ইসলামের নামে শত শত মিথ্যা চলছে,ল।তাতে যতটা না বাধা আসে, তার চেয়ে বেশি বাধা আসে প্রকৃত দ্বীন প্রচারে। সত্য বললে, বিদআত-কুফরের বিরোধিতা করলে ঐক্য ভেঙ্গে যাবে, আমাদের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে, দুর্বল হয়ে যাবে উম্মাহ এজন্য অনেকে সত্য আড়াল করতে চায়, কেউ জানালে ফেতনাবাজ অভিহিত করে।
আসুন জানি- সাহাবীদের জীবনী হতে তারা কি সত্যকে পাশ কাটিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের চিন্তা করতো! নাকি সত্যের সর্বোচ্চ ত্যাগ দিতে রাজি ছিল।
১ম ঘটনা
ইসলাম গ্রহনের পর মুসলিমদের উপর জুলুম, নির্যাতন শুরু হয়েছিল, অবশেষে আবিসিনিয়া হিজরতের নির্দেশ এলো।
আবু বকর (রা:) ও হিজরতের উদ্দেশ্য যাত্রা করেছিলেন -কিছুপথ অতিক্রম করার পর ইবনে দাগিন্নার সাথে দেখা। ইবন দাগিন্না জানতে চেয়েছিলেন – আবু বকর (রা:) কোথায় যাচ্ছে? আবু বকর(রা:) তার উপর জুলুম নির্যাতনের কথা বর্ননা করলেন। ইবনে দাগিন্না জানতেন আবু বকর (রা:) অতি উত্তম ব্যক্তি। তিনি বললেন – আপনি মক্কায় ফিরে যান, আপনি আমার আশ্রয়ে থাকবেন। ইবনে দাগিন্না কোরাইশদের জানান – তিনি আবু বকরকে (রা:) আশ্রয় দিয়েছেন, কেউ যেন তার প্রতি অসদাচরণ না করে। কোরাইশরাও কিছুদিন তার প্রতি নির্যাতন হতে বিরত থাকে।
কিছুদিন পর আবু বকর (রা:) নিজগৃহের পাশে মসজিদ তৈরি করে সালাত ও কুরআন তেলওয়াত করতেন। তিনি সালাতে অনেক কান্নাকাটি করতেন, তার ইবাদত মুশরিক নারী ও শিশুদের আকৃষ্ট করতে লাগলো।
তা দেখে কুরায়েশরা ইবনে দাগিন্নার কাছে গিয়ে জানালো- তোমার আশ্রয়ে আমরা আবু বকরের অবস্থান মেনে নিয়েছিলাম যে সে নিজগৃহে ইবাদত করবে। অথচ সে মসজিদ তৈরি করে সালাত আদায় ও কুরআন তেলাওয়েত করছে। আমরা আশংকা করছি আমাদের নারী, শিশু বিভ্রান্ত হবে। আবু বকরকে বলো সে যেন নিজগৃহে ইবাদত করে অথবা তোমার জিম্মাদারী ফিরিয়ে দেও। এরপর ইবনে দাগিন্না, আবু বকর (রা:) এর কাছে গিয়ে জানালেন – তার ইবাদত নিজগৃহে সীমাবদ্ধ রাখতে অথবা তার আশ্রয়জনিত জিম্মাদারী মুক্ত ঘোষণা করতে।
আবু বকর (রা:) বলেছিলেন – আমি বরং তোমার জিম্মাদারী তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি এবং মহান আল্লাহর নিরাপত্তায় আমি সন্তুষ্ট। (বুখারী, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৩য় খন্ড, সংক্ষিপ্ত)
খেয়াল রাখুন- কাফের, মুশরিক ও ইসলামের শত্রুরা ভয় পায় যে মুসলিমরা প্রকাশ্যে সত্য দ্বীন মানলে, প্রচার করলে এর আকর্ষণে মানুষ তাদের ধর্মকে পরিত্যাগ করে প্রকৃত ইসলাম গ্রহন করতে পারে – তাই এভাবে কেউ প্রকাশ্য ইবাদত করলে তাকে ফেতনা/বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী অভিহিত করতো। তার ইবাদত দেখে আকৃষ্ট হলে – বিভ্রান্ত হওয়ার অজুহাত দাড় করিয়ে বাধা সৃষ্টি করতো।
কঠিন পরিস্থিতিতে যখন শেষ আশ্রয়টুকু শেষের পথে- আবু বকর (রা:) আল্লাহর উপর ভরসা করে সত্য দ্বীন প্রচার ও ইবাদত বন্ধ রাখেননি। কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছিল, আবু বকর (রা:) এর তেলাওয়াত শুনে মুশরিকরা সত্য-মিথ্যা বুঝতে পারতো ও আকৃষ্ট হতো।
আল্লাহ বলেন-
নিশ্চয় আমি এই কুরআনকে আরবী ভাষায় বানিয়েছি যাতে তোমরা বুঝতে পার।” সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৩
আজও একই ষড়যন্ত্র বিদ্যমান – যখন কুরআন, সুন্নাহর দিকে আহ্বান করা হয়, ফেতনা সৃষ্টিকারী অভিহিত করে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
২য় ঘটনা
যখন মুসলিমরা হাবশায় হিজরত করলেন। কোরাইশরা সাহাবীদের হাবশায় হিজরতের ঘটনা জানতে পেরে তাদের মধ্য থেকে শক্তিমান ও তাগড়া জোয়ান দু’ব্যক্তিকে নির্বাচন করে নাজ্জাশীর কাছে পাঠাল। দু’ব্যক্তি হল, আমর ইবনুল ’আস ও আবদুল্লাহ ইবন আবী রাবীয়া।
তারা দু’জন নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে উপঢৌকন পেশ করল। উপঢৌকনগুলি নাজ্জাশীর খুবই পছন্দ হল। তিনি সেগুলির ভূয়সী প্রশংসা করলেন। অতঃপর তারা বাদশাহকে বললঃ ‘‘মহামান্য বাদশাহ, আমাদের কিছু দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে আপনার সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেছে। তারা এমন একটি ধর্ম আবিষ্কার করেছে যা আমরাও জানিনে এবং আপনিও জানেন না। তারা আমাদের দ্বীন পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু আপনাদের দ্বীনও গ্রহণ করেনি। তাদের পিতা, পিতৃব্য ও গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। তাদের সৃষ্ট অশান্তি ও বিপর্যয় সম্পর্কে তাদের গোত্রীয় নেতারাই অধিক জ্ঞাত।’’
নাজ্জাশী তাঁর দরবারে উপস্থিত পাদ্রীদের দিকে তাকালেন। তারা বললঃ ‘মহামান্য বাদশাহ, তারা সত্য কথাই বলেছে। কারণ তাদের গোত্রীয় নেতারাই তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। গোত্রীয় নেতাদের নিকট আপনি তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিন, যাতে গোত্রীয় নেতারা তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’ পাদ্রীদের কথায় বাদশাহ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হলেন। বললেনঃ ‘‘আল্লাহর কসম! তা হতে পারেনা। তাদের প্রতি যে অভিযোগ আরোপ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ না করা পর্যন্ত একজনকেও আমি সমর্পণ করব না। সত্যিই তারা যদি এমনই হয় যেমন এ দু’ব্যক্তি বলছে, তাহলে তাদেরকে সমর্পণ করব। তা না হলে তারা যতদিন আমার আশ্রয়ে থাকতে চায়, আমি তাদেরকে নিরাপত্তার সাথে থাকতে দেব।’’
উম্মু সালাম বলেনঃ ‘‘অতঃপর নাজ্জাশী আমাদেরকে ডেকে পাঠালেন তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য। যাওয়ার আগে আমরা সকলে একস্থানে সমবেত হলাম। আমরা অনুমান করলাম, নিশ্চয় বাদশাহ আমাদের নিকট আমাদের দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যা আমরা বিশ্বাস করি তা প্রকাশ করে দেব। আর সবার পক্ষ থেকে জা’ফর ইবন আবী তালিব কথা বলবেন। অন্য কেউ কোন কথা বলবে না।’’
অত:পর জাফর বিন আবু তালেব (রা:) বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য দিলেন এবং নাজ্জাশী যখন রসুলের (সা:) উপর যা নাযিল হয়েছে তা হতে তেলাওয়েত করতে বললেন –
জা’ফর (রা) পাঠ করলেনঃ ‘‘কাফ্-হা-ইয়া-আইন-সাদ। এ তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়ার প্রতি। যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করেছিল গোপনে। সে বলেছিল, ‘আমার অস্থি দুর্বল হয়েছে, বার্ধক্যে আমার মস্তক সাদা হয়েছে; হে আমার প্রতিপালক! তোমাকে আহ্বান করে আমি কখনও ব্যর্থকাম হইনি।’’ এভাবে তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা মরিয়মের প্রথম অংশ পাঠ করে শুনালেন।
আল্লাহর কালাম শুনে নাজ্জাশী এত কাঁদলেন যে অশ্রুধারায় তার চোখ সিক্ত হয়ে গেল এবং দরবারে উপস্থিত পাদ্রীরা কেঁদে তাদের সম্মুখে উন্মুক্ত ধর্মগ্রন্থসমূহ ভিজিয়ে দিল। কিছুটা শান্ত হয়ে নাজ্জাশী বললেনঃ ‘তোমাদের নবী যা নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্বে ঈসা (আ) যা নিয়ে এসেছিলেন উভয়ের উৎস এক। অতঃপর আমর ও তার সংগীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা চলে যাও। আল্লাহর কসম! তোমাদের হাতে আমি তাদেরকে সমর্পণ করব না।’
উম্মু সালামা বলেনঃ আমরা নাজ্জাশীর দরবার থেকে বেরিয়ে এলে আমর ইবনুল আস আমাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার সংগীকে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আগামীকাল আবার আমরা বাদশাহর নিকট আসব এবং তাঁর নিকটে তাদের এমন সব কার্যকলাপ তুলে ধরব যাতে তাঁর হৃদয়ে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে এবং তাদের প্রতি ঘৃণায় তাঁর অন্তর পূর্ণ হয়ে যায়। তাদেরকে সম্পূর্ণ উৎখাত করার জন্য আমরা অবশ্যই বাদশাহকে উৎসাহিত করব।’
পরদিন আবার আমর নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললঃ ‘মহামান্য বাদশাহ! এসব লোক, যাদেরকে আপনি আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করছেন, তারা ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে একটা মারাত্মক কথা বলে থাকে। আপনি তাদের কাছে লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখুন তারা তাঁর সম্পর্কে কি বলে।’
উম্মু সালামা বলেনঃ আমরা একথা জানতে পেয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় পড়লাম। আমরা পরস্পর পরস্পরকে জিজ্ঞেস করলামঃ ‘বাদশাহ যখন ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা তখন কি বলবে? ‘সবাই ঐকমত্যে পৌছলাম; তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ যা বলেছেন তার অতিরিক্ত আর কিছুই আমরা বলব না। আমাদের নবী তাঁর সম্পর্কে যা কিছু এনেছেন তা থেকে আমরা এক আংগুলের ডগা পরিমাণও বাড়িয়ে বলবনা। তাতে আমাদের ভাগ্যে যা থাকে তা-ই হবে।
আমাদের পক্ষ থেকে এবারও জা’ফর ইবন আবী তালিব কথা বলবেন। নাজ্জাশী আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমরা তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, পাদ্রীরা পূর্বের দিনের মত একই বেশভূষায় বসে আছে। আমর ইবনুল আস ও তার সংগী সেখানে উপস্থিত হতেই বাদশাহ আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে তোমরা কি বলে থাক?’
জা’ফর ইবন আবী তালিব বললেনঃ ‘আমাদের নবী তাঁর সম্পর্কে যা বলেন তার অতিরিক্ত আমরা কিছুই বলিনে।’
‘তিনি কি বলে থাকেন?’
‘তিনি বলেনঃ তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি তার রূহ ও কালাম- যা তিনি কুমারী ও পবিত্র মরিয়মের প্রতি নিক্ষেপ করেছেন।’
জা’ফরের কথা শুনে নাজ্জাশী হাত দ্বারা মাটিতে আঘাত করতে করতে বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম! ঈসা ইবন মরিয়ম সম্পর্কে তোমাদের নবী যা বলেছেন তা একটি লোম পরিমাণও অতিরঞ্জন নয়।’ একথা শুনে নাজ্জাশীর আশেপাশে উপবিষ্ট পেট্রিয়ার্করা তাদের নাসিকাছিদ্র দিয়ে ঘৃণাসূচক শব্দ বের করল।
বাদশাহ বললেনঃ ‘তা তোমরা যতই ঘৃণা কর না কেন।’ তারপর তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ যাও, তোমরা স্বাধীন ও নিরাপদ। কেউ তোমাদের গালি দিলে বা কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তার বদলা নেওয়া হবে। আল্লাহর কসম! আমি সোনার পাহাড় লাভ করি, আর তার বিনিময়ে তোমাদের কারও ওপর সামান্য বিপদ আপতিত হোক- এটাও আমার পছন্দনীয় নয়। এরপর তিনি আমর ও তার সংগীর দিকে ফিরে বললেনঃ ‘এ দু’ব্যক্তির উপঢৌকন তাদেরকে ফেরত দাও। আমার সেগুলি প্রয়োজন নেই।’
উম্মু সালামা বলেনঃ এভাবে আমর ও তাঁর সংগীর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হল এবং তারা ভগ্ন হৃদয়ে পরাজিত ও হতাশ অবস্থায় দরবার থেকে বেরিয়ে গেল। আর আমরা উত্তম বাসগৃহে সম্মানিত প্রতিবেশীর মত নাজ্জাশীর নিকট বসবাস করতে লাগলাম। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, বুখারী, সংক্ষিপ্ত)
আহ!! আজ আমরা সামান্য ভয়ে সত্য দ্বীন লুকিয়ে রাখি অথচ সেদিন ছিল সাহাবীদের সর্বোচ্চ হারানোর ভয়। নিশ্চয়ই এই দ্বীনকে আল্লাহ বিজয়ী করবেন। তারা আশ্রয়, সাহায্য হারানোর ভয়ে সত্য বলা হতে বিরত থাকেন নি বা হিকমাহর নামে এড়িয়ে যান নি। আর আশ্রয়কারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। বরং যখন সত্য দাওয়াহ দেওয়া হবে – কিছুলোক ঈমান এনে মুসলিমদের সাহায্য করবে আর ইসলাম বিরোধীদের প্রকৃত চরিত্র স্পষ্ট হবে।