মহিলা সাহাবি হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা) ইসলামের প্রথম যুগে ঈমান আনয়নকারীদের মধ্যে আঠারোতম ব্যক্তি। এ মহিলা সাহাবি সর্বদিক দিয়ে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর পিতা, পিতামহ, ভগ্নি, স্বামী ও পুত্র সকলেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবি ছিলেন। বংশ পরিচয় হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহার পিতা ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে হিজরতকারী ও ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু।
তার মাতা ছিলেন কুতাইলা বিনতে আবদুল উযযা, উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন তার ছোট বোন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাওয়ারি (বিশেষ সাহায্যকার ছিলেন তাঁর স্বামী যুবাইর ইবনুল আওয়াম। সত্য ও ন্যায়ের জন্য জীবনদানকারী হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের (রা:) শ্রদ্ধেয়া সম্মানিতা মা তিনি।
যুবাইর ইবনুল আওয়ামের (রা:) সঙ্গে যখন তার বিয়ে তখন তাঁর স্বামীর আর্থিক অবস্থা ছিল অসচ্ছল। তিনি স্বামীর খেদমত করতেন।
হিজরতের সময় তিনি রসুল (সা) ও আবুবকর (রা:) এর খাওয়া নিয়ে গিয়েছিলেন। তার কষ্ট, সাহসীকতার বহু ঘটনা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর তার প্রিয় পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইয়ের (রা) সাথে। মদীনায় হিজরতের পরে মুহাজিরদের ১ম সন্তান ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা)। তখন ইহুদিরা গুজব রটিয়েছিল তারা মুসলিমদের জাদু করেছে তাই মুসলিমদের আর সন্তান হবে না। তাই আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা:) জন্ম সবার জন্য খুশির ছিল।
আসমা বিন্ত আবূ বক্র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু যুবায়রকে মক্কায় গর্ভে ধারণ করেন। তিনি বলেন, গর্ভকাল পূর্ণ হওয়া অবস্থায় আমি বেরিয়ে মদীনায় আসলাম এবং কুবায় অবতরণ করলাম। কুবাতেই আমি তাকে প্রসব করি। তারপর তাকে নিয়ে রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে তাকে তাঁর কোলে রাখলাম। তিনি একটি খেজুর আনতে বললেন।
তা চিবিয়ে তিনি তার মুখে দিলেন। রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই লালাই সর্বপ্রথম তার পেটে প্রবেশ করেছিল। তারপর তিনি খেজুর চিবিয়ে তাহ্নীক করলেন এবং তার জন্য বরকতের দু’আ করলেন। (হিজরতের পরে) ইসলামে জন্মলাভকারী সেই ছিল প্রথম সন্তান। তাই তার জন্যে মুসলিমরা মহা আনন্দে আনন্দিত হয়েছিলেন। কারণ, তাদের বলা হত ইয়াহূদীরা তোমাদের যাদু করেছে, তাই তোমাদের সন্তান হয় না। (আধুনিক প্রকাশনী- ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৯৬০)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৪৬৯
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
কারবালায় মর্মান্তিক ভাবে হত্যা করা হলো নবীজির দৌহিত্র হোসাইন (রা.) এবং তার পরিবারকে। খবরটা পৌঁছা মাত্রই নড়ে বসলেন আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের। ঘোষণা দিলেন খলিফার মসনদে থাকা ইয়াজিদকে অপসারণের। তিনি তখন মক্কায়। অন্যদিকে মদিনা অবরোধের নির্দেশ দিয়েছেন ইয়াজিদ। মদিনাবাসীও প্রতিরোধ করে। ৬৮৩ সালের এই সংঘর্ষ হাররা যুদ্ধ নামে পরিচিত। আবদুল্লাহ ইবনে হানজালা ও তার পুত্ররাসহ অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শহীদ হন। সিরীয় বাহিনীর হাতে লুণ্ঠিত হয় মদিনা, লাঞ্চিত হয় নারী। স্তব্ধ হয়ে যায় নবীর শহর। তারপর ইয়াজিদের বাহিনী রওনা দেয় মক্কায়। কিন্তু অবরোধ করলেও তা ফলপ্রসূ হলো না; ফিরে যেতে হলো। কারণ, হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছে ইয়াজিদ।
আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের একসময় হেজাজ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার একচ্ছত্র শাসক হন। মদিনা থেকে উমাইয়াদের বিতাড়িত করে নিজে প্রশাসক নিয়োগ দেন। বসরায় পত্র পাঠান। বায়আত গ্রহণে এগিয়ে আসে আবদুল্লাহ ইবনে আলি, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমর। কুফায় নতুন ইমাম ও কর আদায়কারী নিযুক্ত করা হয়। কুফাবাসীও তার প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে। মিশর, আলজেরিয়া এবং বসরাতে দূত পাঠালে তারা বায়আত গ্রহণ করে। ইয়ামেন এবং খোরসানবাসীও বায়আত গ্রহণ করতে দেরি করেনি।
ইয়াজিদের মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় মুয়াবিয়া মসনদে বসেন। কিছু মানুষের কাছে সিংহাসন বিতৃষ্ণার বিষয় হয়ে উঠে। দ্বিতীয় মুয়াবিয়া ছিলেন সেই শ্রেণির। খেলাফত থেকে দূরে সরে মসজিদে নির্জন ইবাদতে সময় অতিবাহিত করতে থাকেন। মাত্র তিন মাসের মাথায় এভাবেই ইনতেকাল করেন। ফলে উমাইয়া সাম্রাজ্যের বড় অংশ আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের খেলাফতে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে আর কোনো বাঁধা থাকলো না।।
মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াজিদ বা দ্বিতীয় মুয়াবিয়া মৃত্যুর আগে দামেশকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের জন্য জনগণের পক্ষে বায়আত গ্রহণের শপথ নিয়েছিলেন।
দামেশকবাসী দাহহাক ইবনে কায়েস (রা.)-কে দায়িত্ব দিয়েছিল একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। তিনিও মনস্থির করেছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের হাতে বায়আত গ্রহণের। এদিকে শামের অধিকাংশ গভর্নর তার প্রতি আনুগত্য দেখায়। উমাইয়া পরিবারের অন্যতম পুরুষ মারওয়ান ইবনে আবুল হাকামও বায়আতের জন্য রওনা হন।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে পথে কারবালা হত্যাকাণ্ডের প্রধান কুশীলব উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের সাথে দেখা হয়ে। উবায়দুল্লাহ ভীত ছিল। যদি আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের মসনদে আসীন হয় এবং ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়; তবে কারবালায় হত্যাকাণ্ডের দায়ে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ফলে মারওয়ানের হাত ধরে বায়আত গ্রহণ করে; তাকে খলিফা হতে প্ররোচিত করে। এর মধ্য দিয়ে কেবল মারওয়ানের মনই বদলায় না; বদলে যায় ক্ষমতার সমীকরণ।
আদ দাহহাক (রা.) আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের হাতে বায়আত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলে মারওয়ানের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ৬৫ হিজরিতে শামের মারজ রাহিতে ২৯ দিন ব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শেষ অব্দি প্রতারণার মাধ্যমে পরাজিত করা হয় দাহহাকের বাহিনীকে। নিহত হন দাহহাক নিজে। শীঘ্রই শামে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন মারওয়ান। কিন্তু স্থায়ী হতে পারেননি। তার মৃত্যুর পরে পুত্র আবদুল মালিকের হাতেই শামবাসী বায়আত গ্রহণ করে। চলতে থাকে দীর্ঘ সংঘাত।
আবদুল মালিক ৭১ হিজরি নাগাদ পুরো ইরাকের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে সক্ষম হন। বাকি থাকে কেবল হেজাজ অঞ্চল। এবার তাই ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে মক্কা অবরোধের নির্দেশ দিল।
নিষ্ঠুরতার জন্য সমালোচিত হাজ্জাজ পাঁচটা মানজানিক নিয়ে হাজির হয়। বন্ধ করে দেয় মক্কার বাইরে থেকে রসদসামগ্রী আগমনের পথ। রসদ আটকে দেয়ায় অবরুদ্ধরা যমযমের পানি পান করতে থাকে। মানজানিকের আঘাত গিয়ে পৌঁছায় কা’বা অব্দি। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের পক্ষের বহু মানুষ নিহত হয়। বাকিরা আস্তে আস্তে সরে পড়তে থাকে। তখনও তার পাশে থাকে মা আসমা (রা.)। একাকী সঙ্গীহীন পুত্রের বুকে ভরসা হয়ে।
দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থেকে প্রায় অনেকেই হতোদ্যম হয়ে ত্যাগ করেছিল আবদুল্লাহর পক্ষ। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের মা আসমা (রা.)-এর কাছে উপস্থিত হলেন।
-আম্মা, সকলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার দুই পুত্র এবং আত্মীয়রাও আমার কাছে নেই। সীমিত যে কয় জন আমার সঙ্গে আছে; তাদের নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব না। আমি যদি পার্থিব কিছুর বিনিময়ে খেলাফত ত্যাগ করি; তবে তারা তা আমাকে দিতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে আপনার কী মত?
