প্রিয় রসুল (সাঃ) শুধু সন্তান/শিশুদের ভালোবাসতেন না বরং তাদের হৃদয়ের অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করতেন ও নিজ ভালোবাসার কথা সবার সামনে জানিয়ে দিতেন।
যেমন- রসুল (সাঃ) বলতেন- ফাতেমা (রাঃ) আমার খলিজার টুকরো। এছাড়া আলী (রাঃ) তার গৃহে প্রতিপালিত হন। তার প্রতি ও হাসান হোসেন (রাঃ) এর প্রতি তার ভালোবাসা হাদীস, সুন্নাহ, সীরাত দ্বারা প্রমানিত। এছাড়াও রসুল (সাঃ) শিশুদের প্রতি ভালোবাসার কিছু তুলনা দেওয়া হল-
■ যায়েদ বিন হারেসা
তখন রসুলের (সাঃ) কাছে ওহীর আগমন শুরু হয়নি যখন যায়েদ (রাঃ) রসুল (সাঃ)-এর ঘরে দাস হিসেবে আসেন। যায়েদ (রাঃ) এর বয়স তখন আট বছর। লুটের দল তাঁকে বিক্রির উদ্দেশ্যে ‘উকাজ’ মেলায় নিয়ে যায়, হাকীম ইবন হিযাম ইবন খুয়াইলিদ নামে এক কুরাইশ নেতা চার শো’ দিরহামে তাঁকে খরীদ করেন। তাঁর সাথে আরো কিছু দাস খরীদ করে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।
হাকীম ইবন হিযামের প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে তাঁর ফুফু খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ দেখা করতে আসেন। ফুফুকে তিনি বলেনঃ ফুফু উকাজ থেকে আমি বেশ কিছু দাস খরীদ করে এনেছি। এদের মধ্যে যেটা আপনার পছন্দ হয় বেছে নিন।
হযরত খাদীজা দাসগুলির চেহারা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার পর যায়িদ ইবন হারিসাকে চয়ন করলেন। কারণ, তিনি যায়িদের চেহারায় তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির ছাপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি তাঁকে সঙ্গে করে বাড়ীতে নিয়ে এলেন।
এ ঘটনার কিছু দিন পর মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহর (রাঃ) সাথে খাদীজা (রা) পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি স্বামীকে কিছু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করলেন। প্রিয় ক্রীতদাস যায়িদ ইবন হারিসা (রাঃ) অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর কোন জিনিস তিনি খুঁজে পেলেন না। এ ক্রীতদাসটিকেই তিনি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন।
এ সৌভাগ্যবান ক্রীতদাস বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) এর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হতে লাগলেন। তাঁর মহান সাহচর্য লাভ করে উত্তম চারিত্রিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেলেন। এ দিকে তাঁর স্নেহময়ী জননী পুত্র শোকে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।
তাঁর বড় দুঃখ ছিল, তাঁর ছেলেটি বেঁচে আছে না ডাকাতদের হাতে মারা পড়েছে, এ কথাটি তিনি জানতেন না। তাই তিনি খুব হতাশ হয়ে পড়তেন। তাঁর পিতা হারিসা সম্ভাব্য সব স্থানে তার হারানো ছেলের সন্ধান করতেন। একসময় সন্ধান পেলেন ও অর্থ সম্পদ নিয়ে রসুলের (সাঃ) কাছে উপস্থিত হলেন তার ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য।
তিনি রসুল (সাঃ) বললেন- ‘ওহে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। অসহায়ের সাহায্যকারী, ক্ষুধার্তকে অন্নদানকারী ও আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দানকারী।
আপনার কাছে আমাদের যে ছেলেটি আছে তার ব্যাপারে আমরা এসেছি। তার মুক্তিপণও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং আপনার ইচ্ছামত তার মুক্তিপণ নির্ধারণ করুন।’
মুহাম্মাদ সা. বললেনঃ ‘আপনারা কোন ছেলের কথা বলছেন?
– আপনার দাস যায়িদ ইবন হারিসা।
~ রসুল(সাঃ) বললেন, আমি তাকে আপনাদের সামনে ডাকছি। স্বেচ্ছায় সে নির্ধারণ করুক, আমার সাথে থাকবে, না আপনাদের সাথে যাবে। যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, মুক্তিপণ ছাড়া তাকে নিয়ে যাবেন। আর আমার সাথে থাকতে চাইলে আমার করার কিছুই নেই।
– তারা সায় দিয়ে বললঃ আপনি অত্যন্ত ন্যায় বিচারের কথা বলেছেন।
~ মুহাম্মাদ সা. যায়িদকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ এ দু’ব্যক্তি কারা?
বললঃ ইনি আমার পিতা হারিসা ইবন শুরাহবীল। আর উনি আমার চাচা কা’ব।
~ বললেনঃ ‘তুমি ইচ্ছা করলে তাঁদের সাথে যেতে পার, আর ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থেকে যেতে পার।’ কোন রকম ইতস্ততঃ না করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেনঃ ‘আমি আপনার সাথেই থাকবো।’
– তাঁর পিতা বললেনঃ ‘যায়িদ, তোমার সর্বনাশ হোক! পিতা-মাতাকে ছেড়ে তুমি দাসত্ব বেছে নিলে?’
_ তিনি বললেনঃ ‘এ ব্যক্তির মাঝে আমি এমন কিছু দেখেছি, যাতে আমি কখনও তাকে ছেড়ে যেতে পারিনে।’
যায়িদের এ সিদ্ধান্তের পর মুহাম্মাদ সা. তাঁর হাত ধরে কা’বার কাছে নিয়ে আসেন এবং হাজরে আসওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত কুরাইশদের লক্ষ্য করে ঘোষণা করেনঃ ‘ওহে কুরাইশ জনমণ্ডলী! তোমরা সাক্ষী থাক, আজ থেকে যায়িদ আমার ছেলে। সে হবে আমার এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী।’
এ ঘোষণায় যায়িদের বাবা-চাচা খুব খুশী হলেন। তাঁরা তাঁকে মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহর (সা) নিকট রেখে প্রশান্তচিত্তে দেশে ফিরে গেলেন। সেই দিন থেকে যায়িদ ইবন হারিসা হলেন যায়িদ ইবন মুহাম্মাদ। সবাই তাঁকে মুহাম্মাদের ছেলে হিসেবেই সম্বোধন করতো। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা সূরা আহযাবের- ‘তাদেরকে তাদের পিতার নামেই ডাক’- এ আয়াত নাযিল করে ধর্মপুত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করেন। অতঃপর আবার তিনি যায়িদ ইবন হারিসা নামে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে যায়েদ (রাঃ) ছিল রসুলের (সাঃ) আজীবন সঙ্গী ও উত্তম শহীদ।
আর আমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, আমরা রসুলের (সাঃ) গর্বিত উম্মত দাবিদার অথচ আমাদের ঘরের সবচেয়ে অবহেলিত, নিষ্পেষিত হল কাজের ছেলে বা মেয়ে নামে খ্যাত গৃহের সেবা যারা করে। এমনকি আমাদের শিশুর খেলনার চেয়েও যেন ওদের জীবনের মূল্য কম।।
■ আনাস (রাঃ)
রাসূল সা: যখন মদিনায় এলেন আনাস রা:-এর মা গুমাইসা বিনতে মিলহান ছেলেসহ উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘-হে আল্লাহর রাসূল! আনসারদের নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই আপনাকে কিছু না কিছু হাদিয়া দিয়েছেন। আমি তো কিছুই দিতে পারিনি, আমার আছে এই ছেলে, সে লিখতে জানে; আপনার খিদমতের জন্য একে কবুল করুন।’ রাসূলে করিম সা: আনন্দ প্রকাশ করে নিজ মোবারক হাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর নিজের কোমল আঙুল দিয়ে তার জুলফি স্পর্শ করলেন এবং তাকে পরিবারভুক্ত করলেন। সে দিন থেকে আনাস রা: রাসূল সা:-এর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাথে ছিলেন। (আনসাবুল আশরাফ : ১/৫০৬, পৃষ্ঠা-১০২২)।
আনাস রা: বর্ণনা করেন, রাসূল সা: সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের মানুষ ছিলেন এবং সবার চেয়ে প্রশস্তচিত্তের মানুষ ছিলেন।
তিনি আমাকে একদিন এক কাজে পাঠিয়েছিলেন, আমি বের হয়ে দেখি শিশুরা খেলছিল, আমিও তাদের সাথে খেলতে চলে গেলাম।
এরপর আমি অনুভব করলাম, একজন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং আমার কাপড় স্পর্শ করছেন, আমি তাকালাম তিনি মুচকি হাসলেন, বললেন ‘উনায়েস! তোমাকে যেখানে যেতে বলেছি সেখানে কি তুমি গিয়েছ? বললাম, জি আমি এখনই যাবো হে আল্লাহর রাসূল সা:।
আল্লাহর কসম, আমি ১০ বছর তার খেদমত করেছি এর মাঝে আমি কোনো কাজ করলে তিনি কখনো বলেননি, ‘কেন তা করেছ’ আর কোনো কাজ না করলে তিনি কখনো বলেননি।
আনাস (রাঃ) হয়ে উঠেন অন্যতম হাদিস বর্ননাকারী। যাদের শিক্ষক স্বয়ং রসুল (সাঃ)। যার নিকট তারা শিক্ষা পেয়েছে কিভাবে সবর, কোমলতার সহিত নসিহত করতে হয়। তারা উম্মাহর জন্য বড় শিক্ষক হবেন এটাই স্বাভাবিক।
এছাড়াও রাসূল (সা)-এর শিক্ষায় আমরা শিশু ও বাচ্চাদের উত্তম আচরণের পাঠ পাই। উত্তম আচরণ ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজকের শিশু আগামী দিনের কান্ডারি। তখন আনাস (রা)-এর ভাই উমাইর ছিল ছোট্ট একটা শিশু।
তাঁর একটা চড়ুই পাখি ছিল। সারাদিন সে পাখিটার সাথে খেলা করত। পাখির প্রতি তাঁর এই অসীম আগ্রহ রাসূল (সা;) খেয়াল করলেন। বাচ্চারা এমনই হয়। আজকালকার বাচ্চাদের মধ্যেও পাখির প্রতি এমন একটা ব্যাকুলতা দেখা যায়। একদিন রাসূল (সা) তাঁর কাছে গেলেন। সে মনমরা হয়ে বসে আছে। কারণ, তাঁর পাখিটা মারা গেছে। রাসূল (সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘উমাইর! তোমার ‘নুগাইর (চড়ুই পাখি) কোথায়?’
সুবহানাল্লাহ! রাসূল (সা)-এর হৃদয় কত বড়ো! শত শত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভিড়েও একটা শিশুর প্রিয় পাখির খবর রাখেন! পাখিটির মৃত্যুতে শিশুটি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লে রাসূল (সা) তাঁর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। তিনি আমাদের প্রিয় রসুল (সাঃ) যার উপর পুরো মানবজাতির সরল পথ প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব এসেছিল। প্রতিটি জেহাদে যিনি নিত্য সঙ্গী হারাতেন আর দুঃখ, বেদনা, ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা ও শত্রুদের ষড়যন্ত্র ছিল তার নিত্য সঙ্গী। এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, কষ্ট ও ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের অনুভূতিগুলো নজর রাখতেন।
তাদের ভালোবেসে মূল্যবান সময় দিতেন, তাদের অন্তরের অনুভূতিকে মূল্যবান মনে করতেন আর তাদেরকে ভালোবাসার কথা সুস্পষ্ট জানিয়ে দিতেন। আর সেসব শিশু সাহাবীরাও রসুলের (সাঃ) জন্য সবকিছু বিলিয়ে দিতে রাজী ছিলেন।
একটু ভাবুন – আপনি কি এমন গুরু দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত, কি এমন দুঃখ, কষ্ট, পেরেশানিতে আছেন শিশুদের সময় দেওয়া, তাদের অনুভূতি বুঝা, ভালোবাসা জানানো হতে দূরে থাকছেন!! অথচ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দ্বীন প্রতিষ্ঠা রসুল (সাঃ) কে শিশুদের অনুভূতি জানানো হতে বিরত রাখতে পারে নি!! আপনার সন্তানদের শুধু টিভি, গেমস, খেলনার উপর ছেড়ে না দিয়ে রসুলের (সাঃ) সুন্নাহ অনুযায়ী কোমলতার সহিত দ্বীন শেখান। ইনশাআল্লাহ দেখবেন আপনাদের শিশু হয়ে উঠবে ইসলাম বিজয়ের ভবিষ্যৎ সৈনিক আর জান্নাতে আপনাদের মর্যাদা বৃদ্ধিকারী।