অনেক আন্দোলনের যৌক্তিক দিক থাকে, সাময়িক সফলতা আসে, যাকে আমরা বিজয় বা স্বাধীনতা ঘোষণা করি। কিন্তু জালেম পতন হলেও আমরা যে শান্তির স্বপ্ন দেখি তা কি ফিরে আসে!? কারন রাষ্ট্রনীতি জুলুমে ভরপুর, নেতা বদলালেও নীতি প্রায় একই থাকে। জুলুমের প্রকৃত অর্থ আমরা বুঝিনি। আমাদের কাছে জুলুম হলো শুধু হত্যা, দুর্নীতি।
অথচ মহাবিশ্বের বড় জুলুম শির্ক বা ইসলামের বিপরীত এমন জাহেলী নিয়ম/আইন যা মানুষ স্বেচ্ছায় মেনে চলে বা বাধ্য করা হয় মানতে। আর যারা আইনগুলো চাপিয়ে দেয় বা মানতে বাধ্য করে তারাই হলো সবচেয়ে বড় জালেম। যেমন: ফেরাউন, নমরুদসহ জালেম শাসকরা যারা স্বরচিত, স্বঘোষিত বিধান চালু করে।
বুখারি (রহ.) তাঁর ‘সহিহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যখন নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়—‘যারা ঈমান আনে এবং তাদের ঈমানের সঙ্গে কোনো জুলুম মিশ্রিত করে না…।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৮২)
তখন সাহাবিদের কাছে বিষয়টা খুব কঠিন মনে হলো। তারা বলতে লাগলেন, আমরা সবাই তো কোনো না কোনো জুলুম তথা গুনাহ করে ফেলি। একেবারে জুলুমমুক্ত আমাদের মধ্যে কে আছে? রাসুল (সা.) তাদের এ কথা শুনে বলেন, তোমরা ব্যাপারটাকে যেমন ভেবেছ বিষয়টা তেমন নয়।
তোমরা কি দেখো না যে লুকমান তার ছেলেকে কী নসিহত করেছেন! তিনি বলেছেন, ‘হে প্রিয় বৎস, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করবে না। মনে রেখো, শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৩)
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে শরিক করে। এ ছাড়া অন্য পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করল, সে অত্যন্ত গুরুতর অপবাদ আরোপ করল।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৮)
পাকিস্তান হতে বর্তমান তথাকথিত স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট একই – কোটা নয় যোগ্যতা, নায্য অধিকার, ৬ দফাসহ বিভিন্ন দাবিতে যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান হতে মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার অবদানের নামে ক্ষমতা কিছু নির্দিষ্ট দল বা লোকের নিকট হাতবদল হলো। তারা ইসলাম বাদ দিয়ে মনমতো আইন তৈরি করলো, নিজেরাই এবার জালেম হয়ে উঠলো।
আহ – যদি বিজয়ের পরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা হতো ও প্রকৃত কুরআন বিশারদদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হতো। বরং ৭১ পরবর্তীতে ক্ষমতার ক্ষেত্রে যোগ্যতা বা কুরআন-সুন্নাহকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং নির্দিষ্ট দল, বংশ পরিচয়, যারা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে ওদের হতে নির্দিষ্ট কিছু লোককে ক্ষমতা, পদ-পদবি দিল ও বিভিন্ন উপাধি দিল।
তাদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা, শহীদ মিনার, ভাস্কর্য গড়লো ও উৎসবের নামে শির্ক চালু করলো। অথচ অনেক মুক্তিযুদ্ধার পরিবার অনাহার, অর্ধাহারে জীবনযাপন করেছিল। এমনকি রাষ্ট্র মুসলিমদের উপযুক্ত যাকাতের অধিকারটুকু দেয় নি।
আজও আমরা সেই পথে যেন হাটছি। কোটা নয় মেধা দাবি করা লোকগুলো নব স্বাধীনতার চেতনার নামে তাদের নির্দিষ্ট পছনন্দীয় লোকগুলোকে ক্ষমতা দিতে চাইছে, দিচ্ছে। যদিও তাদের জীবনযাপন, রাষ্ট্র পরিচালনা কুরআন, সুন্নাহর বিপরীত নয় কি!? তারাও ভাস্কর্য গড়বে, সড়কের নাম দিবে, মানবরচিত বিধান দ্বারা রাষ্ট্র চালাবে।
আবার যখন জালেম হয়ে উঠবে, তখন আবার একদল লোক প্রতিবাদী হবে স্বাধীনতার নামে।
খেলাফায়ে রাশেদীনের পর হতে বহু তন্ত্র, মন্ত্র, চেতনার উদ্ভব হয়েছে শান্তি কি এসেছে? জালেমমুক্ত সমাজ কি হয়েছে? শান্তি, দেশপ্রেমের নামে ভূখন্ডপূজায় নিরীহ মুসলিম শিশু, বৃদ্ধ, যুবক মেরে চলেছে বিশ্ব জালেমরা। আর মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে শাসকরা জুলুম চালাচ্ছে যারা প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায় না!
দুর্নীতি, ধর্ষন, চুরি, ডাকাতি, পরকীয়া নিত্যদিনের ঘটনা। কোন ঘটনা ঘটার পর সাময়িক আন্দোলন হয় এরপর আরেকটা ঘটনা এসে তার স্থান দখল করে নেয়। বিচার ব্যবস্থার দেরির কারণে অনেক অপরাধী ঘটনার আড়ালে চলে যায়। আমরা আন্দোলন করি, যে যার মত বিচার চাই। আজ দেখেন বিচারব্যবস্থা কিছু তরুন, তরুনী না জানার কারনে নিজ মনমতো বিচার করে চলছে। কাউকে কান ধরাচ্ছে, কাউকে গান গাওয়াচ্ছে।
ভাই, কে বিধানদাতা আপনি না আল্লাহ? কে মহাজ্ঞানী মানুষ না আল্লাহ? প্রতিদিনই সালাতে পড়ছেন- সকল প্রশংসা বিশ্বপ্রতিপালকের (সার্বভৌমত্ব আল্লাহর), যিনি বিচার দিবসের মালিক (সুরা ফাতেহা)। আপনি কার আইনে বিচার চাইবেন – মানবরচিত আইনে? হাজার বছর ধরে মানবরচিত আইন কি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? একই বিচারে যদি আপনার মা বাবা বা স্বজন অপরাধী হতো করতে পারতেন? ইসলামী বিচার সবার জন্য সমান।
সাঈদ ইবনু সুলায়মান (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। মাখযুমী সম্প্রদায়ের জনৈকা মহিলার ব্যাপারে কুরাইশ বংশের লোকদের খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল যে কিনা চুরি করেছিল। সাহাবাগণ বললেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে কে কথা বলতে পারবে? আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় পাত্র উসামা (রাঃ) ছাড়া কেউ এ সাহস পাবে না।
তখন উসামা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে কথা বললেন। এতে তিনি বললেনঃ তুমি আল্লাহ তা’আলার দেওয়া শাস্তির বিধানের ক্ষেত্রে সুপারিশ করছ? এরপর তিনি দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করলেন এবং বললেনঃ হে মানব মণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের লোকেরা পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে। কেননা কোন সম্মানিত লোক যখন চুরি করত তখন তারা তাকে রেহাই দিয়ে দিত। আর যখন কোন দুর্বল লোক চুরি করত তখন তার উপর শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ এর কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে তবে অবশ্যই মুহাম্মাদ তাঁর হাত কেটে দেবে। (সহীহ বুখারী -৬৩৩১)
আল্লাহ বলেন-
“আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন- যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন। অনন্তর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে নিন, আল্লাহ তাদেরকে তাদের গোনাহের কিছু শাস্তি দিতেই চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে অনেকেই নাফরমান। তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?” (সুরা মায়েদাহ, ৪৯-৫০)।
তাই আল্লাহর আইনের বিপরীত জাহেলদের বিধান হতে বিরত থাকুন।
এটা ভাবা ভুল হবে – আমরা শুধু বর্তমান শাসক বা সমাজ ব্যবস্থা, নীতিরীতির বিরোধী বরং ইসলামের বিপরীত প্রতিটি নিয়মনীতির বিপক্ষে আমরা স্বোচ্ছার, আর যতদিন ইসলাম প্রতিষ্ঠা না হবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো, যদিও সবাই আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।