-আল্লাহর শপথ, নিজের কর্তব্য ও করণীয় তুমি ভালো করেই জানো। যদি বিশ্বাস থাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আছো, তবে এই পথেই অটল ও অবিচল থাকবে। ন্যায়ের পথেই তোমার সঙ্গীরা শহীদ হয়েছে। বনু উমাইয়ার দাসদের তোমাকে নিয়ে খেলার সুযোগ দিও না। আর যদি পার্থিব সম্পদ কামনা করে থাকো; তাহলে তুমি অতি নিকৃষ্ট দাস। নিজেকেও ধ্বংস করেছো; ধ্বংস করেছো সঙ্গীদেরকে। আর যদি মনে করো, আমি তো হকের পথেই ছিলাম, সঙ্গীগণ হীনবল হয়ে পড়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছি। তাহলে বলবো এটা বীরের ধর্ম না; ধার্মিকের নীতি না। চিরদিন বেঁচে থাকতে পারবে? শাহাদাতই কি শ্রেয় না?
-আম্মা, আমার আশঙ্কা হয় শামের সৈন্যরা আমাকে হত্যা করার পর লাশ বিকৃত করে ফেলবে।
-পুত্র, মেষ জবাই করার পর চামড়া ছিলে ফেললে তার কষ্ট হয় না।
আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের মায়ের কপালে চুমু খেলেন। বললেন, “এটাই আমার সিদ্ধান্ত। আজকের দিন অব্দি আমি সত্যের দিকে আহবান করেছি। কখনো দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়িনি। ভালোবাসিনি পার্থিব জীবনকে। আমার জীবদ্দশায় আল্লাহর দ্বীন লঙ্ঘিত হচ্ছে; আমি কী করে মেনে নেবো? এজন্যই আমি বিদ্রোহ করেছি। আমি আপনার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম। আম্মা, আজই আমি শহীদ হতে যাচ্ছি। আপনার কষ্ট যেন বৃদ্ধি না পায়।”
আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) শহীদ হলেন। তার শাহাদতের খবরে শামের যোদ্ধারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। মুহুর্মুহু দিতে থাকে তাকবির। শুনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) মন্তব্য করেছিলেন, “তার জন্মগ্রহণের সংবাদে তাকবির প্রদাণকারীরা তার মৃত্যু সংবাদে তাকবির প্রদানকারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” আসলে তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন মদিনায় যুবায়েরের জন্মের সময় সাহাবিদের দেয়া তাকবির ধ্বনির দিকে।
তার শাহাদাতের পর তার লাশকে বিকৃত করা হয়, আসমা (রা) কে অপমান করা হয় তবুও তিনি সাহসীকতায় অটল থাকেন।
অনেকে বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরে জুলুম ঢেকে জালেমকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।
আসুন ইতিহাস নয় সহীহ হাদীস কি বলে দেখুন-
আবূ নাওফিল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আমি (মাক্কায়) ‘উকবাতুল মাদীনাহ্ নামে ঘাঁটিতে ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ)-কে (শুলীকাষ্ঠে ঝুলতে) দেখতে পেলাম। রাবী বলেন, তখন অন্যান্য লোকজন তাঁর কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। পরিশেষ ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) তাঁর কাছ দিয়ে যাওয়াকালে বললেন, আস্সালামু ‘আলাইকা ইয়া আবূ খুবায়ব! আস্সালামু ‘আলাইকা ইয়া আবূ খুবায়ব! আস্সালামু ‘আলাইকা ইয়া আবূ খুবায়ব! আল্লাহ্র শপথ! আমি অবশ্য আপনাকে এ থেকে বিরত থাকতে বলেছিলাম। আল্লাহ্র শপথ!
আমি অবশ্য আপনাকে এ থেকে নিষেধ করছিলাম, আমি অবশ্য আপনাকে এ থেকে নিষেধ করছিলাম। আল্লাহ্র শপথ! আমি যদ্দুর জানি আপনি ছিলেন সর্বাধিক সিয়াম পালনকারী, সর্বাধিক সলাত আদায়কারী এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক সম্মিলনকারী। আল্লাহর শপথ, শ্রেষ্ঠ উম্মাতের দৃষ্টিতে আজ আপনি (আপনার মতো মহৎ ব্যক্তিত্ব) নিকৃষ্ট মানুষে গণ্য হয়েছেন। তারপর ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) সেখান হতে প্রত্যাবর্তন করলেন। ‘
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ)-এর এ অবস্থান (থামা) ও তাঁর বক্তব্য হাজ্জাজের নিকট পৌঁছল। তখন সে ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়রের নিকট লোক প্রেরণ করল এবং তাঁকে শূলীর উপর থেকে নামানো হলো। তারপর ইয়াহূদীদের কবরস্থানে তাঁকে নিক্ষিপ্ত করা হলো। তারপর সে তাঁর মা আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ)-কে ডেকে নেয়ার জন্য দূত পাঠায়। তিনি তাঁর নিকট আসতে অস্বীকৃতি জানালেন। হাজ্জাজ আবার তাঁর নিকট লোক পাঠাল তাঁকে তাঁর নিকট আসার জন্য এই বলে যে, তোমাকে অবশ্যই আসতে হবে। অন্যথায় তোমার নিকট এমন লোক পাঠাব যে, তোমাকে চুল ধরে টেনে নিয়ে আসবে। রাবী বললেন, এরপরও তিনি অস্বীকৃতি জানালেন এবং বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি সে পর্যন্ত তোমার নিকট আসব না যতক্ষণ না তুমি আমার নিকট এমন লোক পাঠাবে যে, আমার চুলে ধরে টেনে নিয়ে আসবে।
রাবী বলেন, তারপর হাজ্জাজ বলেন, আমার জুতা নাও। তারপর সে জুতা পরল এবং সদর্পে আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ)-এর নিকট পৌঁছল এবং সে বলল, তুমি তো দেখলে আল্লাহর শত্রুর সাথে আমি কী ব্যবহার করেছি। তিনি বললেন, “হ্যাঁ আমি তোকে দেখছি, তুই তাঁর দুনিয়া বরবাদ করে দিয়েছিস। আর সে তোর আখিরাত নষ্ট করে দিয়েছে। আমি জানতে পেরেছি যে, তুই তাকে (তিরস্কার স্বরূপ) দু’টি কোমরবন্ধনীর ছেলে বলে সম্বোধন করে থাকিস। আল্লাহর শপথ! আমিই দু’ কোমরবন্ধ ব্যবহারকারিণী। এর একটির মাঝে আমি রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং আবূ বকর (রাঃ)-এর খাদ্যদ্রব্য বেঁধে তুলে রাখতাম যাতে বাহনের পশু থেকে খেয়ে ফেলতে না পারে। অপরটি হলো যা স্ত্রীলোকের জন্য প্রয়োজন। জেনে রাখো, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, সাকীফ সম্প্রদায়ে এক মিথ্যুকের এবং নরহত্যাকারীর (জালেমের) উভ্যুদয় হবে। মিথ্যুককে তো আমরা সকলে দেখেছি, আমি রক্ত প্রবাহকারী (জালেম) তোমাকে ব্যতীত আর কাউকে মনে করছি না।” এ কথা শুনে হাজ্জাজ উঠে দাঁড়াল এবং আসমা (রাঃ)-এর কথার কোন প্রত্যুত্তর করল না। (ই.ফা. ৬২৬৫, ই.সে. ৬৩১৪)
সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৩৯০
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
Source: আল হাদিস অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ, IRD।
‘আত্বা (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, ইয়াযীদ ইবনু মু’আবিয়ার সময় কা’বাহ্ ঘর দগ্ধীভূত হয়েছিল- যখন সিরীয় বাহিনী মাক্কায় যুদ্ধে লিপ্ত ছিল (৬৩ হিজরী) এবং কা’বার যা হবার তাই হ’ল। হাজ্জের মৌসুমে লোকদের আগমনের সময় ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) কা’বাকে এ অবস্থায় রেখে দিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল লোকদেরকে উদ্দীপ্ত করা অথবা তাদের মধ্যে সিরীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মনোবল সৃষ্টি করা।
লোকেরা সমবেত হলে তিনি বললেন, হে জনগণ! আমাকে কা’বাহ্ ঘর সম্পর্কে পরামর্শ দিন। আমি কি তা ভেঙ্গে ফেলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে তুলব, নাকি শুধু এর ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করব?
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বললেন, আমার মনে একটি মতের উদয় হয়েছে, আমি মনে করি যে, শুধু ক্ষতিগ্রস্ত অংশ তুমি মেরামত করবে এবং লোকদের ইসলাম গ্রহণ ও নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নুবূওয়াত লাভকালীন সময়ে কা’বাহ্ ঘর ও পাথরসমূহ যে অবস্থায় ছিল, তা সে অবস্থায় রেখে দিবে। ইবনু যুবায়র (রাঃ) বললেন, আপনাদের কারো ঘর অগ্নিদগ্ধ হলে তা সংস্কার না করা পর্যন্ত তিনি স্বস্তি লাভ করতে পারেন না। অতএব আপনাদের প্রতিপালকের ঘর কী করে এরূপ জীর্ণ অবস্থায় রাখা যেতে পারে? আমি আমার রব-এর কাছে তিনদিন ইস্তিখারা করব (অভিপ্রায় অবগত হবার জন্য) অতঃপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। তিনদিন পর তিনি কা’বাহ্ ঘর ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণের দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন।
লোকেরা আশংকা করল যে, সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি কা’বার ছাদে উঠবে, সে হয়ত কোন আসমানী গযবে নিপতিত হবে। শেষ পর্যন্ত এক ব্যক্তি (ছাদ ভাঙ্গার জন্য) কা’বার ছাদে উঠল এবং তার একটি পাথর নীচে ফেলল। লোকেরা যখন দেখল সে কোন বিপদে পড়েনি, তখন তারাও তাকে অনুসরণ করল এবং কা’বাহ্ ঘর ভেঙ্গে জমিনের সাথে মিশিয়ে দিল। অতঃপর ইবনু যুবায়র (রাঃ) কতগুলো থাম স্থাপন করে এগুলোর সাথে পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন। অবশেষে কা’বার দেয়ালের গাঁথুনি উচ্চ হল।
ইবনু যুবায়র (রাঃ) বললেন, অবশ্যই আমি ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “লোকেরা যদি নিকট অতীতে কুফরি ত্যাগ না করত এবং আমার নিকটও কা’বাকে পুনর্নির্মাণ করার মত অর্থ-সামর্থ্যও নেই- তাহলে আমি অবশ্যই আল-হাজার (হাতীম)-এর পাঁচ গজ স্থান কা’বাহ্ ঘরের অন্তর্ভুক্ত করতাম এবং লোকদের প্রবেশের জন্য ও বের হবার জন্য এর দু’টি দরজা বানাতাম।”
ইবনু যুবায়র (রাঃ) বলেন, বর্তমানে আমার হাতে তা নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ আছে এবং লোকদের তরফ থেকেও কোন প্রতিবাদের আশংকা নেই। রাবী বলেন, এরপর তিনি হাতীমের পাঁচ গজ এলাকা কা’বার অন্তর্ভুক্ত করলেন। ফলে তা (পুরাতন) ভিতের উপর গড়ে উঠল। [যার উপর ইব্রাহীম (‘আঃ) তা গড়েছিলেন]। এবং লোকেরা তা অবলোকন করল। এ ভিতের উপর দেয়াল গড়ে তোলা হল। কা’বার দৈর্ঘ্য ছিল আঠার গজ। তা যখন (প্রস্থে) বাড়ানো হল, তখন (স্বাভাবিকভাবেই দৈর্ঘ্য) তা ছোট হওয়ায় দৈর্ঘ্যে তা আরও দশ গজ বৃদ্ধি করা হল এবং এর দু’টি দরজা নির্মাণ করা হল, একটি প্রবেশের জন্য এবং অপরটি প্রস্থানের জন্য।
ইবনু যুবায়র (রাঃ) শহীদ হলে হাজ্জাজ (ইবনু ইউসুফ) ‘আবদুল মালিক ইবনু মারওয়ানকে তা লিখে জানাল। সে আরও জানাল যে, ইবনু যুবায়র (কা’বাহ্ ঘর) সে ভিতের উপর নির্মাণ করেছে। [যা ছিল ইব্রাহীম (‘আঃ)-এর ভিত] এবং মক্কার বিশ্বস্ত লোকেরা তা যাচাই করে দেখেছে। ‘আবদুল মালিক তাকে লিখে পাঠালেন যে, কোন বিষয়ে ইবনু যুবায়রকে অভিযুক্ত করার প্রয়োজন আমাদের নেই। সে দৈর্ঘ্যে যতটুকু বর্ধিত করেছে, তা বহাল রাখ এবং হাতীমের দিকে যতটুকু বর্ধিত করেছে, তা ভেঙ্গে পূর্বাবস্থায় নিয়ে আসো। আর সে যে (নতুন) দরজা খুলেছে তা বন্ধ করে দাও। এরপর হাজ্জাজ তা ভেঙ্গে পূর্বের ভিতের উপর পুনর্নির্মাণ করে। [৩২] (ই.ফা ৩১১১, ই.সে.৩১০৮)
ফুটনোটঃ
[৩২] ইয়াযীদ ইবনু মু’আবিয়ার রাজত্বকালে (৬১-৬৩ হি/-৬৮০-৮৩ খ্রি) ইসলামের ইতিহাসে তিনটি জঘন্যতম ও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে। (১) ৬১ হিজরীর মুহার্রম মাসে কারবালা প্রান্তরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসায়ন (রাঃ) উমাইয়্যাহ্ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহীদ হন । এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ গোটা মুসলিম জাহানে, বিশেষত মাক্কাহ্ ও মাদীনায় পবিত্র নগরীদ্বয়ে গণঅসন্তোষ দেখা দেয় এবং তা বিদ্রোহের রূপ নেয় । তা দমনের জন্য উমাইয়াহ্ সেনাপতি মুসলিম ইবনু ‘উক্ববার নেতৃত্বে সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রেরণ করা হয়। (২) ৬৮৩ খ্রীস্টাব্দের ২৬ আগষ্ট হার্রা নামক স্থানে এ বাহিনীর সাথে মাদীনাবাসীদের ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং মাদীনাবাসীগণ পরাজিত হয় ।
এ যুদ্ধে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বহু মুহাজির ও আনসার সহাবী শাহীদ হন এবং বিজয়োল্লাসে উন্মত্ত সিরীয় বাহিনী তিন দিন ধরে মাদীনার পবিত্র নগরী লুন্ঠন করে। অতঃপর তারা মাক্কাহ্ অভিমুখে রওনা হয় । এখানে আবূ বাকর সিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর দৌহিত্র ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) ইতোমধ্যে নিজেকে খলীফা হিসেবে ঘোষণা করেন। পথিমধ্যে সেনাপতি মুসলিমের মৃত্যু হলে হুসায়ন ইবনু নুমায়র সিরীয় বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করে। (৩) তারা ৬৮৩ খ্রীস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর মাক্কাহ্ নগরী অবরোধ করে এবং পাহাড়ের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপক যন্ত্রের সাহায্যে আল্লাহর ঘর কা’বার উপর পাথর বর্ষণ করে অগ্নি সংযোগ করে এবং মারাত্নক ক্ষতি সাধন করে। তারা হাজারে আসওয়াদ ভেঙ্গে তিন টুকরা করে ফেলে।
এ বছরের নভেম্বর মাসে ইয়াযীদের মৃত্যু হলে সিরীয় বাহিনী অবরোধ তুলে দামেশ্কে প্রত্যাবর্তন করে। অতঃপর ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) ইব্রাহীম (‘আঃ)-এর ভিত-এর উপর কা’বাহ্ ঘর পুনর্নির্মাণ করেন। ৬৯২ খ্রীস্টাব্দে ‘আরাফাহ্ যুদ্ধে হাজ্জাজ বাহিনীর হাতে ইবনু যুবায়র (রাঃ) শহীদ হলে উমাইয়্যাহ রাজ ‘আবদুল মালিক পুনরায় কা’বাহ্ ঘর সংস্কারের নির্দেশ দেন। হাদীসে সে ঘটনাটি উল্লেখিত হয়েছে ।
সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩১৩৬
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
Source: আল হাদিস অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ, IRD
এই হাদীসগুলো রসুল (সা:) এর সত্যবাদী সাহাবী (রা:) দ্বারা বর্নিত এবং বুখারী, মুসলিমসহ পূববর্তী আলেমদের দ্বারা সত্যায়িত ও ব্যাখাকৃত। আমরা কোন নিজস্ব মতবাদ তুলে ধরেনি এর বিপরীত বহু বিকৃত ইতিহাস পাবেন যাতে জালেমদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের – রসুল (সা:) এর হাদীস মানবেন না ইতিহাস!?
আসমা বিনতে আবুবকর (রা) ও তার পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা:) হলেন যুগ যুগ ধরে জালেমের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের আদর্শ।