপ্রিয় হবে। সে সিরিয়ার ক্ষমতা পাবে ও ইয়াজিদের বংশধর হবে। যার সৈন্যরা বেশিরভাগ বনু কাল্ব গোত্রের যাদের বর্তমান অবস্থান সিরিয়ার লাটাকিয়ায় যারা বর্তমানে সিরিয়ার ক্ষমতায় আছে। মুসলিম ও আল ফিতানের হাদীস অনুযায়ী সুফিয়ানী বাগদাদ, মসুল, মদীনায় আহলে বায়াতসহ অনেক কোরাইশ ও মুজাহিদদের হত্যা করবে। পরে ঈমাম মাহাদী (হাফিঃ) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। হাদীসে এই যুদ্ধকে কাল্বের যুদ্ধ বলা হয়েছে।

বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে আসবে ইনাশাল্লাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *