সুস্বপ্ন ও দুষ্ট স্বপ্ন

প্রতিটি মানুষ ঘুমালে কোন না কোন স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নগুলোর কিছু তাকে আনন্দিত করে কিছু আতংকিত করে। মানুষ কেন স্বপ্ন দেখে- বুখারী, মুসলিমসহ বহু হাদীসগ্রন্থে স্বপ্নের আলাদা অধ্যায় আছে। হাদীসমতে- স্বপ্ন দুপ্রকার।

  • আল্লাহর তরফ হতে সত্যস্বপ্ন
  • শয়তানের তরফ হতে ভয়, ভীতি, অশ্লীলতা ও প্রতারণামূলক স্বপ্ন।

ইবনে সীরানের মতে, নফসের কারণে বা মানুষ সারাদিন যা কর্ম করে তা স্বপ্ন দেখে। তবে অন্য আলেমদের অভিমত এটাও শয়তানের পক্ষ হতে। মানুষ যতকাজই করুক সবই স্বপ্নে দেখে না, শয়তান নির্দিষ্ট কিছু দেখিয়ে প্রতারিত করে। স্বপ্ন বিষয়ে জানাটা জরুরি কারণ এদেশের বেশিরভাগই সুফিবাদ স্বপ্নের উপর ভিত্তি করে চলছে।

১. আল্লাহর তরফ হতে- নবীদের স্বপ্ন ওহী কিন্তু কুরআনের কোনও আয়াত স্বপ্নের মাধ্যমে আসে নি। রসুলের (সাঃ) কাছে জিবরাইল (আঃ) ওহী নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত টানা ৬ মাস স্বপ্ন দেখেন যা সত্যে পরিণত হতো। আল্লাহর তরফ হতে যে স্বপ্ন দেখানো হয় তা সুস্পষ্ট মনে থাকবে এবং তা সত্যে পরিণত হবে। তার মানে এই নয় তা শ্রীঘ্রই সত্যি হবে। অনেক সময় স্বপ্ন সত্য হতে সময় লাগে। যেমন- ইউসুফ (আঃ) এর স্বপ্ন বহুবছর পর সত্য হয়। স্বপ্নের ব্যাখা বর্ণনা একান্ত বিশ্বস্ত আলেম ছাড়া কাউকে জানানো উচিত নয় এতে হিংসা, শত্রুতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- ইয়াকুব (আঃ) ইউসুফকে (আঃ) তার ভাইদের স্বপ্ন জানাতে নিষেধ করেন। শুধুমাত্র একটা হাদীস পাওয়া যায় রসুল (সাঃ) আল্লাহকে স্বপ্ন দেখেছেন। এছাড়া আর কোন রসুলগণ দেখেন নি। অথচ এদেশে কত আজগুবি ওয়াজ চলে অমুক আলেম এতবার আল্লাহকে স্বপ্ন দেখেছেন। মু’আয ইবনু জাবাল (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদিন প্রত্যুষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাথে ফজরের নামায আদায় করতে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হন। এমনকি আমরা সূর্য উদিত হয়ে যাওয়ার আশংকা করলাম। তিনি তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলে সালাতের জন্য ইকামাত দেয়া হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে সালাত আদায় করলেন। তিনি সালাম ফিরানোর পর উচ্চস্বরে আমাদেরকে ডেকে বললেনঃ তোমরা যেভাবে সারিবদ্ধ অবস্থায় আছ সেভাবেই থাক। তারপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে বসলেন অতঃপর বললেনঃ সকালে তোমাদের নিকট আসতে আমাকে কিসে বাধাগ্রস্ত করেছে তা এখনই তোমাদেরকে বলছি। আমি রাত্রে উঠে উযূ করলাম এবং সামর্থ্যমত নামায পড়লাম। নামাযের মধ্যে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। অতঃপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, এমন সময় আমি আমার বারাকাতময় প্রভুকে খুব সুন্দর অবস্থায় (স্বপ্নে) দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ। আমি বললামঃ প্ৰভু! আমি উপস্থিত। তিনি বললেন, উর্ধ্বজগতের অধিবাসীগণ (শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাগণ) কি ব্যাপারে বিতর্ক করছে? আমি বললামঃ প্ৰভু! আমি জানি না। আল্লাহ তা’আলা এ কথা তিনবার বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি তাকে দেখলাম যে, তিনি তার হাতের তালু আমার দুই কাঁধের মাঝখানে রাখলেন। আমি আমার বক্ষস্থলে তার হাতের আঙ্গুলের শীতলতা অনুভব করলাম। ফলে প্রতিটি জিনিস আমার নিকট আলোকোদ্ভাসিত হয়ে উঠল এবং আমি তা জানতে পারলাম। আল্লাহ তা’আলা বললেন, হে মুহাম্মাদ! আমি বললামঃ প্ৰভু! আমি আপনার নিকট হাযির। তিনি বললেন, উর্ধ্বজগতের বাসিন্দাগণ কি ব্যাপারে বিতর্ক করছে? আমি বললামঃ কাফফারাত প্রসঙ্গে (তারা বিতর্ক করছে)। তিনি বলেন, সেগুলো কি? আমি বললামঃ হেঁটে সালাতের জামা’আতসমূহে হাযির হওয়া, নামাযের পর মসজিদে বসে থাকা এবং কষ্টকর অবস্থায়ও উত্তমরূপে উযূ করা। তিনি বললেন, তারপর কি ব্যাপারে (তারা বিতর্ক করেছে)? আমি বললামঃ খাদ্যপ্রার্থীকে আহার্যদান, নম্রতার সাথে কথা বলা এবং রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে সেই সময় সালাত আদায় করা প্রসঙ্গে। আল্লাহ তা’আলা বললেন, তুমি কিছু চাও, বলঃ “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ভাল ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদনের, মন্দ কাজসমূহ বর্জনের, দরিদ্রজনদের ভালবাসার তাওফীক চাই, তুমি আমায় ক্ষমা কর ও দয়া কর। তুমি যখন কোন গোত্রকে বিপদে ফেলার ইচ্ছা কর তখন তুমি আমাকে বিপদমুক্ত রেখে তোমার কাছে তুলে নিও। আমি প্রার্থনা করি তোমার ভালবাসা, যে তোমায় ভালবাসে তার ভালবাসা এবং এমন কাজের ভালবাসা যা তোমার ভালবাসার নিকটবর্তী করে দেয়।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ স্বপ্লটি অবশ্যই সত্য। অতএব তা পড়, তারপর তা শিখে নাও। সহীহঃ মুখতাসার আল উলুব্বি (১১৯/৮০), আয যিলা-ল (৩৮৮)। আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। আমি মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈলকে এ হাদীস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, এ হাদীস হাসান সহীহ। তিনি আরো বললেন, ‘আবদুর রহমান ইবনু ইয়াযীদ ইবনু জাবির হতে ওয়ালীদ ইবনু মুসলিম বর্ণিত হাদীসের তুলনায় উক্ত হাদীস অনেক বেশী সহীহ। খালিদ ইবনুল লাজলাজ-আবদুর রহমান ইবনু আয়িশ আল-হাযরামী (রাযিঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি…। এ হাদীসটি সংরক্ষিত। অনেকে দাবি করেন রসুলকে (সাঃ) স্বপ্নে দেখেছেন। আসলে খুব কম সাহাবীই রসুলকে স্বপ্ন দেখেছেন। রাসূল (সাঃ) কে স্বপ্নে দেখা সম্ভব কি? আর রাসূলকেই যে দেখেছি, এটা কিভাবে নিশ্চিত হব? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখলে কি জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে? রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখার জন্য কোন নির্দিষ্ট আমল আছে কি?

প্রথমতঃ রাসূল (সাঃ) কে স্বপ্নে দেখা সম্ভব। রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

مَن رآني في المنام فسيراني في اليقظة ، ولا يتمثل الشيطان بي

“যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখবে, সে অচিরেই বাস্তবে আমাকে দেখবে। কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারন করতে পারে না।” (সহীহ বুখারী/৬৫৯২, সহীহ মুসলিম/২২৬৬)

দ্বিতীয়তঃ শয়তান রাসূল (সাঃ) এর আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম না হলেও, সে অন্য কারো আকৃতি ধরে ধোকা দিতে পারে যে, আমিই মুহাম্মদ। এই জন্য কোন ব্যক্তি আসলেই রাসূল (সাঃ) কে স্বপ্নে দেখেছেন কি না, এটা নিশ্চিত হওয়ার উপায় হলো, স্বপ্নে দেখা সূরত হাদিসে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এর সূরতের সাথে মিল থাকতে হবে। তাবেঈ কুলাইব (রহঃ) একবার আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে বললেন যে, আমি স্বপ্নে রাসূল (সাঃ) কে দেখেছি। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আকৃতির বিবরণ দাও। জবাবে কুলাইব (রহঃ) বললেন, তাঁর চেহারা হাসান (রাঃ) এর মত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, তুমি সত্যই রাসূল সা. কে দেখেছো। (ফাতহুল বারী ১২/৩৮৩-৩৮৪) والله أعلم. মুমিন ব্যক্তি স্বপ্নে নবী-রাসূলগণকে দেখতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল, সে সত্যি আমাকেই দেখল। কারণ শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে পারে না’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত ‘স্বপ্ন’ অধ্যায়, হা/৪৬০৯-১০)। তবে যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে তাঁর জীবদ্দশায় দেখে নি, সে ব্যক্তি স্বপ্নে তাঁকে দেখার ব্যাপারে নিশ্চিত হবে কিভাবে? নবীগণকে স্বপ্নে দেখার জন্য শরী‘আতে কোন আমল নেই। আর স্বপ্নে দেখার কারণে জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে এ কথাও ঠিক নয়। রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি পীরের দরগা আছে। সেখানে গিয়ে তাদের তরীকায় এক/দু’মাস মেহনত করলে নাকি রাসূলকে দেখা যায়। কেয়ামতের পূর্বে মুমিনের স্বপ্ন সত্যি হবে তার মানে এই নয় স্বপ্ন সত্যি হলে সে মুমিন। কাফেরের স্বপ্নও সত্যি হতে পারে- যেমনঃ ফেরাউন মুসা (আঃ) এর জন্মের পূর্বে এবং ইউসুফ (আঃ) এর সময় রাজা ও কয়েদীর স্বপ্ন। এটা আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল – মুসার (আঃ) আগমনের বার্তা জানাবেন। আর এই জাতি জাদু করত যত কিছুই করুক নির্দিষ্ট তাকদ্বীর বদলাতে পারে না এটা তার উদাহরণ। আর আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ইউসুফ (আঃ) কে প্রতিষ্ঠিত করবেন তার দ্বীন ছড়াবেন। স্বপ্নে কোন বিধান যেমন নতুন কোন দুরুদ বা বিশেষ দিনের সালাত যা রসুল(সাঃ) ও সাহাবীরা করে নি দেখালে তা পরিতাজ্য। কারণ দ্বীন পূর্নাঙ্গ হয়ে গেছে, স্বপ্নে হয়তো আমল যেমন – তাহাজ্জুদ পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিবে কিন্তু নতুন বিধান নয়। স্বপ্নে যদি আল্লাহর তরফ হতে হয় তার ব্যাখা পাওয়ার জন্য পেরেশানির প্রয়োজন নেই। আল্লাহই ব্যাখার ব্যবস্হা করবেন- যেমন ইউসুফ (আঃ) এর মাধ্যমে কয়েদী ও রাজা স্বপ্নের ব্যাখা পেয়েছেন। ভালো স্বপ্ন দেখার জন্য ইস্তেখারা করা যায়। রসুলও (সাঃ) করেছিলেন- তখন তার উপর কুফরী কালাম করা হয়েছে। স্বপ্নে এটা ও এর সমাধান জানানো হয়। আর স্বপ্নের ব্যাখা ব্যক্তির চরিত্রের উপর ভিত্তি করে করতে হয়। সুতরাং আমরা ব্যাখা জানি না বা আমাদের কাছে জানতে চাওয়াটা উচিত না।

২. শয়তানী স্বপ্ন – শয়তান মন্দ, অশ্লীল, দারিদ্র্যতা ও বিভিন্ন ভয়ভীতির স্বপ্ন দেখাবে। যদি ভয় পেয়ে ঘুম হতে উঠেন বামদিকে থুথু মারুন আল্লাহর কাছে ফানাহ চান। আর স্বপ্ন গোপন রাখুন বড় আলেম ছাড়া কারো নিকট বলা উচিত না।অনেক সময় মানুষ ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করতে থাকে, এমন সময় কেউ যেন আল্লাহর কালাম পড়তে বলে। তখন সে পড়ে কিছুক্ষণ পর হয়তো শান্তি পায়।আলেমদের মতে- এটা জিন শয়তানের স্বপ্ন আর তখন আমাদের ভেতর থাকা ফেরেশতা পরামর্শ দেয় আল্লাহর কালাম পড়তে যেন শয়তান হতে রক্ষা পায়। অনেক রুকইয়া বিশেষজ্ঞ আলেমের মতে- স্বপ্নে কালো কুকুর, সাপ, গর্তে পড়া যাওয়া এগুলো শয়তান জিনের তরফ হতে হয়। যখন কারো বিরুদ্ধে কুফরী কালাম করা হয় এগুলো বেশি দেখানো হয়।কারণ আদম (আঃ) দোয়া করেন আর আল্লাহ মানুষকে ফেরেশতা দ্বারা রক্ষা করেন। চাইলেই শয়তান শরীরে প্রবেশ করতে পারে না। তবে তিনটা অবস্থায় প্রবেশ করতে পারে-

  • প্রচন্ড ভয় পাওয়া
  • প্রচন্ড রেগে যাওয়া
  • প্রচন্ড হতাশ ও নেশাগ্রস্ত হওয়া (আলেমদের অভিমত)

কারণ তখন হতাশা ও নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির উপর শয়তান ভর করে এমনকিছু করাবে যা স্বাভাবিক ক্ষেত্রে করতো না। এমন অনেক উদাহরণ আছে যে নেশাগ্রস্ত হয়ে হাস্যজ্জল যুবক আত্মহত্যা করছে। জিন শয়তান শরীরে প্রবেশের জন্য নেশা, ভয় লাগিয়ে হতাশ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মুমিনের ভরসা আল্লাহর প্রতি তাই ক্ষতি পারবে না। আয়াতুল কুরসীসহ ও ঘুমানোর জিকির করা উচিত। শয়তান উমর (রাঃ) কে ভয় পেতেন কারণ তিনি ছিলেন সুন্নত পালনে কঠোর, তওবাকারী। তাই যতবেশি সুন্নত মানবেন শয়তান তত কষ্ট পাবে। যেমন- মানুষ তার সাফল্য দেখে কষ্ট পায় তেমন শয়তান কষ্ট পায় বান্দা তার আমল দ্বারা আল্লাহর নিকটবর্তী হলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *