যুবায়ের (রা:) হলেন রসুলের (সা:) সবচেয়ে প্রিয় দশজন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবিদের একজন। যুবাইর (রা:) ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফাতো ভাই। উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা ছিলেন তাঁর ফুফু। অন্যদিকে হযরত সিদ্দিকে আকবরের কন্যা হযরত আসমাকে বিয়ে করায় রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন তাঁর ভায়রা। হযরত আসমা (রা) ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশার (রা) বোন। এভাবে রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে ছিল তাঁর একাধিক আত্মীয়তার সম্পর্ক। তার জীবনী যেমন আকর্ষণীয়, মুমিন, মুজাহিদদের অনুপ্রেরণা আর তার শাহাদাত বেদনাদায়ক ও বিশাল ক্ষতির কারন।
যুবাইর (রা) মাত্র ষোল বছর বয়সেই ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। যদিও তাঁর বয়স ছিল কম তবুও দৃঢ়তা ও জীবনকে বাজি রাখার ক্ষেত্রে কারো থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর একবার কেউ রটিয়ে দিয়েছিলো, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহকে (সা) বন্দী অথবা হত্যা করে ফেলেছে। একথা শুনে তিনি আবেগ ও উত্তেজনায় এতই আত্মভোলা হয়ে পড়েছিলেন যে তক্ষুণি একটানে তরবারি কোষমুক্ত করে মানুষের ভিড় ঠেলে আল্লাহর রাসূলের (সা) দরবারে গিয়ে হাজির হন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে যুবাইর?’ তিনি বললেন, ‘শুনেছিলাম, আপনি বন্দী অথবা নিহত হয়েছেন।’ রাসূলে কারীম (সা) অত্যন্ত খুশী হয়ে তাঁর জন্যে দুআ করেন। সীরাত লেখকদের বর্ণনা, এটাই হচ্ছে প্রথম তলোয়ার যা আত্মোৎসর্গের উদ্দেশ্যে একজন বালক উন্মুক্ত করেছিলো।
ইসলাম গ্রহনের পর তিনি বহু কষ্ট সহ্য করেন এবং তিনি হিজরত করেন। বদরের যুদ্ধে তিনি সাহসী মহাবীরের মত লড়েছিলেন যে তাঁর তরবারি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো এবং আঘাতে আঘাতে তাঁর সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো। এ দিনের একটি ক্ষত এত গভীর ছিল যে চিরদিনের জন্য তা একটি গর্তের মত হয়ে গিয়েছিলো। হাদীসে এসেছে-
‘উরওয়াহ (রহ.) হতে বর্ণিত। ইয়ারমুক যুদ্ধে যোগদানকারী মুজাহিদগণ যুবায়রকে বললেন, আপনি কি আক্রমণ কঠোরতর করবেন না? তা হলে আমরাও আপনার সঙ্গে (সর্বশক্তি নিয়ে) আক্রমণ করব। এবার তিনি ভীষণভাবে আক্রমণ করলেন। শত্রুরা তাঁর স্কন্ধে দু’টি আঘাত করল। ক্ষতদ্বয়ের মধ্যে আরো একটি ক্ষতের দাগ ছিল যা বদর যুদ্ধে হয়েছিল। ‘উরওয়াহ (রহ.) বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আঘাতের জায়গাগুলোতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম। (৩৯৭৩, ৩৯৭৫) (বুখারী, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৪৫১)
উহুদের ময়দানে রসুল (সা:) কে বাচাতে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
খন্দকের যুদ্ধ
আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দক যুদ্ধ চলা কালে আমি এবং ‘উমার ইবনু আবূ সালামাহ (অল্প বয়সি বলে) মহিলাদের দলে চলছিলাম। হঠাৎ যুবায়রকে দেখতে পেলাম যে, তিনি অশ্বারোহণ করে বনী কুরায়যা গোত্রের দিকে দু‘বার অথবা তিনবার আসা যাওয়া করছেন। যখন ফিরে আসলাম তখন বললাম, আব্বা! আমি আপনাকে কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখেছি। তিনি বললেন, হে প্রিয় বৎস! তুমি কি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, কে বনী কুরায়যা গোত্রের নিকট গিয়ে তাদের খবরা-খবর জেনে আসবে? তখন আমিই গিয়েছিলাম। যখন আমি ফিরে আসলাম তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার জন্য তাঁর মাতা-পিতাকে একত্র করে বললেন, আমার মাতাপিতা তোমার জন্য কুরবান হোক। (মুসলিম ৪৪/৬ হাঃ ২৪১৬, আহমাদ ১৪০৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৪৫০) হাদিসের মানঃ সহিহ।
আমর আন নাকিদ (রহঃ) ….. জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধের দিবসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের জিহাদের অনুপ্রেরণা দিলেন। যুবায়র (রাযিঃ) এর আহবানে সাড়া দিলেন। আবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডাকলেন। তখনও যুবায়রই সাড়া দিলেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় ডাকলেন। যুবায়রই সাড়া দিলেন। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ প্রত্যেক নবীরই একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী থাকে, আর আমার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলো যুবায়র। (সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬০২৫, ইসলামিক সেন্টার ৬০৬৩) হাদিসের মানঃ সহিহ।
খলীফা হযরত ’উসমানের (রা:) খিলাফতকালে হযরত যুবাইর (রা.) নিরিবিলি জীবন যাপন করছিলেন। কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। ৩৫ হিজরীতে বিদ্রোহীদের দ্বারা হযরত ’উসমান অবরুদ্ধ হলে তাঁর নিরাপত্তার জন্য হযরত যুবাইর স্বীয় পুত্র হযরত আবদুল্লাহকে নিয়োগ করেন। হযরত ’উসমান শহীদ হলে রাতের অন্ধকারে গোপনে তিনি তাঁর জানাযার নামায আদায় করেন।
এরপর উম্মাহর জন্য সবচেয়ে কঠিনতম ফেতনার সময় মুনাফেকদের ষড়যন্ত্রের কারনে যুবায়ের (রা:), তালহা (রা), আয়েশা (রা:) সহ সাহাবীরা পরস্পর আলীর (রা:) দলের মুখোমুখি হয়। আলী (রা:) যখন শুনলেন যুবায়ের (রা:) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছেন। তাই হযরত আলী (রা:) একাকী ঘোড়ায় চড়ে রণাঙ্গণের মাঝখানে এসে হযরত যুবাইরকে ডেকে বলছেন, ‘আবু আবদুল্লাহ! তোমার কি সে দিনটির কথা মনে আছে, যে দিন আমরা দু’জন হাত ধরাধরি করে রাসূলুল্লাহর (সা.) সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাসূল (সা.) তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ তুমি কি আলীকে মুহাব্বত কর? বলেছিলেঃ হ্যাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্মরণ কর, তখন রাসূল সা. বলেছিলেনঃ ‘একদিন তুমি অন্যায়ভাবে তার সাথে লড়বে।’ হযরত যুবাইর জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ এখন আমার স্মরণ হচ্ছে।’
একটি মাত্র কথা। কথাটি বলে হযরত আলী (রা.) তাঁবুতে ফিরে গেলেন। এ দিকে যুবাইরের অন্তরে ঘটে গেল এক বিপ্লব। তাঁর সকল সংকল্প ও দৃঢ়তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশার (রা.) কাছে এসে বললেনঃ আমি সম্পূর্ণ ভুলের ওপর ছিলাম। আলী আমাকে রাসূলুল্লাহর (সা.) একটি বাণী স্মরণ করে দিয়েছে। আয়িশা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে এখন ইচ্ছা কি?’ তিনি বললেনঃ ‘আমি এ ঝগড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।’
হযরত যুবাইরকে যেতে দেখে আহনাফ বিন কায়েস বললেনঃ ‘কেউ জেনে এসো তো তিনি যাচ্ছেন কেন?’ আমর ইবন জারমুয বললো, ‘আমি যাচ্ছি।’ এই বলে সে অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে হযরত যুবাইরের সঙ্গে মিলিত হলো। তখন তিনি বসরা ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে পৌঁছেছেন। কাছে এসে ইবনে জারমুয বললেনঃ
– আবু আবদুল্লাহ। জাতিকে আপনি কি অবস্থায় ছেড়ে এলেন?
– তারা সবাই একে অপরের গলা কাটছে।
– এখন কোথায় যাচ্ছেন?
– আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। এ কারণে এ ঝগড়া থেকে দূরে থাকার জন্যে অন্য কোথাও যেতে চাই।
ইবন জারমুয বললোঃ ‘চলুন, আমাকেও এ দিকে কিছুদূর যেতে হবে।’ দু’জন এক সংগে চললেন। জুহরের নামাযের সময় হযরত যুবাইর থামলেন। ইবনে জারমুয বললো, ‘আমিও আপনার সাথে নামায আদায় করবো। দু’জন নামাযে দাঁড়ালেন। হযরত যুবাইর যেই তাঁর মা’বুদের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়েছে, বিশ্বাসঘাতক ইবনে জারমুয অমনি তরবারির এক আঘাতে রাসূলুল্লাহর (সা.) হাওয়ারীর দেহ থেকে তাঁর শির বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
ইবন জারমুয হযরত যুবাইরের তরবারি, বর্ম ইত্যাদিসহ হযরত আলীর (রা.) নিকট উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত গর্বের সাথে তার কৃতিত্বের বর্ণনা দিল। আলী (রা.) তলোয়ারের দিকে অনুশোচনার দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়ে বললেন, ‘তিনি অসংখ্যবার রাসূলুল্লাহর (সা.) সম্মুখ থেকে মুসিবতের মেঘমালা অপসারণ করেছেন। ওরে ইবন সাফিয়্যার হন্তা, শুনে রাখ, জাহান্নাম তোর জন্যে প্রতীক্ষা করছে।’ (আসহাবে রসুল, সিলসহাতুল সহীহাহ).
জারবিন, ইবনে জাইশের থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি আলী (রাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম, তখন ইবনে জারমুজ তাঁর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। আলী (রাঃ) বললেন হযরত স্যাফিয়্যার ছেলে অর্থ্যাৎ যুবাইর বিন আওয়ামের হত্যাকারীকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিন। অতঃপর আলী (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক নবীর একজন হাওয়ারী আছে এবং আমার উম্মতের হাওয়ারী হলেন যুবাইর। ইমাম সুফিয়ান বলেন, হাওয়ারী মানে সাহায্যকারী। (মুসনাদে আহমাদ,খেলাফত ও ইমারত প্রসঙ্গ অধ্যায়ঃ ১১৭০১)।
অন্য হাদীসে এসেছে
কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরা পাহাড়ের উপর ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আবূ বাকর, উমার, আলী, উসমান, তালহাহ ও যুবায়র (রাযিঃ)। সে সময় পাথরটি কেঁপে উঠল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ থাম! তোর উপর নবী, সিদ্দিক বা শহীদ ব্যতীত আর কেউ নয়। ( সহীহ মুসলিম- ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬০২৯, ইসলামিক সেন্টার ৬০৬৭)
সারা জীবন তিনি ফেতনা (শিরক, ইসলামের শত্রু) নির্মূলের জন্যই তরবারি উঠিয়েছিলেন আর শেষ সময় ফেতনা হতে বিরত থাকতে তরবারি ছেড়েছেন। আর শেষ পর্যন্ত তরবারির আঘাতেই শাহাদাত বরন করেছেন।
শিক্ষনীয় বিষয় হল- হাদীস ভুলাটা স্বাভাবিক তাই হাদীস না জানা, ভুল বুঝার কারনে শত্রুতা না করে স্মরন করিয়ে দেওয়া উচিত। আর মুসলিম পরস্পর যুদ্ধের মুখামুখি হলেও জেহাদের ময়দানেও দাওয়াত দিতে হবে। হয়তো কেউ ভুল বুঝে সঠিক পথে ফিরে আসবে, আর শত্রুতা, বন্ধুত্ব শুধু হক্বের জন্য। অন্যদের মতো তিনিও ভেবেছিলেন আলীর (রা) দলে উসমানের (রা:) হত্যাকারী রয়েছেন তাই আপন মামাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন আবার হাদীস স্মরনে ভুল ভেঙ্গে অস্ত্র ছেড়েছেন।
আসলে উসমানের (রা:) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যা অবশ্যই মহাভুল (বিদআত) ছিল। বিদ্রোহীদের চেনা গেলেও প্রকৃতপক্ষে কারা হত্যা করেছিল প্রমান ছিল না। মুনাফেকের ষড়যন্ত্রে মনে হয়েছিল – আলী (রা) তাদের আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করছে।
আরেকটা শিক্ষনীয় বিষয় হল- পরিস্থিতি যাই হোক সহীহ হাদীস অনুসরণেই চিরন্তন মুক্তি। আজও মিডিয়ার অপপ্রচার, মুনাফেকের ষড়যন্ত্র যতই থাকুক না কেন কুরআন, সুন্নাহর অনুসরণেই উম্মাহর মুক্তি।