সারাবিশ্ব মহামারী আতঙ্কে প্রকম্পিত, মৃত্যুর মিছিল কিছুটা যদিও কমেছে। বিশ্বের ইতিহাসে এই মহামারী নতুন নয়। মহামারী হঠাৎ আসে আবার আল্লাহর ইশারায় হঠাৎ শেষ হয়ে যায়, তবে বোকামি ও অজ্ঞতায় ভুগতে হয় অনেকদিন। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। সারাবিশ্ব যখন স্প্যানিশ ফ্লুতে কাঁপছিল তখন ভারতে এর তেমন প্রভাব ছিল না। কিন্তু শেষে ভারতেই মারা যায় দুই কোটি। দুঃখজনক হল বর্তমানে গবেষণা করে এমন ইসলামি বক্তার বড়ই অভাব। ২-১ টা হাদীস দিয়ে মহামারীর ব্যাখা করছে সবাই। রসুলের (সাঃ) হাদীসে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন সতর্ক হওয়ার জন্য। রসুলুল্লাহ (সাঃ) ছয়টি ভবিষ্যৎবানী করেন-
- রসুলুল্লাহর (সাঃ) ইন্তেকাল
- বায়তুল মাকদিস বিজয় (জেরুজালেম)
- ছাগব্যধি সদৃশ মহামারীতে তোমাদের ব্যাপক প্রাণহানী
- ধনসম্পদ বৃদ্ধি, এমনকি কাউকে একশ দিনার দিতে চাইলে সে ক্রোধান্বিত হবে
- এমন ফেতনা, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে
- মুসলিম ও রোমানদের (সম্ভবত ইউরোপ) শান্তিচুক্তি হবে পরে রোমানরা চুক্তি ভঙ্গ করে ৮০ টা পতাকাতলে ১২০০০ সৈন্য মানে মোট ৯ লক্ষ ৬০০০০ সৈন্য নিয়ে সিরিয়ার আমাক ও দাবিকে যুদ্ধ করবে। (বুখারী, মুসলিম)।
অনেক ওলামাদের মতে এখানে যে মহামারির কথা বলা হয়েছে তা উমর (রাঃ) এর খেলাফতকালে ফিলিস্তিনের আমওয়াস শহরে সংঘটিত হয়। যার ফলে শুধু মুসলিমই মারা যায় ৫০ হাজার যার মধ্যে ২৫ হাজার রসুলের (সাঃ) সাহাবী। যাদের মধ্যে রসুলের (সাঃ) অতি প্রিয় বিশ্বস্ত সাহাবী আবু উবাইদা (রাঃ) অন্যতম। ছাগলের নাক বেয়ে রক্ত বা পানির মত কিছু প্রবাহিত হওয়ার ফলে এক রোগের সৃষ্টি হয়, এ ধরণের রোগাক্রান্ত সব ছাগল দ্রুত মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মানুষের দেহের কোথাও ফুলে গিয়ে সেখান হতে রক্ত বা পানি জাতীয় কিছু প্রবাহিত হতে থাকে, দেখতে দেখতে আক্রান্ত ব্যক্তি মরে যায়। তখনকার সময় সাহাবীরা কিছু উদ্যোগ নেন তা এই যুগেও প্রযোজ্য।
১. আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস। তারা রসুলের (সাঃ) হাদীসে এতটা বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহর উপর ভরসা করে যদি মুমিন মহামারীতে মারা যায় সে শহীদ। মহামারী মূলত জালেমের জন্য আযাব, মুমিনের জন্য রহমত। রসুলের (সাঃ) ২৫ হাজার সাহাবী যদি কোন যুদ্ধে শহীদ হত তাহলে হয়ত অনেক মুসলিমদের মনোবল কমে যেত। কিন্তু এই সাহাবীদের ইচ্ছেই ছিল শহীদ হওয়া, আল্লাহ মহামারীতে মৃত্যু দিয়ে তাদের ইচ্ছে পূরণ করেন। তাই তো সেনাপতি আবু উবাইদা (রাঃ) মৃত্যুর পূর্বে ভাষণে বলেন- হে লোক সকল! এই রোগ তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের দয়া। এটি তোমাদের পূর্বে তোমাদের নবীর দোয়ার ফলশ্রুতি এবং তোমাদের পূর্বে নেককার লোকদের মৃত্যুর বাহন। তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন যেন এই রোগ ভোগ করে তিনি তার সুফল অর্জন করতে পারেন। তিনি মহামারীতে মারা যান। তার স্হলে মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) কে প্রধান করা হয়। তিনিও আবু উবাইদার মত অনুরূপ ভাষণ দেন এবং প্রার্থণা করেন এই রোগের সুফল তার পরিবারের লোকেরা অর্জন করে। তার ছেলে ও তিনি মহামারিতে শহীদ হন। ঐ যুগে শুধু একটা এলাকায় ৫০ হাজার মুসলিমের মৃত্যু হয়েছিল। জানাযা ও মসজিদে সালাত পড়া হয়েছিল আর উমর (রাঃ) তখন খলিফা। তিনি বাধা দেন নি!! ইসলাম উমর (রাঃ) ও সাহাবীরা ভালো বুঝতেন না বর্তমান মানুষেরা। যেখানে জানাযার জন্য মানুষ পায় না। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৭ম খন্ড-১৪৭ পৃঃ)। অনেকে সিজদাহ অবস্হায় মৃত্যু কামনা করে অথচ অসুস্হতার ভয়ে মসজিদে সালাতে যায় না।
২. হাদীস অনুযায়ী উমর (রাঃ) ও সাহাবীরা মহামারী এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করেন এবং মহামারী এলাকায় অবস্হিত লোক যেনো ঐ এলাকা ছেড়ে না আসেন সে আমল করেন (বুখারী, মুসলিম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৭ম খন্ড)। উমর (রাঃ) নির্দেশ দেন স্যাতস্যাতে এলাকা ছেড়ে শুকনো এলাকায় চলে যেতে।
৩. রোগীর আশেপাশে ভিড় করতে নিষেধ করেন । যদিও ইসলামে ছোয়াছে বলে কোন রোগ নেই (বুখারী)। অর্থাৎ অতীতে মানুষ ভাবত অমুক রোগীর দেবী-দেবতা অমুক বেশে এসে রোগ ছড়াত। কিন্তু ইসলাম জানায় – রোগ নিজ হতে সিন্ধান্ত নিয়ে কারো শরীরে প্রবেশ করতে পারে না তার সেই ক্ষমতা নেই। আল্লাহ যার শরীরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয় শুধু তার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যদি নিজ ইচ্ছেমত রোগ ছড়াত ফুটপাতের শিশুগুলো বাঁচত না অথচ তারাই ভালো আছে মরছে উন্নত দেশের দামী অট্টালিকার বাসিন্ধারা। তবুও সতর্কতা অবলম্বন করে দূরে অবস্থান করা উচিত কারণ আগুন যেমন আল্লাহর ইশারা ছাড়া পুড়ায় না, ইব্রাহিম (আঃ) তার উদাহরণ কিন্তু নিজ ইচ্ছায় আগুনের নিকটবর্তী হওয়া মূর্খতা। আল্লাহ ঘোষণা করেন নাই যে নিজ ইচ্ছায় আগুনের নিকটবর্তী হলে ইব্রাহিম (আঃ) এর মত আল্লাহ রক্ষা করবেন বরং স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি, বিবেক ব্যবহার করতে বলছেন। তেমনি যদি জানা যায় রোগী আশেপাশে আছে দূরে থাকাই উত্তম। আর যদি চারপাশে রোগের ছড়াছড়ি, ইব্রাহিম (আঃ) এর মত একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত। তবে অধিকাংশ আলেমরা ডাক্তার ও তথাকথিত বিজ্ঞানের সাথে তাল দিতে গিয়ে রসুল (সাঃ) এর হাদীসগুলো ভুল ব্যাখা করছেন যে- রাসুলল্লাহ (সাঃ) কুষ্ঠরোগীর হাত স্পর্শ করে বায়াত নেন নি। এটা এজন্য যে তখনকার যুগে আরবে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে অনেক লোকই আসত যাদের সকলের ঈমান ও জ্ঞান সমান ছিলো না। কেউ যদি উক্ত রোগীর কাছে আসল ও তারও সে রোগ হল তাহলে তার বিশ্বাস জন্মাবে উক্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে রোগ হয়েছে ফলে তার ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এই ধরনের রোগ জালেমের উপর আযাব ও মুমিনের জন্য রহমত, আর আযাব ও রহমত দেওয়ার মালিক আল্লাহ। মহামারীর সময় লোকজন সাহাবী আবু মুসার (রাঃ) গৃহে কুফায় একত্রিত হলেন হাদীস নিয়ে আলোচনার জন্য। আবু মুসা (রাঃ) বলেন- এই বাড়িতে একজন মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে। আপনারা যদি এই জনপদ ছেড়ে নিরাপদে আপনাদের শহরে ফিরে যান তাতে আপনাদের দোষ হবে না। রোগ কেটে গেলে আপনারা আবার আসবেন। আমি আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি – সেটি হল যদি কেউ রোগাক্রান্ত এলাকা হতে বেরিয়ে যায় এবং এই ধারণা করে যে ওখানে থাকলে তার মৃত্যু হত তা পরিতাজ্য। আবার যদি কেউ এই এলাকায় থেকে যায় এবং এক পর্যায়ে এই রোগে আক্রান্ত হয় তারপর তার ধারণা হয়, সে যদি বেরিয়ে যেত তাহলে অসুস্থ হতো না তাও অপছন্দীয় ও বর্জনীয়। যদি কেউ এমন ধারণা পোষন করা ব্যতীত ওই এলাকা থেকে বেরিয়ে রোগমুক্ত এলাকায় চলে যায় তাহলে তার কোন দোষ নেই। (ইবনে কাসীর- আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ৭ম খন্ড – ১৪৬ পৃঃ)। এখানে শিক্ষনীয় এই, ঈমানের সতর্কতার কারণে রসুলের (সাঃ) সাহাবীরা হাদীসের আলোচনায় লোকসমাগম বন্ধ রাখেন। তাদের চেয়ে আল্লাহভীরু ও ইসলামের জ্ঞানপিপাসু কে ছিল?
৪. আবু উবাইদা (রাঃ) ও মুআয (রাঃ) এর মৃত্যুর পর রসুলুল্লাহর (সাঃ) বিশিষ্ট সাহাবী আমর ইবনুল আস (রাঃ) প্রধান হন। তিনি ভাষন দেন- এই রোগের যখন প্রাদুর্ভাব হয় তখন আগুনের ন্যায় লেলিহান শিখা ছড়িয়ে জ্বলতে থাকে, তাই তিনি সবাইকে পাহাড়ে যেতে বলেন। তারপর লোকজন ছড়িয়ে যায়। এই দিকে আল্লাহ তাআলা এই রোগ তাদের হতে তুলে নেন।