মানুষ সাধারণত দুভাবে শয়তানের পূজা করে। প্রথমত তার কাছে সাহায্য চেয়ে, শয়তানের আনুগত্য মেনে নিয়ে ও দ্বিতীয়টি হল – আল্লাহর বদলে শয়তানের মতাদর্শ মেনে নিয়ে। আল্লাহ বলেন,
اِنۡ یَّدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِهٖۤ اِلَّاۤ اِنٰثًا ۚ وَ اِنۡ یَّدۡعُوۡنَ اِلَّا شَیۡطٰنًا مَّرِیۡدًاসূরা নিসঃ ১১৭
“তারাতো আল্লাহকে ব্যতীত শুধু নারীদের আহ্বান করে, আসলে তারা কেবল অবাধ্য শয়তানকেই আহ্বান করে।’’
‘ইনাসান’ বলে লাত, উয্যা, মানাত ও অন্যান্য নারী নামের সকল দেবীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এগুলোকে ‘ইনাস’ বলার পিছনে মোট তিনটি কারণ থাকতে পারে :
১. ‘ইনাসান’ শব্দটি ‘উন্সা’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ নারী। লাত, উয্যা ও মানাত এ তিনটিকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণে এদেরকে ‘ইনাসান’ বলা হয়ে থাকতে পারে। মূলত কোনো নারীদের সাথে এদের ঐতিহাসিক কোনো সম্পর্ক থাকার কারণে নয়।
২. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মতে ‘ইনাস’ অর্থ ‘আওছান’ তথা প্রতিমাসমূহ। ‘আওছান’ শব্দটি ‘ওয়াসান’ শব্দের বহুবচন। আরবীতে বহুবচন জাতীয় শব্দগুলো স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। যেহেতু মুশরিকরা একাধিক ‘ওয়াছান’ তথা প্রতিমাকে আহ্বান করতো, সে জন্য এগুলোকে ‘ইনাছান’ বলা হয়েছে।
৩. মুশরিকরা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করে এদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য এদের উপাসনা করতো।
তারা এগুলোর নারী আকৃতির মূর্তি তৈরী করে এদের পূজা-অর্চনার জন্য কিছু নিয়ম নীতি তৈরী করেছিল, এদের গলায় অলংকার ঝুলিয়ে দিয়ে বলেছিল: এরা আল্লাহর মেয়ে যাদের আমরা উপাসনা করি।
বিশিষ্ট তাবেঈ দাহহাক (রহ.) থেকে এ ব্যাখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে। ‘তারা এ সব মূর্তিকে আহ্বান করে মূলত অবাধ্য শয়তানকেই সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো’ উক্ত আয়াতে এ কথা বলার কারণ হলো: শয়তানই মূলত তাদেরকে এ সবের আহ্বান করতে প্ররোচিত করতো। উবাই ইবনে কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনা মতে এ সব মূর্তির সাথে একটি করে মহিলা জিন থাকতো।
যেমন সীরাত গ্রন্থ ইবনে হিশাম ও আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া হতে জানা যায়-
● “হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন- উয্যা একটি শয়তান রমণী, সে বতনে নাখলার কিকর নামক তিনটি গাছের নিকট আসিত।
মক্কা বিজয়ের পর হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালেদ ইবনে ওয়ালীদকে বলিলেন—তুমি বতনে নাখলায় যাও। সেখানে তুমি কিকরের তিনটি গাছ দেখবে। প্রথম গাছটি মূল সহ কেটে ফেলবে। হযরত খালেদ (রাঃ) নির্দেশমত প্রথম গাছটি কেটে ফিরে আসলে নবীজী জিজ্ঞাসা করিলেন—কিছু দেখছো?
হযরত খালেদ (রাঃ) বললেন –জ্বি না। নবীজী(সাঃ) বলিলেন——যাও দ্বিতীয় গাছটিও কাট।
হযরত খালেদ দ্বিতীয় গাছটি কাটিয়া আসিলে নবীজী জিজ্ঞাসা করিলেন—কিছু দেখছো?
হযরত খালেদ বলিলেন–জ্বি না।
আবার তৃতীয় গাছটি কাটিতে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি গিয়া দেখেন—এলো চুলে দুই হাত কাঁধের উপর রাখিয়া এক রমণী দাঁত কড়মড় করিতেছে এবং তাহার পিছনে দাঁড়ানো দানিয়া সালমী।
খালেদ সেই শয়তান রমণী এবং দানিয়া উভয়কেই হত্যা করে ফিরে আসেন এবং সকল কথা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলিলেন। রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করিলেন—এই রমণীই উয্যা ছিল। ভবিষ্যতে আরবের জন্য আর কখনও উয্যা আবির্ভাব হইবে না।”
মূর্তি ও তার আশেপাশে পূজা চললে সেখানে উয্যার মত জ্বিন অবস্থান করতো। আর উয্যার মত জিনরাই অদৃশ্যে থেকে তাদের আহ্বানকারীদের উপকার করে দিত। ফলে মুশরিকরা এ উপকারকে এ সব মূর্তির কাজ বলেই মনে করতো। এভাবে ধোকা দিয়ে তাদের মূর্তিপূজা ও শিরকের উপর বিশ্বাস অটল থাকতো।
আজও বিভিন্ন মন্দিরে ও ভন্ড পীরের মাজারে তারা এরূপ করে যেন শিরকের উপর মানুষের আস্থা অটল থাকে। যেমন – অনেক জ্বিন মন্দিরের খাদ্য খায় মানুষভাবে দেবতারা খাচ্ছে। আর মন্দির ও অনেক মাজারের শয়তান জ্বিনদের সাথে পুরোহিত ও মাজার কর্তৃপক্ষের চুক্তি বা সম্পর্ক থাকে। জ্বিনরা তাদের সাহায্য করবে আর তারা মানুষকে শিরকের পথে পরিচালিত করবে।
ধরুন- কোন ব্যক্তি জ্বিনঘটিত কারণে রোগ বা সমস্যার সম্মুখীন হল- তখন পুরোহিত বা ভন্ডপীরের মুরীদগণ পরামর্শ দিবে- দেবতার পূজা করতে বা মাজারে অর্থদান, পরিষ্কার করা বা মূর্দার কাছে গায়েবী সাহায্য চাওয়া বা এমন শিরকী কর্ম করতে যা ইসলামে জায়েজ নয়। যখন মানুষ তা করে জ্বিনরা রোগীর কাছ হতে চলে যায়। ফলে রোগী সুস্থ হয় তখন তার বিশ্বাস হয় এসব দেবতা বা মাজারের বদৌলতে হয়েছে এবং ওদের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। অথচ এসব প্রতারনা – এই জ্বিনরা চাইলে আবার ফিরে আসতে পারে। কুরআন দ্বারা চিৎকিসা করলে চিরতরে ক্ষতিমুক্ত হয়।
এছাড়া তথাকথিত পীর বা পুরোহিতদের সিজদাহ্ দেয় – আসলে ওরা মূলত শয়তান পূজারী। পূর্বে বলা হয়েছে – আমাদের প্রত্যেকের কাছে ক্বারিন জ্বিন আছে, যখন কোন ব্যক্তি কাউকে/মূর্তি/ভন্ড পীরের মাজারে সিজদাহ্ দেয় – ক্বারিন ও মূর্তি, মাজারের জিনগুলো খুশি হয় তাকে সিজদাহ্ দেওয়া হচ্ছে বলে।
যুগ যুগ ধরে সবচেয়ে বেশি পূজা করা হচ্ছে সূর্য দেবতার বা সূর্য পূজার। এর কারণ হল-
● রাসূল (সা) বলেন, “ফজরের ছালাত পড়বে, অতঃপর সূর্যোদয়কালে ছালাত আদায় করবে না, যতক্ষণ না তা কিছুটা উপরে উঠে। কেননা, যখন তা উদিত হয়, তখন শয়তানের দুই শিং-এর মধ্য দিয়ে উদিত হয় এবং এসময় কাফেররা তাকে সিজদা করে। …অতঃপর ছালাত থেকে বিরত থাকবে, যতক্ষণ না সূর্য ডুবে যায়। কেননা তা শয়তানের দুই শিং-এর মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় এবং এসময় কাফেররা তাকে সিজদা করে (বুখারী হা/৩২৭৩; মুসলিম হা/৮৩২; মিশকাত হা/১০৪২)।
কাফের-মুশরিকরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সূর্যের পূজা করে। এসময় শয়তান সূর্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সে চায় যে, কাফেররা যেন তারই পূজা করে। এসময় শয়তান এমনভাবে দাঁড়ায়, যেন সূর্য তার মাথার মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। সে কারণে হাদীছে বলা হয়েছে যে, ‘সূর্য শয়তানের দুই শিংয়ের মধ্য দিয়ে উদিত হয়’। এ সময় ছালাত আদায় করা নিষিদ্ধ হওয়ার এটাই মূল কারণ (ফাৎহুল বারী ২/৬০)। হাদীছে শয়তানের শিং বলতে তার মাথার উভয় পার্শ্বকে বুঝানো হয়েছে (নববী, শরহ মুসলিম ৬/১১২)।
এছাড়া যিশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ ও হিন্দুদের দেবতাদের মূর্তির ক্ষেত্রে দেখবেন – তার পিছ হতে সূর্য উঠছে। এটা সূর্য উঠার সময় শয়তানের অঙ্গভঙ্গি। খ্রিস্টানদের শয়তান জ্বিন প্রতারিত করে এভাবে- কোন গৃহে বা কারো উপর জ্বিনের উপদ্রব হলে পোপ বা পাদ্রীরা বলবে ক্রুশ ঝুলাতে ফলে জ্বিনেরা চলে যায়। আর এর বিনিময়ে পোপ, পাদ্রীরা পায় অর্থ খ্যাতি আর মানুষের ঈমান হয় – ক্রুশ ধর্মই সত্যি।
অনেক সময় এসব পীর-বাবা, পাদ্রী, পুরোহিতরা ছোট জ্বিনদের তাড়াতে অপেক্ষাকৃত বড় জ্বিনদের কাছে সাহায্য চায়। কুরআনে মুসলিম জ্বিনের বক্তব্য তাই প্রমান করে-
وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْإِنْسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا
সূরা জিনঃ ০৬
“আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছে।”
কুফর করা ছাড়া শয়তান জ্বিনরা সাহায্য করে না। এসব তারা সুলায়মানি বিদ্যার নামে করলেও আসলে এসব কুফর। সুলাইমানের(আ) রাজত্বে শয়তানেরা যা আবৃত্তি করত, তারা তা অনুসরণ করত। অথচ সুলাইমান (আ) কুফরী (সত্যপ্রত্যাখ্যান) করেননি বরং শয়তানেরাই কুফরী (অবিশ্বাস) করেছিল। (সুরা বাকারাহ-১০২)।
হা ভালো জ্বিন সেচ্ছায় সাহায্য করতে পারে কিন্তু জ্বিনদের কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত নয়। কোন সাহাবী চাননি কারণ জ্বিন ভালো না মন্দ কিভাবে বুঝবেন। এজন্য সাহাবী জিন থাকা স্বত্বেও সাহাবী ও তাবেয়ীরা তাদের হতে হাদীস নেননি, দুই একটি হাদীসের কথা যা শোনা যায় কিছু আলেমের মত শুধু।
সুলেমান (আঃ) কে আল্লাহ জ্বিনদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা দেওয়াসত্বেও তিনি হুদহুদ পাখিকে বার্তাবাহক করেন, জ্বিনকে নয়। অথচ জ্বিনরা আরো দ্রুতগতি সম্পন্ন ও মানুষের পরে তারা বুদ্ধিসম্পন্ন। কারণ জ্বিনদের মধ্যে মিথ্যাচার ও মিথ্যাচারীদের প্রবণতা বেশি।
ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত পরবর্তী পর্বগুলোতে আলোচনা হবে জাদুকর, কুফর নিয়ে। আসলে শয়তান জানে – অনেক মানুষই সরাসরি তার পূজা করবে না তাই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ধোকা ও প্রতারণা করে তার পূজা করাচ্ছে।