সমৃদ্ধির নামে মুসলিম নারীদের অধঃপতন

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে হিজরী চৌদ্দ শতাব্দির মাঝামাঝি পর্যন্ত মুসলিম নারীরা পূর্ণ পর্দা করত। চেহারাও ঢেকে রাখত। শারীরিক কোনো সৌন্দর্য প্রদর্শন করে পথে-ঘাটে বেরুতো না। হিজরী চৌদ্দ শতাব্দির শেষভাগে ইসলামী অনেক আইনী শাসন ধারা সমাপ্তির পরপরই মুসলিম সমাজে ইসলামী রীতি-নীতিতে বিকৃতি সাধণে পশ্চিমা উপনিবেশই প্রথমত প্রধান ভূমিকা রাখে।

এক্ষেত্রে মিসরের নারীরাই সর্বাগ্রে চেহারা থেকে পর্দা খুলে ফেলে। মিসরের বাদশাহ মুহাম্মাদ আলী পাশা উচ্চ শিক্ষার জন্য মুসলিম শিক্ষার্থীদেরকে ফ্রান্সে পাঠাতে থাকে। সেসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক শিক্ষার্থীর নাম ছিল রেফায়া তাহতাবী। সে শিক্ষাগ্রহণ শেষে মিসরে ফিরে আসার পর নারীদের চেহারা থেকে পর্দা খুলে ফেলার জন্য আন্দোলন শুরু করল। রেফায়া তাহতাবীর পর মারকাস ফাহমী নামী এক খৃষ্টান লেখক এই আন্দোলন অব্যহত রাখল। সে – المرأة في الشرق নামক একটি বই লিখল। যে বইটিতে সে নারীদেরকে পর্দা থেকে বেরিয়ে আসা ও পুরুষ-নারীর অবাধ বিচরণের প্রতি ব্যাপক উৎসাহ যোগাল।

মিসরের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আহমদ লুতফী সাইয়্যেদই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে মিসরীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষার আবির্ভাব ঘটায়। আহমদ লুতফী সাইয়্যেদের পর জ্বহা হুসাইন এবং কাসেম আমিন নামক ব্যক্তিদ্বয় এই আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করে।

কাসেম আমিন তো এ ব্যাপারে নারীর মুক্তি এবং আধুনিক নারী নামক দুটি বইও লিখে ফেলে। কাসেম আমিনের বই দুটি পড়ে সা’দ যাগলুল এবং আহদম যাগলুল অত্যন্ত প্রভাবিত হলো। তারা দুজনও পর্দাহীনতার এ আন্দোলনকে সফল করতে ওঠে পড়ে লাগল।

পরে কায়রোতে হুদা শা’রাবীর নেতৃত্বে নারী-স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। যে আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুসলিম নারীদের চেহারা থেকে পর্দা হটানো। নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সমাবেশ ১৯২০ সালে মিসরের মুরকাসায় অনুষ্ঠিত হয়।

হুদা শা’রাবীই ছিল মিসরের সর্বপ্রথম নারী; যে কিনা পর্দাশীলা মুসলিম নারীদের শরীর থেকে পর্দা ছিনিয়ে নেয়ার দুঃসাহস করেছিল। অবশেষে সাদ যাগলুল বৃটেন থেকে ফিরে আসার দিন ঘনিয়ে এলো। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিমান বন্দরে দুটি বড় তাবু স্থাপন করা হলো । একটিতে ছিল পুরুষ অপরটিতে নারী। সাদ যাগলুল বিমান থেকে নেমে সোজা নারীদের তাবুর দিকে চলল। যে তাবু পর্দাবৃতা বহু নারীর উপস্থিতিতে ভরপুর ছিল। সে তাবুতে প্রবেশ করা মাত্রই হুদা শা’রাবী তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করে নিল। হুদা নিজেও তখন আপাদমস্তক পর্দাবৃতা ছিল।

সাদ যাগলুল এক ঝটকায় হুদার চেহারা থেকে পর্দা খুলে ফেলল। পুরো তাবু তখন করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠল। সাথেসাথে তাবুতে উপস্থিত বাকী সব নারীরাও তাদের চেহারা থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলল। আর এভাবেই পর্দাহীনতার আনুষ্ঠানিক সূচনার পূর্ব পরিকল্পিত নাটক মঞ্চায়িত হলো।

পরে কায়রোতে নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনের আরেকটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যে সমাবেশে সাদ যাগলুলের স্ত্রী সফিয়া ফাহমীও উপস্থিত ছিল। সে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজারো মানুষের সামনে নিজের পরিধেয় বোরকাটি খুলে পায়ের নিচে মাড়িয়ে ফেলল। সমাবেশে উপস্থিত বাকী নারীরাও তার অনুসরণ করল। তারপর মাটিতে পড়ে থাকা সেই বোরকাগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হলো।

১৯৯০ সালে পর্দাহীনতা নামী একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হলো। যেটির উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তুতে ছিল নামের যথার্থতার বিচ্ছুরণ। ম্যাগাজিনের প্রতিটি পাতা ছিল নারী-পুরুষের সমান অধিকারের দাবিতে সোচ্চার।

আর সে অধিকার আদায়ে ম্যাগাজিনের লেখক সম্প্রদায় মুসলিম নারীর পর্দাকে অনাবশ্যক আবরণ আখ্যা দিয়ে শরীর থেকে তা ছুড়ে ফেলে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার প্রতি উৎসাহ যোগাচ্ছিল। ম্যাগাজিনটির বিশেষ কিছু পাতা অভিনেতা-অভিনেত্রী ও মুক্তমনা নারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল।

ধীরে ধীরে পথে ঘাটে পর্দাহীন মুসলিম নারীর নির্লজ্জ চলাফেরা মামুলি বিষয় হয়ে গেল। যে মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে পথে-প্রান্তরে মুসলিম নারীর বেপর্দা চলাফেরার নজির মেলা দুষ্কর ছিল, সেখানে নারী-স্বাধীনতার নামে পর্দাহীনতার কু-প্রথা ব্যাপকতা লাভ করল।

এরপর নারী-স্বাধীনতা আন্দোলন নামের সংগঠনটি তাদের পরবর্তী এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হলো। নারীকে পর্দাহীন করার জন্য শয়তানের পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদী। একটু খেয়াল করুন- এর সূচনা করা হয় পশ্চিমা শিক্ষিতদের দ্বারা লিখিত বই, উপন্যাস এরপর বিভিন্ন সাজানো নাটক, প্রোগাম, সংগঠনের কার্যক্রমের নাম দিয়ে।

আস্তে আস্তে দেশের শিক্ষা, উন্নতি, প্রগতি, সম্প্রীতির জন্য পর্দাকে বাধা হিসেবে প্রচার করা হয়। অথচ সমৃদ্ধির পথে সবচেয়ে বড় ব্যাধি দুর্নীতিকে আড়াল করা হয়। এজন্যই ক্ষমতাসীনরা নারী অধিকার সংগঠন নামক ফেতনা ছড়ানো সংগঠনগুলোকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে যেন জনগণের দৃষ্টি ভিন্নদিকে ফেরানো যায়।

তাই যখনই ধর্মপ্রিয় মুসলিম ও প্রগতিশীল নামক ফেতনাবাজদের দ্বন্দ্ব হয় তখনই ক্ষমতাসীনগণ মীমাংসাকারীর ভূমিকায় অর্বতীন হয়। ফলে দুর্নীতি, লুটপাট ক্ষমতাসীনদের বাদ দিয়ে জনগণ এসব ফেতনাবাজ সংগঠনকেই মূল শত্রু ভাবতে শুরু করে। এভাবেই দীর্ঘদিন তারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সম্ভব হয়।

ইতিহাস খেয়াল করুন- পর্দাহীন হয়ে মিশর কি উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে? বরং দুর্নীতি, গৃহযুদ্ধ দারিদ্র্যতায় বিধ্বস্ত মিশর। এমনকি মিশরের বেশিরভাগ গম বা খাদ্য আসতো রাশিয়া হতে। আবরোধের কারণে তাও বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে খাদ্যসংকটে পড়ছে মিশর। অথচ আরব দেশসহ বহু মুসলিম অধ্যুষিত দেশ সমৃদ্ধির জন্য পর্দাহীনতা, সিনেমা ও গান এমনকি নাইটক্লাব ও বীচ তৈরিতে ব্যস্ত। আসুন দেখি এসব কি তাদের সমৃদ্ধি দিবে নাকি ধ্বংস করবে –

● মাছজুর ইবনে গাইলান আব্দুল্লাহ ইবনে সামিত রাঃ. সূত্রে বর্ণনা করেন, আমি আমার আব্বাজান আব্দুল্লাহর সঙ্গে মসজিদ থেকে বের হলাম। সে সময় আব্দুল্লাহ রাঃ. বলেন, মিশর ও বসরা সবার আগে ধ্বংস হবে। আমি বললাম, কী কারণে তাদের ধ্বংস নেমে আসবে? ওখানে তো অনেক বড় সম্মানিত ও বিত্তবান ব্যক্তিরা আছেন। তিনি উত্তরে বললেন, রক্তপাত, গণহত্যা ও অত্যাধিক দূর্ভিক্ষের কারণে। আর মিশরের সমস্যা হলো, নীলনদ শুকিয়ে যাবে। আর এটিই মিশর ধ্বংসের কারণ হবে। (আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান)

● সাহাবী কা’ব রাঃ. বলেন, আর্মেনিয়া ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত জাযীরাতুল আরব (আরব উপদ্বীপ) নিরাপদ থাকবে, জাযিরাতুল আরব ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত মিশর নিরাপদ থাকবে, মিশর ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত কুফা শহর নিরাপদ থাকবে, কুফা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে না, কাফেরদের শহর (রোম/ভ্যাটিকান সিটি) বিজিত না হওয়া পর্যন্ত দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে না। (মুসতাদরাক হাকিম- ৪/৫০৯)।

আল্লাহ বলেন-

“যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।”

সুরা নূর -১৯

শয়তান চায় অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক মুসলিমদের মাঝে তাহলে তারা ধ্বংস হবে। মুসলিমরা যখনই ইসলাম ছাড়বে ধ্বংস হবে আবার খলিফা মাহাদী ও ঈসা ইবনে মরিয়মের সময় ইসলামী শাসন আসলেই মুসলিমরা সমৃদ্ধি লাভ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *