ইসলামের শত্রুর তালিকায় সবচেয়ে শীর্ষেই ছিলেন যিনি তিনি হলেন ইকরিমা ইবনে আবু জাহেল (রাঃ)। আবু জাহেলের মৃত্যুর পরও দীর্ঘদিন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর যাদেরকে ক্ষমা করা হয়নি বরং হত্যার নির্দেশ হয় তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
ঘটনাক্রমে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ও রসুলের (সাঃ) সাথে সাক্ষাৎ করেন।
রসুলুল্লাহর (সাঃ) কাছে ঈমান আনার পর তার কিছু কথোপকথন
ইকরিমা (রাঃ) বলেনঃ ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন, তিনি যেন আমাকে ইসলামের বিরুদ্ধে আমার সকল শত্রুতা ক্ষমা করে দেন এবং আপনার উপস্থিত ও অনুপস্থিত অবস্থায় আমি আপনার নামে যে সকল নিন্দা করেছি আর কুৎসা রটনা করেছি সেগুলো যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করলেন যে, হে প্রতিপালক, আমার বিরুদ্ধে যত শত্রুতা সে করেছে এবং তোমার আলোকে নিভিয়ে দেবার যত চেষ্টা সে করেছে তার জন্য তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা পেছনে আমার সম্মানহানীর জন্য যা কিছু সে বলেছে তার জন্যও তাকে ক্ষমা করে দাও।
ইকরিমার মুখ গভীর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ”আল্লাহর শপথ ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আমি শপথ করছি, যা কিছু আমি আল্লাহর পথে শত্রুতার জন্য ব্যয় করেছি, তার দ্বিগুন আমি ব্যয় করব আল্লাহর পথে, এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ আমি করেছি তার দ্বিগুন আমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করব।”
রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)- খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দিকে দিকে ধর্মত্যাগীদের ফিতনা দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে। কোমল হৃদয় আবু বকর (রা) আল্লাহর কৃপায় তা অসাধারণ কঠোর হাতে দমন করেন। এ সময় আরবের অধিকাংশ অঞ্চলে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইকরিমা ছিলেন মুসলিম সেনাদলের অন্যতম সমরবিদ ও যোদ্ধা। আবু বকরের (রা) পর উমর (রা) এর এর খিলাফত শুরু হল। এ সময় মুসলিমরা একের পর এক রাজ্য আল্লাহর কৃপায় জয় করতে লাগল। সে সময় রোমান সাম্রাজ্যের সাথে মুসলিমদের যে ভয়াবহতম ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংগঠিত হয় তা ছিল ইয়ারমুকের যুদ্ধ। প্রায় দেড় লাখ আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত রোমান সেনা মাত্র তেত্রিশ হাজার মুসলিমের বাহিনী মোকাবেলা করার জন্য হাজির হল। ইসলামের ইতিহাসে কঠিনতম সে যুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য বীর মুসলিম মুজাহিদ কমান্ডার খালিদ ইবনে ওয়ালিদ কমান্ড গ্রহণ করলেন আবু উবায়দা উবনুল জাররার কাছ থেকে। ইকরিমা এ যুদ্ধে ছিলেন মুসলিম বাহিনীর একজন কমান্ডার। মরুভূমিতে পানিবিহীন পথচলার পর পথিক যেভাবে পানির জন্য ক্ষিপ্র হয়ে ছুটে চলে, এ যুদ্ধে ইকরিমাও তেমনি বার বার তার সেনাদল নিয়ে রোমানদের আক্রমন করে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে রোমান সেনাদল আক্রমন করে মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সুরক্ষিত রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে প্রবেশ করবেন এবং নিজের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতি করবেন। ইকরিমার এ সংকল্পের কথা শুনে খালিদ দ্রুত তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “একাজ তুমি করো না ইকরিমা, তোমার মৃত্যু হবে মুসলিমদের জন্য একটা বড় আঘাত।” ইকরিমা বললেন, “আমাকে যেতে দাও খালিদ, আল্লাহর রাসুলের সাথে থাকার এবং তার সাথে যুদ্ধ করার সুযোগ তুমি পেয়েছ। আমার বাবা আর আমি ছিলাম তার সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু।” যে পাপ আমি করেছি তার শোধ দেবার সুযোগ তুমি আমাকে দাও। আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে আমি অনেকগুলো যুদ্ধ করেছি, আর আজ কি আমি এ রোমানদের দেখে পালিয়ে যাব তা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।”
ইকরিমা তখন বাহিনীর লোকদের ডেকে বললেন, “কে কে আছো আমার সাথে যে মৃত্যুর জন্য বায়াত করবে আমার কাছে।” তার এই আহ্বানে আল হারিস ইবনে হিশাম, আইয়াশ ইবনে রাবিয়া সহ চারশো মুজাহিদ তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে এল। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ দলটি সবাইকে ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ল রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে এবং বীরের মত তারা যুদ্ধ করল মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এ দলটির দ্বারা কাফির বাহিনীর যে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা আর তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সেদিন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দেখা গেল, মুসলিমদের মধ্যে যারা শাহাদাত বরণ করেছে তাদের মধ্যে তিনজন মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। এই তিনজন ছিলেন আল হারিস ইবনে হিশাম, আইয়াশ ইবনে রাবিয়া এবং ইকরিমা ইবনে আবু জাহল। ইকরিমা এবং আল হারিস পানির জন্য ডাকছিলেন। তাঁদের জন্য দ্রুত পানির ব্যবস্থা করা হল। পানি আনার পর আইয়াশ তাঁদের দিকে তাকালেন। তারা বললেন, “এ পানি আইয়াশকে দাও।”
আইয়াশের কাছে পানি নিয়ে যাবার পর দেখা গেল তিনি ততক্ষনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছেন। আবার পানি যখন ইকরিমা এবং আল হারিসের দিকে নিয়ে যাওয়া হল, তখন দেখা গেল তাঁরা দুজনও ততক্ষনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন।
উপস্থিত মুসলিমদের চোখ আবেগে অশ্রসজল হয়ে উঠল। তারা বললেন, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিশ্চয়ই তাঁদেরকে জান্নাতের হাউজে কাউসারের সে পানি পান করাবেন, যা পান করার পর তাঁদের পিপাসা চিরকালের জন্য দূর হবে।
দলিল- (আসহাবে রসুল, সাহাবীদের জীবনী)
আহ! কি সুন্দর মৃত্যু! এক সময় ইসলাম ও মুসলিমের চিরশত্রু তাওহীদের ছায়াতলে এসে শহীদী মর্যাদা অর্জন করেছেন। কুফর অবস্থায় পরস্পর যুদ্ধ করেছেন, আর ঈমান আনার পর তারা একে অপরকে নিজের জীবনের চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন। ঐক্যের এই মেলবন্ধনের মূলই ছিল তাওহীদ।
অপরদিকে রসুলল্লাহ’র (সাঃ) দ্বীনের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যার ছিল তিনি আবু তালেব। তারা ছিলেন মক্কার নেতা। কাবার রক্ষনাবেক্ষন, হাজীদের পানি পান করাতেন তারা। রসুলের (সাঃ) রিসালাতের দায়িত্ব পাবার পর সকল বিপদ-আপদে তার পাশে দাড়িয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূর্ব পুরুষের নিয়মনীতি, সম্মানের অনুসরণ করতে গিয়ে ঈমান আনলেন না।
চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর সময় মহানবী (সা.) যা বলেছিলেন
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর সময় প্রসঙ্গে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব তার পিতা মুসাইয়্যাব (রহঃ) বর্ণনা করেন, যখন আবূ ত্বালিব মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হ’লেন, রাসূল (সাঃ) তার নিকট গেলেন। আবূ জাহালও সেখানে ছিল। নবী (সাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচাজান! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ -কালেমাটি একবার পড়ুন, তাহ’লে আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকট কথা বলতে পারব।
তখন আবূ জাহাল ও আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়া বলল, হে আবূ ত্বালিব! তুমি কি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম হ’তে ফিরে যাবে? এরা দু’জন তার সাথে একথাটি বারবার বলতে থাকল। সর্বশেষ আবূ ত্বালিব তাদের সাথে যে কথাটি বলল, তা হ’ল, আমি আব্দুল মুত্তালিবের মিল্লাতের উপরেই আছি। এ কথার পর নবী (সাঃ) বললেন, ‘আমি আপনার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকব যে পর্যন্ত আপনার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করা না হয়’। এ প্রসঙ্গে এ আয়াতটি নাযিল হল,
“নবী ও মু’মিনদের জন্য শোভনীয় নয় মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তারা আত্মীয়-স্বজন হলেও, যখন এটা তাদের কাছে সুস্পষ্ট যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী।”
সূরা তওবা – ১১৩
আরো নাযিল হল:
‘আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছা করলেই তাকে হিদায়াত করতে পারবেন না’
সূরা কাছাছ – ৫৬
[বুখারী হা/৩৮৮৪,ইফা- ৩৬০৪ ,‘আনছারদের মর্যাদা’অধ্যায়, ‘আবু ত্বালিবের কাহিনী’ অনুচ্ছেদ।
অপর হাদীসে রয়েছে –
মুসাদ্দাদ (রহঃ) … আব্বাস ইবনু আবদুল মুত্তালিব (রাঃ) বলেন, আমি একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আপনার চাচা আবূ তালিবের কি উপকার করলেন অথচ তিনি (জীবিত থাকাবস্থায়) আপনাকে দুশমনের সকল আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে হিফাজত করেছেন।
(আপনাকে যারা কষ্ট দিয়েছে) তাদের বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হতেন। তিনি বললেন, সে জাহান্নামে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত আগুনে আছে। যদি আমি না হতাম তবে সে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করত। (বুখারী ই. ফা- ৩৬০৩, আন্তর্জাতিক -৩৮৮৩)
আহ!! কি করুন মৃত্যু!! কত না হৃদয়বিদারক ঘটনা। আজও দেখবেন কিছু আলেমসহ, ব্যক্তিগত মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ, মুসল্লীদের সেবা ও মুসলিমদের বিপদে বিশেষ ভূমিকা রাখে, কারারুদ্ধও হয় অথচ পূর্বপুরুষদের রীতি বর্জন না করে নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অপরদিকে তাওহীদের ছায়াতলে ইসলামের একসময়ের শত্রুরা ইসলামের কল্যাণে জীবন বিলাচ্ছেন ও ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে মুসলিমদের বিজয়ে ওদের বিশেষ ভূমিকা থাকবে।
হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন-
‘যখন মালহামাহ সমূহ (বড় বড় যুদ্ধ) সংঘটিত হবে, তখন আল্লাহ তাআলা (সিরিয়ার) দামেশক থেকে মাওয়ালী’দের এক সৈন্যদল পাঠাবেন। তারা হবে শ্রেষ্ঠ আরব অশ্বারোহী এবং উচ্চমার্গের সমরাস্ত্রবাহী। আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমে দ্বীন’কে সাহায্য করবেন’। [সুনানে ইবনে মাজাহ– ২/৫৬০, হাদিস ৪০৯০; মুসতাদরাকে হাকিম- ৪/৫৪৮; তারিখে দামেশক, ইবনু আসাকীর- ১/২৫৮]।
মাওয়ালী বলতে নওমুসলিম বা অনেকের মতে অনারব নওমুসলিমদের বুঝায় তারা তওহীদে ও সুন্নাতের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ হতে এসে ঐক্যবদ্ধ হবে শাম বা সিরিয়ায়।
বর্তমানে অনেক আলেমই ঐক্যের পথে আহ্বান জানাচ্ছেন এবং মুসলিমদের অতি প্রয়োজন। তবে ঐক্য হবে তাওহীদ ও সুন্নাতের ভিত্তিতে আর কুফর, বিদআত নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত বিভক্তিই হবে। কারণ সুন্নত সারাবিশ্বে একই অথচ কুফর, বিদআত বর্তমানে এলাকা, মসজিদ ভেদে ভিন্ন।
তাই তাওহীদ, সুন্নত সুস্পষ্ট করা উচিত, মাসায়ালাগত একতেলাফকে ভুলে। অনেকে বিদআত, কুফরকে সুন্নত ও জায়েজ প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলছে, আবার ঐক্যের আহ্বান দিচ্ছে।
আল্লাহর রসুল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার উপর মিথ্যা বলে, সে যেন। নিজের ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।” (বুখারী ও মুসলিম)।
আল্লাহ বলেন,
“যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে কিংবা তাঁর নিদর্শনসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে তার অপেক্ষা বড় অত্যাচারী আর কে?”
সূরা আ’রাফঃ আয়াত ৩৭
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে লোক এমন ইল্ম (জ্ঞান) সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয় যা সে জানে, অতঃপর সে তা গোপন করে, তাকে ক্বিয়ামাতের দিবসে আগুনের লাগাম পরানো হবে। [জামে’ আত-তিরমিজি: ২৬৪৯, সুনান আবী দা’উদ ৩৬৫৪, সুনান ইবনু মাজাহ ২৬১, মিশকাতুল মাসাবীহ ২২৩। শায়খ যুবাইর আলী যাঈ এবং শায়খ আলবানী হাদিসের সনদকে সহীহ বলেছেন]
তাই তাওহীদ ও সুন্নাত সুস্পষ্ট প্রচার করুন নাহলে কেয়ামত দিবসে আগুনের লাগাম দেওয়া হবে।