সাহাবিদের জীবনী পর্ব-৮ (উম্মতের মা আয়েশা রা.)

আয়েশা (রা:) রসুলের (সা:) সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গীনীর একজন ও উম্মতের সম্মানিত মা। অতীতের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ছিলেন মারইয়ম (আ:), আছিয়া (আ:)। আল্লাহর কাছে যে সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়,
শয়তানের পরিকল্পনা হল তাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো, বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে তার চরিত্রকে মানুষের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারা।

যেমন- অতীতে মারইয়ামকে (আ:) নিয়ে হয়েছিল, ইহুদিরা তাকে অপবাদ দিয়েছিল আর খ্রিস্টানরা বাড়াবাড়ি করেছিল। তেমনি আমাদের প্রিয় মা আয়েশাকে (রা:) নিয়ে ইসলামের শত্রু ও অনেক শিয়াদের মিথ্যা অপবাদ রয়েছে। আবার কিছু নাসেবী আয়েশা (রা:) কে আলী (রা:) এর মেকাবিলায় এনে উম্মতের মধ্যে ফেতনা সৃষ্টির প্রয়াস চালায়।

শিশুকালে আয়েশা (রা:) ছিলেন মেধাবী। হযরত খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর নবুয়তের দশম সনে মহানবি (স.)- এর সাথে হযরত আয়েশার (রা.) বিবাহ সম্পন্ন হয়। হযরত খাওলা বিনতে হাকিম ছিলেন এ বিবাহের ঘটক।

আইশাহ (রাযিঃ) এর মর্যাদা

আমর ইবনুল ‘আস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, আপনার নিকট সর্বাধিক প্রিয় কোন ব্যক্তি? তিনি বললেনঃ আয়িশাহ। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, পুরুষদের মাঝে কে? তিনি বললেনঃ তার পিতা। (সহীহঃ বুখারী ও মুসলিম)

আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান এবং ইসমাঈল-কাইস হতে এই সনদে বর্ণিত হাদীস হিসেবে গারীব।

আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যাবতীয় খাদ্যের উপর যেরূপ সারীদের (শোরবাতে ভেজানো রুটি) মর্যাদা, সকল স্ত্রীলোকের উপর তেমন আয়িশাহর মর্যাদা। (ইবনু মাজাহ, হাদিসের মানঃ সহিহ)

এই ছাড়া হাদীসে খাদিজা (রা:) ও ফাতেমার (রা:) প্রতি রসুলল্লাহ’র (সা) গভীর ভালোবাসা ও সম্মানের প্রমান পাওয়া যায়। যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল তখন খাদিজা (রা:) মৃত্যুবরন করেন। আর সাহাবিদের মধ্যে সর্বোত্তম আবু বকর (রা) আর সাহাবিরা বুঝতো রসুল (সা:) আহলে বায়াতকে অনেক বেশি ভালোবাসেন (বিশেষ করে ফাতেমাকে রা.)। তাই রসুলকে (সা:) প্রশ্ন করার সময় আহলে বায়াতকে বাদ দিয়ে প্রশ্ন করতেন।

আর রসুল (সা:) উম্মতের মনোভাব ধারণা করতে পারতেন।।

সাহাবী, তাবেয়ীদের যুগে কেউ আহলে বায়াতের সাথে আয়েশা (রা:) ও রসূলের অন্য স্ত্রীদের তুলনা আনতেন না! পরবর্তীতে ফেতনা সৃষ্টি করার জন্য এটার তুলনা আনা হয়। প্রত্যেকেই রসুলের (সা:) প্রিয় ও সুমহান মর্যাদার অধিকারী।

তার বিয়ের বয়স নিয়ে ইসলামের শত্রুরা বিভিন্ন অপবাদ ও ভুল ব্যাখা দিয়ে থাকে। বহুজনই তার উত্তর দিয়েছে।

মূল ব্যাপার হল – রসুলের (সা:) জীবনসঙ্গিনীরুপে আয়েশা (রা:) কে স্বয়ং আল্লাহ পছন্দ করেছেন। যিনি অল্পবয়সে কুরআন মুখস্থ করেছেন, সর্বাধিক হাদীস বর্ননাকারীদের একজন যার স্মৃতিশক্তি, হিকমাহতে বহু সাহাবী লাভবান হন।

আবু মুসা আশয়ারী রাঃ বলেন- যখন আমরা সাহাবীরা কোন হাদিস বুঝতে অক্ষম হতাম তখন হযরত আয়েশা (রা.) এর খেদমতে উপস্থিত হলে তিনি তাঁর অতুলনীয় জ্ঞানের মাধ্যমে মাসআলা বুঝিয়ে দিতেন। ওরয়াহ (রাঃ) বলেন- আমি হযরত আয়েশা (রা.) এর চেয়ে বড় চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানী কাউকে দেখিনি। তিনি আরাে বলেন- কোরআনে হাকীম, ফারায়েজ, হালাল-হারাম, কবিতা, ইতিহাস এবং নসবনামা সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বড় জ্ঞানী কাউকে দেখিনি।

হাদীসে রয়েছে, নবীজির সা. চরিত্র ছিল আল কুরআন।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ হাদিস: ২৫৮১৩ তহাবী: ৪৪৩৫

আসওয়াদ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আয়িশাহ্ (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন,

قَالَتْ كَانَ يَكُونُ فِي مِهْنَةِ أَهْلِهِ تَعْنِي خِدْمَةَ أَهْلِهِ

অর্থ: তিনি বললেন, ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের সহায়তা করতেন।
সূত্র: সহিহ বুখারী হাদিস: ৬৭৬

হযরত আয়েশাকে রা. জিজ্ঞেস করা হলো, রাসুল সা. ঘরে কী করতেন? তিনি বললেন,

كان يَخيطُ ثَوبَه ويَخصِفُ نَعلَه قالَتْ وكان يَعملُ ما يَعمَلُ الرِّجالُ في بُيوتِهم

অর্থ: নবীজি নিজ হাতে জামা সেলাই করতেন জুতা সেলাই করতেন এবং তোমাদের মতো তিনি ঘরের যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতেন।
সূত্র: মুসনাদে আহমাদ হাদিস: ২৬২

আয়িশাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্বহস্তে কোন দিন কাউকে আঘাত করেননি, কোন নারীকেও না, খাদিমকেও না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ব্যতীত। আর যে তার অনিষ্ট করেছে তার থেকে প্রতিশোধও নেননি। তবে আল্লাহর মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন বিষয়ে তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন। সূত্র: সহীহ মুসলিম হাদিস: ২৩২৮

এভাবে বিভিন্ন হাদীসে রসুলের (সা:) জীবনী উম্মতের আদর্শ যা তুলে ধরার জন্য আল্লাহ আয়েশাকে (রা:) পছন্দ করেছেন। কারন একজন স্ত্রীই স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে উত্তম জানেন। আয়েশা (রা:) পবিত্র ঘোষণা করে কুরআনের আয়াত এসেছে।

ফেতনা সৃষ্টি

উসমানের (রা:) হত্যাকে কেন্দ্র করে যে ফেতনা সৃষ্টি হয় তাতে জঙ্গে জামালে আলীর (রা:) বিপরীতে অবস্থান করাকে কেন্দ্র করে অনেকে ভুল ব্যাখা করে তাকে অপবাদ দেয় নাউজুবিল্লাহ। (এগুলো বিস্তারিত আলোচনার বিষয় কিছু পোস্ট আছে আমাদের, বাকীগুলো পরে আসবে ইনশাআল্লাহ)

আসলে মূল ব্যাপার হল তিনি যুদ্ধে আগ্রহী ছিলেন না বরং তাকে দেখলে শান্তি ফিরে আসতে পারে এজন্য তিনি অনিচ্ছা স্বত্বেও অবস্থান নেন।

কায়েস বর্ণনা করেন, উম্মুল মুমিনীন ‘আইশাহ যখন তার বাহিনী নিয়ে বনু আমিরের জলাশয়ের নিকট পৌঁছালেন, তখন কুকুর ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই জলাশয়ের নাম কী? তারা উত্তরে বললেন: ‘হাওয়ার জলাশয়’। একথা শুনে তিনি বললেন: তাহলে আমাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। তার সঙ্গীগণের কেউ এই সিদ্ধান্তে পরামর্শ দিলেন: না, বরং আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার। হয়তোবা মুসলিমগণ আপনাকে দেখার পর মহান আল্লাহ তাদের মধ্যে শান্তির ব্যবস্থা করে দেবেন। উম্মুল মুমিনীন ‘আইশাহ বলেন; আল্লাহর নবী একবার আমাকে বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্যে একজনের অবস্থা কেমন হবে যখন হাওয়ার এর কুকুর তার দিকে ঘেউঘেউ করা শুরু করবে।” [মুসনাদ আহমাদ ২৪২৯৯ ( ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৫২, সিলসিলা সহীহাহ ৪৭৪ )।

ঘটনাপ্রবাহ

উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীর সন্দেহের তালিকায় অন্যতম প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ বিন আবু বকর (রহঃ)। মাতা ভিন্ন হলেও পিতার দিক হতে আয়েশা (রা) এর আপন ভাই। তার মাতার নাম আসমা বিনতে উনাইস। আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্যুর পর আলী (রাঃ) তাকে বিয়ে করেন এবং মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর (রাঃ) তার গৃহে বড় হয়। ইতিহাস হতে যতটুকু জানা যায় – উসমানের (রাঃ) হত্যার দিন তিনিও উসমানের (রাঃ) গৃহে প্রবেশ করেন। কিন্তু যখন উসমান (রাঃ) তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন আবু বকর (রাঃ) উসমানকে (রাঃ) কিরূপ ভালোবাসতো তা শুনে তিনি গৃহ ত্যাগ করেন। কিন্তু ঘটনা ছড়িয়ে যায় – তিনি হত্যাকান্ডে শামিল হয়েছিলেন।

তাই আয়েশা (রাঃ) তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধা করেননি। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ বিন আবু বকর (রাঃ) ছিলেন আলী (রাঃ) এর অন্যতম সেনাপতি। তারা জানতেন আলী (রাঃ) হক্বের পথে। জঙ্গে জামাল শেষে আলী (রাঃ) তাকেই দায়িত্ব দেন আয়েশাকে (রাঃ) সস্মানে পৌছিয়ে দিতে।

শিয়ারা আবু বকর (রাঃ) সহ অনেককে কাফের বলে। অথচ আবু বকরের (রাঃ) ছেলে মুহাম্মদ বিন আবুবকর (রহঃ), তার ছেলে কাসিম (রহঃ) এবং কাসিমের (রহঃ) মেয়ে ফাতেমা, যিনি ছিলেন শিয়াদের সবচেয়ে বড় ঈমাম জাফর সাদিকের (রহঃ) মা। এই হতে বুঝা যায় প্রথম দিকে শিয়ারা আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করত। আর উমরের (রা:) বিয়ে হয় আলী (রা:) এর মেয়ে উম্মু কুলসুমের সাথে।।

পরবর্তী জীবনে আয়েশার (রা:) আলীর (রা:) প্রতি ভালোবাসা ও সম্মানের প্রমান পাওয়া যায় হাদীস হতে। বরং তিনি অনুশোচনারত থাকেন আর তিনি অসিয়ত করেন-

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনু যুবাইর (রাঃ)-কে অসিয়াত করেছিলেন, আমাকে তাঁদের (নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর দু’সাহাবী) পাশে দাফন করবে না। বরং আমাকে আমার সঙ্গিনীদের সাথে বাকী’তে দাফন করবে যাতে আমি চিরকালের জন্য প্রশংসিত হতে না থাকি।

হিকমাহ দেখুন- তার কবর যদি রসুলের (সা:) সাথে হতো একে (মর্যাদা নিয়ে বাড়াবাড়ি) কেন্দ্র করে হয়তো ফেতনাবাজরা আলী (রা:) ও ফাতেমার (রা:) মুকাবেলায় দাড় করাত। কারন তাদের কবর রসুলের (সা:) নিকট হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদী, নির্ভীক। অন্যায় মনে করে যিনি আলী (রা:) ও নিজের ভাই মুহাম্মদ বিন আবু বকরের (রা:) বিপক্ষে অবস্হান নিয়েছিলেন। পরবর্তীতপ মুহাম্মদ বিন আবু বকরের (রা:) উপর আঘাত আসলে (হত্যা হলে) তিনিই তীব্র প্রতিবাদ করেন।

হারূন ইবনু সাঈদ আইলী (রহঃ) ….. ‘আবদুর রহমান ইবনু শুমাসাহ্‌ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদা আয়িশাহ্ (রাযিঃ) এর নিকট কোন এক ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য গেলাম। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথাকার লোক? আমি জবাব দিলাম, আমি একজন মিসরবাসী।

তখন তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের সে গৃহযুদ্ধকালীন গভর্নর (মুহাম্মাদ ইবনু আবূ বাকর) কেমন লোক ছিলেন? রাবী বলেন, আমরা তো তার নিকট থেকে অন্যায়মূলক কিছু পাইনি। যদি আমাদের কোন ব্যক্তির উট মারা যেতো তিনি তাকে উট দিতেন। গোলাম মারা গেলে গোলাম দিতেন, কারো জীবিকার প্রয়োজন হলে তিনি তাকে তা প্রদান করতেন।

তখন তিনি বললেন, আমার সহোদর মুহাম্মাদ ইবনু আবূ বকরের সাথে যে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে, তা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমার এ ঘরে যা বলতে শুনেছি তা তোমাকে অবহিত করা থেকে আমাকে বিরত রাখতে পারছি না। (তিনি বলেছিলেন) হে আল্লাহ! যে আমার উম্মাতের কোনরূপ কর্তৃত্বভার লাভ করে এবং তাদের প্রতি রূঢ় আচরণ করে তুমি তার প্রতি রূঢ় হও, আর যে আমার উম্মাতের উপর কোনরূপ কর্তৃত্ব লাভ করে তাদের প্রতি নম্র আচরণ করে তুমি তার প্রতি নম্র ও সদয় হও। ( সহীহ মুসলিম-ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৫৭১, ইসলামিক সেন্টার ৪৫৭৪, হাদিসের মানঃ সহিহ।

বনু উমাইয়ার ক্ষমতার সময় মুহাম্মদ বিন আবু বকর (রা:) খুন হোন।

রসুল (সা:) হলেন পুরো মানবজাতির আদর্শ। আর উম্মতের মা আয়েশা (রা:) হলেন সারাবিশ্বে নারীজাতির আর্দশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *