সাহাবিদের জীবনী পর্ব-৩ (শহীদী পরিবার)

আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা:) ইসলামের প্রথম অবস্থায় ঈমান আনয়নকারী সাহাবীদের অন্যতম। অনেকের মতে তিনি ৭ম ব্যক্তি যিনি ঈমান আনয়ন করেন। তার মাতা সুমাইয়া (রা:) ও তার পিতা ইয়াসির (রা:) ঈমান আনয়ন করেন। ঈমান আনয়নের পর তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চলে।

যেহেতু হযরত সুমাইয়া (রাঃ) এর কোন নিজস্ব গোত্র ছিল না তাই আবু জাহেল তার ইচ্ছামত হযরত সুমাইয়া (রাঃ) কে অত্যাচার করত। এমনি একদিন, ‘আম্মার ও তাঁর পিতা-মাতার উপর উত্তপ্ত রোদে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আম্মারের পিতা রাসূলকে (সা) দেখে বলে ওঠেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! কালচক্র এ রকম? রাসূল (সা) বললেনঃ হে ইয়াসিরের পরিবার-পরিজন ! ধৈর্য ধর। হে আল্লাহ ইয়াসিরের পরিবারবর্গকে ক্ষমা করুন।

সারাদিন এভাবে শাস্তি ভোগ করার পর সন্ধ্যায় তাঁরা মুক্তি পেতেন। শাস্তি ভোগ করে হযরত সুমাইয়া প্রতিদিনের মত একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন। পাষণ্ড আবু জাহল তাঁকে অশালীন ভাষায় গাল দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তার পশুত্বের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়। সে সুমাইয়ার দিকে বর্শা ছুড়ে মারে এবং সেটি তাঁর যৌনাঙ্গে গিয়ে বিদ্ধ হয় এবং তাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এরপর তার স্বামী ইয়াসির (রা) কে শহীদ করা হয়।

রসুল (সা:) এর যুগে ইসলাম গ্রহনের পর প্রথম শহীদ হলেন সুমাইয়া (রা)। এরপর দীর্ঘসময় দুঃখ, কষ্টের মধ্যে দিয়ে মুসলিমদের বিজয় হয়। মক্কা বিজয়ের সময় সাহাবীদের অনেকের মনে পড়ছিল- তাদের কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল, কারো কারো মনে প্রতিশোধের চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। ইসলামের সৌন্দর্য- রসুল (সা:) সাধারন ক্ষমা করে দিলেন নির্দিষ্ট কয়জনকে বাদে।

সাহাবীরা পুরান ও কষ্টকর স্মৃতি মনে, ক্ষতগুলো দেহে বহন করেও বিনা বাক্যব্যয়ে রসুল (সা:) এর নির্দেশ মেনে নিল। আর আম্মার (রা:) ছিল সবচেয়ে নির্যাতিতদের একজন। এই হল ইসলাম, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা দ্বীনের জন্য, ব্যক্তিস্বার্থে নয়।

আম্মার (রা:) এর বহু ফজিলতের বর্ননা রয়েছে

মালিক ইব্‌নু ইসমাঈল (রহঃ) ‘আলকামাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি সিরিয়ায় গমন করলাম। দু’ রাক‘আত সালাত আদায় করে দু‘আ করলাম, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে একজন নেককার সাথী মিলিয়ে দিন। অতঃপর আমি একটি জামা‘আতের নিকট এসে তাদের নিকট বসলাম। তখন একজন বৃদ্ধ লোক এসে আমার পাশেই বসলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তারা উত্তরে বললেন, ইনি আবূ দারদা (রাঃ)। আমি তখন তাঁকে বললাম, একজন নেক্কার সঙ্গীর জন্য আমি আল্লাহর নিকট দু’আ করেছিলাম। আল্লাহ আপনাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি কোথাকার অধিবাসী? আমি বললাম, আমি কুফার অধিবাসী। তিনি বললেন, (নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) জুতা, বালিশ এবং উযূর পাত্র বহনকারী সর্বক্ষণের সহচর ইবনু উম্মু ‘আবদ (রাঃ) কি তোমাদের ওখানে নেই? তোমাদের মাঝে কি ঐ ব্যক্তি নেই যাকে আল্লাহ শয়তান হতে নিরাপত্তা দান করেছেন? [অর্থাৎ আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাঃ)] তোমাদের মধ্যে কি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোপন তথ্যবিদ লোকটি নেই? যিনি ছাড়া অন্য কেউ এসব রহস্য জানেন না। অর্থাৎ হুযাইফাহ (রাঃ) অতঃপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) সূরাوَاللَّيْلِ কিভাবে পাঠ করতেন? তখন আমি তাকে সূরাটি পড়ে শুনালামঃ وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشٰى وَالنَّهَارِ إِذَا تَجَلّٰى وَالذَّكَرِ وَالأُنْثٰى তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সূরাটি সরাসরি এভাবেই শিক্ষা দিয়েছিলেন।* (৩২৮৭) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪৫৯, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৪৬৭)

ফুটনোটঃ

  • প্রচলিত কিরাআতে وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالأُنْثٰى এভাবে বর্ণিত আছে। কিন্তু’ ‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ দারদা -এর কিরাআতে وَمَا خَلَقَ শব্দটি নেই।

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৭৪২
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

আলী বিন আবু তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বসা ছিলাম। আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) প্রবেশানুমতি চাইলেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তাকে অনুমতি দাও। এই পাক ও পবিত্র ব্যক্তিকে স্বাগতম।

ফুটনোটঃ
[১৪৪] তিরমিযী ৩৭৯৮, আহমাদ ৭৮১। তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ। তাখরীজ আলবানী: মিশকাত ৬২২৬, সহীহা ২/৪৬৬।

সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৪৬
হাদিসের মান: সহিহ

আলী (রাঃ) এর খেলাফতের সময়কাল

একদিকে মুখোমুখি আলী (রাঃ) অন্যদিকে তালহা (রা:), যুবায়ের (রা:) ও রসুলের (সা:) এর স্ত্রী উম্মতের মা আয়েশা (রা:)। আম্মার (রা:) আলী (রা:) এর পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন –

عَبْدُ اللهِ بْنُ مُحَمَّدٍ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ آدَمَ حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ عَيَّاشٍ حَدَّثَنَا أَبُو حَصِينٍ حَدَّثَنَا أَبُو مَرْيَمَ عَبْدُ اللهِ بْنُ زِيَادٍ الأَسَدِيُّ قَالَ لَمَّا سَارَ طَلْحَةُ وَالزُّبَيْرُ وَعَائِشَةُ إِلَى الْبَصْرَةِ بَعَثَ عَلِيٌّ عَمَّارَ بْنَ يَاسِرٍ وَحَسَنَ بْنَ عَلِيٍّ فَقَدِمَا عَلَيْنَا الْكُوفَةَ فَصَعِدَا الْمِنْبَرَ فَكَانَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ فَوْقَ الْمِنْبَرِ فِي أَعْلاَهُ وَقَامَ عَمَّارٌ أَسْفَلَ مِنْ الْحَسَنِ فَاجْتَمَعْنَا إِلَيْهِ فَسَمِعْتُ عَمَّارًا يَقُولُ إِنَّ عَائِشَةَ قَدْ سَارَتْ إِلَى الْبَصْرَةِ وَ وَاللهِ إِنَّهَا لَزَوْجَةُ نَبِيِّكُمْ صلى الله عليه وسلم فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَلَكِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى ابْتَلاَكُمْ لِيَعْلَمَ إِيَّاهُ تُطِيعُونَ أَمْ هِيَ.

আবূ মারইয়াম ‘আবদুল্লাহ্‌ ইব্‌নু যিয়াদ আসাদী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, ত্বলহা, যুবায়র ও ‘আয়িশাহ (রাঃ) যখন বসরার দিকে গেলেন, তখন ‘আলী (রাঃ) আম্মার ইব্‌নু ইয়াসির ও হাসান ইব্‌নু ‘আলী (রাঃ) – কে পাঠালেন। তাঁরা আমাদের কুফায় আসলেন এবং (মাসজিদের) মিম্বরে উপবেশন করলেন। হাসান ইব্‌নু ‘আলী (রাঃ) মিম্বারের সর্বোচ্চ ধাপে উপবিষ্ট ছিলেন, আর আম্মার (রাঃ) হাসান (রাঃ)-এর নিচের ধাপে দন্ডায়মান ছিলেন। আমরা এসে তাঁর নিকট জড় হলাম। এ সময় আমি শোনলাম, আম্মার (রাঃ) বলেছেন, ‘আয়িশাহ (রাঃ) বস্‌রার দিকে রওনা হয়ে গেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের (আমাদের) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পত্নী। কিন্তু আল্লাহ্‌ এ কথা স্পষ্ট করে জেনে নেয়ার জন্য তোমাদের পরীক্ষায় ফেলেছেন যে, তোমরা কি তাঁরই আনুগত্য কর, না তাঁর (অর্থাৎ ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর) আনুগত্য কর। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬১৯)

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৭১০০
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

তখন তার বয়স ৯০ এর অধিক। এরপর সিফফিনের যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আলী (রা) হক্বের পথে আছে তখন তা অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়।

حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى، أَخْبَرَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ، حَدَّثَنَا خَالِدٌ، عَنْ عِكْرِمَةَ، أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ، قَالَ لَهُ وَلِعَلِيِّ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ ائْتِيَا أَبَا سَعِيدٍ فَاسْمَعَا مِنْ حَدِيثِهِ‏.‏ فَأَتَيْنَاهُ وَهُوَ وَأَخُوهُ فِي حَائِطٍ لَهُمَا يَسْقِيَانِهِ، فَلَمَّا رَآنَا جَاءَ فَاحْتَبَى وَجَلَسَ فَقَالَ كُنَّا نَنْقُلُ لَبِنَ الْمَسْجِدِ لَبِنَةً لَبِنَةً، وَكَانَ عَمَّارٌ يَنْقُلُ لَبِنَتَيْنِ لَبِنَتَيْنِ، فَمَرَّ بِهِ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَمَسَحَ عَنْ رَأْسِهِ الْغُبَارَ وَقَالَ ‏ “‏ وَيْحَ عَمَّارٍ، تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ، عَمَّارٌ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللَّهِ وَيَدْعُونَهُ إِلَى النَّارِ ‏”‏‏.‏

‘ইকরিমা (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) তাকে ও ‘আলী ইব্‌নু ‘আবদুল্লাহ্‌কে বলেছিলেন যে, তোমরা আবূ সা‘ঈদ (রাঃ)-এর নিকট যাও এবং তার কিছু বর্ণনা শোন। অতঃপর আমরা তার নিকট গেলাম। সে সময় তিনি ও তার ভাই বাগানে পানি সেচের কাজে ছিলেন। আমাদের দেখে তিনি আসলেন এবং দু’ হাঁটু বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বসে বললেন, মসজিদে নববীর জন্য আমরা এক একটি করে ইট বহন করছিলাম। আর ‘আম্মার (রাঃ) দু’ দু’টি করে বহন করছিল। সে সময় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার পাশ দিয়ে গেলেন এবং তার মাথা থেকে ধূলাবালি মুছলেন এবং বললেন, আম্মারের জন্য বড় দুঃখ হয়, বিদ্রোহী দল তাকে হত্যা করবে। সে (‘আম্মার রাঃ) তাদেরকে আল্লাহ্‌র দিকে ডাকবে এবং তারা আম্মারকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে।

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৮১২
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

ইয়াসির (রা:) এর পরিবার, যারা হক্বের পথে অটল থাকার জন্য শহীদ হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে এরূপ শহীদী পরিবারের নজির খুব কমই আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *