সাহাবিদের জীবনী পর্ব-৭ (নিঃসঙ্গ সাহাবী আবু যার গিফারী রা.)

আবু যার গিফারী (রা:) রসুলের (সা:) সবচেয়ে প্রিয় বিশ্বস্ত সাহাবিদের একজন। রসুলের (সা:) হাতে ঈমান আনার আগেও তিনি মুসলিম ছিলেন। তিনি মূর্তিপূজা করতেন না, তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন। মক্কায় রসুলের (সা:) আগমনের সংবাদ পাবার কিছু পরেই ঈমান আনেন।

আবূ জামরাহ (রহ.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) আমাদেরকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে আবূ যার (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করব? আমরা বললাম হাঁ, অবশ্যই।

তিনি বলেন, আবূ যার (রাঃ) বলেছেন, আমি গিফার গোত্রের একজন মানুষ। আমরা জানতে পেলাম মক্কায় এক ব্যক্তি আত্মপ্রকাশ করে নিজেকে নবী বলে দাবী করছেন। আমি আমার ভাইকে বললাম, তুমি মক্কায় গিয়ে ঐ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে এস। সে রওয়ানা হয়ে গেল এবং মক্কার ঐ লোকটির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা করে ফিরে আসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম- কী খবর নিয়ে এলে? সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি একজন মহান ব্যক্তিকে দেখেছি যিনি সৎকাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করেন। আমি বললাম, তোমার খবরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।

অতঃপর আমি একটি ছড়ি ও এক পাত্র খাবার নিয়ে মক্কার দিকে রওয়ানা হলাম। মক্কায় পৌঁছে আমার অবস্থা দাঁড়াল এমন- তিনি আমার পরিচিত নন, কারো নিকট জিজ্ঞেস করাও আমি সমীচীন মনে করি না। তাই আমি যমযমের পানি পান করে মসজিদে থাকতে লাগলাম। একদিন সন্ধ্যা বেলা ‘আলী (রাঃ) আমার নিকট দিয়ে গমনকালে আমার প্রতি ইশারা করে বললেন, মনে হয় লোকটি বিদেশী। আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চল। পথেই তিনি আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করেননি।

আর আমিও ইচ্ছা করে কোন কিছু বলিনি। তাঁর বাড়িতে রাত্রি যাপন করে ভোর বেলায় আবার মসজিদে গেলাম যাতে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু ওখানে এমন কোন লোক ছিল না যে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলবে। ঐ দিনও ‘আলী (রাঃ) আমার নিকট দিয়ে চলার সময় বললেন, এখনো কি লোকটি তার গন্তব্যস্থল ঠিক করতে পারেনি? আমি বললাম, না।

তিনি বললেন, আমার সঙ্গে চল। পথিমধ্যে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বল, তোমার বিষয় কী? কেন এ শহরে এসেছ? আমি বললাম, যদি আপনি আমার বিষয়টি গোপন রাখার আশ্বাস দেন তাহলে তা আপনাকে বলতে পারি। তিনি বললেন নিশ্চয়ই আমি গোপন করব। আমি বললাম, আমরা জানতে পেরেছি, এখানে এমন এক লোকের আবির্ভাব হয়েছে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন। আমি তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করার জন্য আমার ভাইকে পাঠিয়েছিলাম।

কিন্তু সে ফেরত গিয়ে আমাকে সন্তোষজনক কোন কিছু বলতে পারেনি। তাই নিজে দেখা করার ইচ্ছা নিয়ে এখানে আগমন করেছি। ‘আলী (রাঃ) বললেন, তুমি সঠিক পথপ্রদর্শক পেয়েছ। আমি এখনই তাঁর কাছে উপস্থিত হবার জন্য রওয়ানা হয়েছি। তুমি আমাকে অনুসরণ কর এবং আমি যে গৃহে প্রবেশ করি তুমিও সে গৃহে প্রবেশ করবে। রাস্তায় যদি তোমার বিপদজনক কোন লোক দেখতে পাই তবে আমি জুতা ঠিক করার অজুহাতে দেয়ালের পার্শ্বে সরে দাঁড়াব, যেন আমি জুতা ঠিক করছি। তুমি কিন্তু চলতেই থাকবে। আলী (রাঃ) পথ চলতে শুরু করলেন। আমিও তাঁর অনুসরণ করে চলতে লাগলাম।

তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট প্রবেশ করলে, আমিও তাঁর সঙ্গে ঢুকে পড়লাম। আমি বললাম, আমার নিকট ইসলাম পেশ করুন। তিনি পেশ করলেন। আর আমি মুসলিম হয়ে গেলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবূ যার। এখনকার মত তোমার ইসলাম গ্রহণ গোপন রেখে তোমার দেশে চলে যাও। যখন আমাদের বিজয়ের খবর জানতে পাবে তখন এসো। আমি বললাম, যে আল্লাহ্ আপনাকে সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ! আমি কাফির মুশরিকদের সামনে উচ্চস্বরে তৌহীদের বাণী ঘোষণা করব। (ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন,) এই কথা বলে তিনি মসজিদে হারামে গমন করলেন, কুরাইশের লোকজনও সেখানে হাজির ছিল। তিনি বললেন, হে কুরাইশগণ! আমি নিশ্চিতভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এতদশ্রবণে কুরাইশগণ বলে উঠল, ধর এই ধর্মত্যাগী লোকটিকে। তারা আমার দিকে এগিয়ে আসল এবং আমাকে নির্মমভাবে প্রহার করতে লাগল; যেন আমি মরে যাই। তখন ‘আব্বাস (রাঃ) আমার নিকট পৌঁছে আমাকে ঘিরে রাখলেন।

অতঃপর তিনি কুরাইশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমাদের বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তোমরা গিফার বংশের জনৈক ব্যক্তিকে হত্যা করতে উদ্যোগী হয়েছ অথচ তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কাফেলাকে গিফার গোত্রের নিকট দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এ কথা শুনে তারা সরে পড়ল। পরদিন ভোরবেলা কাবাগৃহে উপস্থিত হয়ে গতদিনের মতই আমি আমার ইসলাম গ্রহণের পূর্ণ ঘোষণা দিলাম। কুরাইশগণ বলে উঠলো, ধর এই ধর্মত্যাগী লোকটিকে। গতদিনের মত আজও তারা নির্মমভাবে আমাকে মারধর করলো। এই দিনও ‘আব্বাস (রাঃ) এসে আমাকে রক্ষা করলেন এবং কুরাইশদেরকে উদ্দেশ্য করে ঐ দিনের মত বক্তব্য রাখলেন। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, এটাই ছিল আবূ যার (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের প্রথম ঘটনা। (৩৮৬১, মুসলিম ৪৪/২৮ হাঃ ২৪৭৪) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২৬৫)।

ইসলাম গ্রহনের পর হতে তিনি হয়ে উঠেন রসুলের (সা:) সবচেয়ে প্রিয় ও আস্হাভাজন সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি গিফার গোত্রের মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। এ কাজে কখনও তারা হতাশ হননি, কখনও মনোবল হারাননি। অপ্রাণ চেষ্টায় এ গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে সালাতের জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এক দল লোক বলে, আমরা আমাদের ধর্মের ওপর অটল থাকবো। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় এলে আমরা ইসলাম গ্রহণ করবো। রাসূলের (সা.) মদীনায় হিজরতের পর তারাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ গিফার গোত্র সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেনঃ ‘‘গিফার গোত্র- আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন, আর আসলাম গোত্র- আল্লাহ তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছেন।

আবূ যার আল-গিফারী (রাযিঃ)-এর মর্যাদা

‘আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি বলতে শুনেছিঃ আবূ যার হতে বেশি সত্যবাদী কাউকে আকাশ ছায়া দান করেনি এবং মাটি ও তার বুকে বহন করেনি। সহীহঃ ইবনু মাজাহ (১৫৬)।

আবূ ঈসা বলেন, এ অনুচ্ছেদে আবূদ দারদা ও আবূ যার (রাযিঃ) কর্তৃকও হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীসটি হাসান।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাবুকের দিকে অগ্রসর হলেন, তখন কেউ কেউ পিছনে পড়ে যেত, তখন লোকেরা বলত: হে রাসুলুল্লাহ, অমুক অমুক! লোকটি পেছনে পড়ে গেছে, তিনি বলতেন, তাকে ছেড়ে দাও, যদি তার মধ্যে কল্যাণ থাকে তবে সে এসে তোমাদের সাথে যোগ দেবে। আর যদি তার মধ্যে কোনো কল্যাণ না থাকে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তার থেকে রক্ষা করেছেন। এমনকি কেউ একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আবু যার পিছনে পড়ে আছে, তার উট তাকে পিছনে রেখে দিয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে ছেড়ে দাও, যদি তার তোমাদের সাথে থাকার মধ্যে কল্যাণ হয় তবে সে শীঘ্রই তোমার সাথে মিলিত হবে এবং যদি তার মধ্যে কোনো কল্যাণ না থাকে তো আল্লাহ তায়ালা তার থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন।

হযরত আবু যার (রা) কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন কিন্তু উটটি উঠলো না। এতে তিনি নিরাশ হয়ে গেলেন, অতপর তিনি তার মালামাল খুলে পিঠে বোঝাই করলেন এবং পায়ে হেঁটে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ করলেন। অতঃপর জনৈক সাহাবী তাকে দেখে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, ইনি কে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন? তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি আবু যার হয়ে যাও। লোকেরা যখন তাকে মনোযোগ সহকারে দেখল, তখন তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! তিনি প্রকৃতপক্ষে আবু যার (রাঃ)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ আবু যারের উপর রহম করুন, সে একা ভ্রমণ করছে, সে একাই মৃত্যুবরণ করবে, কেয়ামতের দিন একাই উঠবে।
এই হাদিসটি সহীহ আল-আসনাদ, (মুস্তাদরাকে হাকিম : ৪৩৭৩)

বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। রসুলের (সা.) ইনতিকালের পর যখনই পবিত্র নামটি তাঁর জিহ্বায় এসে যেত, চোখ থেকে অঝোরে অশ্রুধারা প্রবাহিত হত।

একদিন এক ব্যক্তি আবু যারের নিকট এলো। সে তাঁর ঘরের চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো। গৃহস্থালীর কোন সামগ্রী দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘আবু যার, আপনার সামান-পত্র কোথায়?

– ‘আখিরাতে আমার একটি বাড়ী আছে। আমার সব উৎকৃষ্ট সামগ্রী সেখানেই পাঠিয়ে দিই।’

একদা সিরিয়ার আমীর তাঁর নিকট তিনশ’ দীনার পাঠালেন। আর বলে পাঠালেন, এ দ্বারা আপনি আপনার প্রয়োজন পূর্ণ করুন। ‘শামের আমীর কি আমার থেকে অধিকতর নীচ কোন আল্লাহর বান্দাকে পেলনা?’- একথা বলে তিনি দীনারগুলি ফেরত পাঠান।

আবু যার গিফারী (রা:) ছিলেন দুনিয়াবিমুখ সাহাবী। উসমানের (রা:) খেলাফতকালে কুরআনের আয়াত নিয়ে মতানৈক্যের কারনে তিনি লোকালয় ছেড়ে দূরে বসবাস শুরু করেন।

যায়দ ইবনু অহব (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাবাযাহ নামক স্থান দিয়ে চলার পথে আবূ যার (রাঃ)-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হলো। আমি তাঁকে বললাম, আপনি এখানে কী কারণে আসলেন? তিনি বললেন, আমি সিরিয়ায় অবস্থানকালে নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে আমার মতানৈক্য হয় :

‘‘যারা সোনা-রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর রাস্তায় তা ব্যয় করে না……’’- (আত্তাওবাঃ ৩৪)। মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, এ আয়াত কেবল আহলে কিতাবদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি বললাম, আমাদের ও তাদের সকলের সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এক সময় মু‘আবিয়া (রাঃ) ‘উসমান (রাঃ)-এর নিকট আমার নামে অভিযোগ করে পত্র পাঠালেন। তিনি পত্রযোগে আমাকে মাদ্বীনায় ডেকে পাঠান। মাদ্বীনায় পৌঁছলে আমাকে দেখতে লোকেরা এত ভিড় করলো যে, এর পূর্বে যেন তারা কখনো আমাকে দেখেনি। ‘উসমান (রাঃ)-এর নিকট ঘটনা বিবৃত করলে তিনি আমাকে বললেন, ইচ্ছা করলে আপনি মাদ্বীনার বাইরে নিকটে কোথাও থাকতে পারেন। এ হল আমার এ স্থানে অবস্থানের কারণ। খালীফা যদি কোন হাবশী লোককেও আমার উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেন তবুও আমি তাঁর কথা শুনব এবং আনুগত্য করবো। বুখারী (৪৬৬০) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩১৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩২১), হাদিসের মানঃ সহিহ।

আসলে রসুলের (সা:) প্রথমদিকে ঈমান আনয়নকারী সাহাবীদের তাকওয়া এমন ছিল তারা নূন্যতম সম্পদ জমানো পছন্দ করতেন না, প্রায় সবাই দান করে দিতেন। অন্যদিকে পরবর্তীতে অনেকে সম্পদ জমা করত ও যাকাত দেওয়া আমল করতো। আবার এটাও সঠিক উমরের (রা:) পরবর্তী অনেক গভর্নর বিলাসী হয়ে গেছিল, আর আবু যার গিফারী বিলীসিতা ঘৃনা করতেন। আর উসমান (রা:) ফেতনা সৃষ্টি হতে পারে এই ভয়ে চলে যেতে বলেছিলেন।

আবু যার গিফারী (রা:) এই হাদীসের অনুসরণ করতেন।

কথাটি আমাকে আমার বন্ধু বলেছেন। রাবী বলেন, আমি বললাম, আপনার বন্ধু কে? সে বলল, তিনি হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি আমাকে বলেন, হে আবূ যার! তুমি কি উহুদ পাহাড় দেখেছ? তিনি বলেন, তখন আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দিনের কতটুকু অংশ বাকি রয়েছে। আমার ধারণা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন প্রয়োজনে আমাকে পাঠাবেন। আমি জবাবে বললাম, জী-হাঁ। তিনি বললেনঃ আমি পছন্দ করি না যে আমার জন্য উহুদ পর্বত পরিমাণ স্বর্ণ হোক আর তা সমুদয় আমি নিজের জন্য ব্যয় করি তিনটি দ্বীনার ব্যতীত। [আবূ যার (রাঃ) বলেন] তারা তো বুঝে না, তারা শুধু দুনিয়ার সম্পদই একত্রিত করছে। আল্লাহর কসম, না! না! আমি তাদের নিকট দুনিয়ার কোন সম্পদ চাই না এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করা পর্যন্ত দ্বীন সম্পর্কেও তাদের নিকট কিছু জিজ্ঞেস করবো না। (মুসলিম ১২/১০, হাঃ ৯৯২) ( সহীহ বুখারী, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩১৬ শেষাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩২২ শেষাংশ), হাদিসের মানঃ সহিহ।

অন্য হাদীসে এসেছে –

হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আবু যার! সেই সময় কেমন হবে যখন তুমি নোংরা লোকদের মধ্যে অবস্থান করবে? এই বলে এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এমতাবস্থায় আপনি আমার জন্য কি বলেন? তিনি বললেন, ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর। মানুষের সাথে ভালো আচরণ করা এবং তাদের কাজে তাদের বিরোধিতা করা।
হাদীসটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের মান অনুযায়ী সঠিক, (মুস্তাদারকে হাকিম : ৫৪৬৪)

মৃত্যুর কোলে প্রিয় সাহাবী

যখন তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি তাঁর স্ত্রী ও দাসকে ওসীয়াত করলেন যে, আমি যখন মারা যাব তখন আমাকে গোসল করাবে এবং কাফন পরিয়ে দেবে। তোমাদের পাশ দিয়ে যাওয়া প্রথম কাফেলাকে বলবে যে এটি আবু যার। যখন তিনি মারা যান, তারা তার ওসীয়াতের অনুসরণ করে।

একটি কাফেলা হাজির, কিন্তু তারা জানত না যে যতক্ষণ না তারা এত কাছে আসে যে তাদের ঘোড়াগুলি তাদের খাট মাড়িয়ে দেবে, তখন এই কুফাবাসীদের কাফেলার মধ্য থেকে হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার জানাযা? তারা বললেন এটা আবু যার এর জানাযা। তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ চিৎকার করে উঠলেন এবং বললেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য বলেছেন: আল্লাহ আবু যারের প্রতি রহম করুন, তিনি একাই তাবুকে সফর করেছেন এবং একাই মৃত্যুবরণ করবেন এবং একাই পুনরুত্থিত হবেন। অতঃপর তিনি নামলেন এবং তাকে নিজেই দাফন করলেন। সেই লোকেরা মদীনায় এসে হযরত উসমান (রা.)-কে আবদুল্লাহর কথোপকথন ও তার কর্মকাণ্ডের কথা জানায়।
(মুস্তাদরাকে হাকিম : ৪৩৭৩,হাদীসের অংশ)

ঐতিহাসিকদের মতে-
‘‘আবু যারের (রা:) অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে পড়লো, আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, কাঁদছো কেন? বললামঃ এক নির্জন মরুভূমিতে আপনি পরকালের দিকে যাত্রা করছেন। এখানে আমার ও আপনার ব্যবহৃত বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত এমন বস্ত্র নেই যা দ্বারা আপনার কাফন দেওয়া যেতে পারে। তিনি বললেনঃ কান্না থামাও। তোমাকে একটি সুসংবাদ দিচ্ছি। রাসূল সা.-কে আমি বলতে শুনেছি, ‘যে মুসলিমের দুই অথবা তিনটি সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য তাই-ই যথেষ্ট।

তিনি অসিয়ত করেছিলেন ‘যদি আমার নিকট অথবা আমার স্ত্রীর নিকট থেকে কাফনের পরিমাণ কাপড় পাওয়া যায় তাহলে তা দিয়েই আমাকে দাফন দেবে।’ তারপর তাদেরকে কসম দিলেন, যে ব্যক্তি সরকারের ক্ষুদ্রতম পদেও অধিষ্ঠিত সে যেন তাঁকে কাফন না পরায়। ঘটনাক্রমে এক আনসারী যুবক ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য সকলেই কোন না কোন সরকারী দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। আবু যার তাকেই কাফন পরাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। তার মানে এই নয় তার উসমানের (রা) প্রতি বিদ্বেষ ছিল বরং তিনি খলিফার আনুগত্য করতেন এবং উসমানের (রা:) প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান ছিল অতুলনীয়। তবে সরকারি পদের অনেকের বিলাসী জীবন তার কষ্টের কারন ছিল।

হযরত উসমানের খিলাফতকালে আবু যার একবার হজ্জে গেলেন। এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘উসমান মিনায় অবস্থানকালে চার রাকা’আত নামায আদায় করেছেন (অর্থাৎ কসর করেননি)।’ বিষয়টি তাঁর মনঃপুত হলো না। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা), আবু বকর ও উমারের পেছনে আমি নামায আদায় করেছি। তাঁরা সকলে দু’ রাকা’আত পড়েছেন।’ একথা বলার পর তিনি নিজেই ইমামতি করলেন এবং চার রাকা’আতই আদায় করলেন। লোকেরা বলল, ‘আপনিইতো আমীরুল মু’মিনীনের সমালোচনা করলেন আর এখন নিজেই চার রাকাআত আদায় করলেন।’
তিনি বললেন, ‘‘মতভেদ খুবই খারাপ বিষয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমার পরে যারা আমীর হবে তাদের অপমান করবে না। যে ব্যক্তি তাদের অপমান করার ইচ্ছা করবে সে ইসলামের সুদৃঢ় রজ্জু স্বীয় কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলবে এবং নিজের জন্য তাওবার দরজা বন্ধ করে দেবে।’’ (মুসনাদে আহমাদ, ৫/১৬৫)

আল্লাহ মুমিনদের আবু যার গিফারীর (রা:) দুনিয়াবিমুখতা ও রসুলের (সা:) সান্নিধ্যে প্রিয় ব্যক্তিদের মত পরিনত করুন। প্রকৃত খলিফা থাকলে তার আনুগত্য ও ভুল হলে তুলে ধরার সাহস দিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *