রমাদ্বানে সিয়াম অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কিন্তু এক্ষেত্রে সঠিক জ্ঞান খুব কম মানুষেরই থাকে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে মাসয়ালা একটু জটিলই হয়ে থাকে।
সিয়ামের আভিধানিক অর্থ হলঃ বিরত রাখা, আবদ্ধ রাখা। পারিভাষিক অর্থ হলঃ নিয়তের সাথে সুবহে সাদেক (ফজরের ওয়াক্তের প্রথম) হতে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সব ধরনের রোযা ভঙ্গকারী—যেমন: পানাহার, জৈবিক ও শারিরীক–কোনো কিছু ভোগ করা থেকে বিরত থাকা।
রমযান মাসে সওম (রোযা) ফরয হওয়ার ব্যাপারে উম্মাতের এজমা (একমত) হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। আর রোযা হলো ইসলামের চতুর্থ রোকন (স্তম্ভ)।
আল্লাহ বলেনঃ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সওম (রোযা) ফরয করা হয়েছে যেমনভাবে তা তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল। আশা করা যায় যে, তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।”
সূরা আল বাকারা : ১৮৩
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন যে, ইসলামের ভিত্তি হল পাঁচটি; ঐ পাঁচটির একটি হল রমযানের সওম বা রোযা।
রযমানের ব্যাপক ফযিলত সম্পর্কে সহীহ হাদীসে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়; সওমকে আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য খাস করেছেন এবং তিনি স্বয়ং এর পুরস্কার দিবেন। রোযাদারের সওয়াব অসংখ্য গুণে বৃদ্ধি পায়। হাদীসে কুদ্সীতে এসেছে : আল্লাহ বলেন: “সওম (রোযা) একমাত্র আমারই জন্য রাখা হয় এবং আমিই তার বিনিময় (পুরস্কার) দিব।”
সওমের সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। রোযা পালন অবস্থায় রোযাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ, একটি ইফ্তারের সময়, আরেকটি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময় (রোযার কারণে)। সওম (রোযা) কিয়ামতের দিন বান্দাদের জন্য সুপারিশ করে বলবে:
“হে প্রতিপালক আল্লাহ! আমি তার (রোযাদারের) জন্য সুপারিশ করছি তুমি আমার সুপারিশ গ্রহণ কর। যেহেতু আমি তাকে দিনের বেলা পাহানার ও যৌন কামনা-বাসনা হতে বিরত রেখেছি।”
রমযান ইসলামের একটি রোকন বা স্তম্ভ, এ মাসেই কুরআন নাযিল হয়েছে। এ মাসের মধ্যেই হাজার মাসের চেয়েও উত্তম একটি রাত আছে। রমযানে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানদেরকে শিকলবন্দী করে ফেলা হয়। রযমান মাসের রোযা (সওম) অন্য দশ মাসের রোযার সমান। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় সিয়াম (রোযা) পালন করে তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। প্রত্যেক ইফতারের সময় আল্লাহ তা’আলা অনেক জাহান্নামবাসীকে আগুন থেকে মুক্তি দান করেন।
সাত বছরের বালক-বালিকাদেরকে রোযা পালনে উৎসাহ দেয়া উচিত, যদি তারা সক্ষম হয়। আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ নামাযের সাথে তুলনা করে ১০ বছর বয়সে রোযা না রাখলে দৈহিক শাস্তির কথা বলেছেন। বালক-বালিকারা রোযার সওয়াব পাবে এবং মাতা-পিতা ভাল কাজের প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেয়ার সওয়াব পাবেন।
● রুবাঈ বিনতে মুয়াওয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ “যখন আশুরার রোযা ফরয ছিলো, তখন আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে রোযা রাখাতাম, আর খাবার জন্য কান্না শুরু করলে তাদেরকে তুলা দিয়ে আকর্ষণীয় খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম, আমরা এটা করতাম ইফতারের সময় পর্যন্ত।” (বুখারী)
দিনের বেলায় কোনো কাফের যদি ইসলাম গ্রহণ করে, কোনো বালক-বালিকা যদি বালেগ হয়ে যায় এবং কোনো পাগল যদি ভাল হয়ে যায়, তাহলে তারা রোযার হুকুমের আওতায় এসে যাবে এবং সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে পূর্বের রোযাগুলোর কাযা করা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। যেহেতু আগের দিনগুলোতে তাদের উপর রোযা ওয়াজিব ছিল না।
পাগলের উপর থেকে শরীআতের হুকুম তুলে নেয়া হয়েছে। তবে যদি এমন হয় যে মাঝে মধ্যে সে পাগল হয় আবার মাঝে-মধ্যে ভাল হয়ে যায় তখন শুধু ভাল অবস্থায় তাকে রোযা রাখতে হবে। রোযা রাখা অবস্থায় দিনের বেলায় যদি পাগল হয়ে যায় তাহলে তার রোযা বাতিল হবে না। কেননা সে সুস্থ মস্তিষ্ক অবস্থায় রোযার নিয়ত করেছিল। মূর্ছা (হিষ্টিরিয়া) গ্রন্তের ক্ষেত্রেও ঐ একই হুকুম প্রযোজ্য।
যে রমযান মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলো, মাসের বাকী দিনগুলোর ব্যাপারে সে রোযার সব ধরনের বাধ্য-বাধকতা হতে মুক্ত এবং তার আত্মীয়দেরও তার পক্ষ থেকে রোযা রাখার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
কেউ যদি বালেগ হয়েও লজ্জার কারণে সিয়াম পালন না করে থাকে, তাহলে তাকে খালেছভাবে তাওবা করতে হবে এবং না রাখা রোযাগুলোর কাযা পালন ও প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন করে মিসকীন খাওয়াতে হবে। আল্লাহর হুকুম পালনে লজ্জা করা ঠিক নয়। অনুরূপ লজ্জার কারণে হায়েয-নিফাস অবস্থায় রোযা পালনকারিণীকেও পরবর্তীতে কাযা করতে হবে।
কোনো স্ত্রীলোক স্বামীর উপস্থিতিতে ফরয রোযা ছাড়া অন্য কোনো রোযা পালন করবে না। তবে স্বামীর অনুমতি নিয়ে পালন করা যাবে।
সন্ধ্যা বা রাতে হায়েয-নিফাস বন্ধ হয়ে গেলে রাতেই রোযার নিয়ত করতে হবে। গোসল করার আগেই ফজরের সময় (সকাল) হয়ে গেলেও রোযা শুদ্ধ হবে।
নিয়ম অনুযায়ী আগামী ভোরে ঋতুস্রাব হবে জানা থাকলেও, স্রাব না দেখা পর্যন্ত নিয়তসহ রোযা অব্যাহত রাখতে হবে। ঋতুস্রাব দেখার পরই রোযা ভঙ্গ করা যাবে।
কারো ঋতুস্রাব দেখা দিলে তা স্বাভাবিকভাবে শেষ হতে দেয়া উচিত। আল্লাহর সৃষ্টিধারাকে পরিবর্তন না করে আল্লাহর দেয়া নিয়ম সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ ও তাঁর আদেশের প্রতি দ্ব্যর্থহীন শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সকলের কর্তব্য। অতএব কৃত্রিম উপায়ে স্বাভাবিক ঋতুস্রাব বন্ধ করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা ইসলামী শরীআতে রোযার সময় ঋতুস্রাব জনিত ভঙ্গ করা রোযাগুলো পরবর্তী সময়ে কাযা পালন করার স্পষ্ট বিধান আছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মীনিগণ সকলেই ঋতুস্রাব হলে পরবর্তী সময়ে রোযাগুলোর কাযা করতেন। তবে কেউ যদি কৃত্রিম উপায়ে স্রাব বন্ধ করে পবিত্র হয়ে রোযা পালন করে, তাদের রোযা আদায়ও শুদ্ধ হবে।
চল্লিশ দিন পূর্ণ হওয়ার আগে নিফাস যেদিন বন্ধ হবে সেদিন থেকেই রোযা পালন এবং (গোসল করে) নামায শুরু করতে হবে। চল্লিশ দিন পরেও নিফাসের রক্ত দেখা দিলে এটি নিফাস বলে গণ্য হবে না। অতএব রোযা-নামায শুরু করতে হবে। তবে হায়েযের (ঋতুস্রাবের) নির্দিষ্ট সময়ের সাথে নিফাসের সময় সংযুক্ত হলে একে হায়েয (ঋতুস্রাব) মনে করতে হবে।
১. গর্ভস্থিত সন্তানের শারীরিক কাঠামোতে হাত, পা, মাথা ইত্যাদি কোনো একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গঠিত হওয়ার পর গর্ভপাত হলে: গর্ভপাতের পর নিফাস মনে করতে হবে এবং রোযা রাখবে না।
২. গর্ভস্থিত সন্তানের কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গঠিত হওয়ার পূর্বে গর্ভপাত হলে, গর্ভপাত পরবর্তী স্রাব নিফাস বলে গণ্য হবে না, বরং মোস্তাহাযা বলে গণ্য হবে। আর এক্ষেত্রে সক্ষম হলে রোযা পালন করতে হবে।
হায়েয-নিফাস ছাড়া রক্তস্রাবে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট মেয়েদের ঋতুস্রাব ছাড়া “ইস্তেহাযাহ” কালীন রোযা সহীহ-শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
গর্ভবতী ও স্তন্যদায়িনী নারী রোযা ভাঙ্গতে পারবে। যদি রোযা পালনে তার নিজের অথবা শিশু সন্তানের ক্ষতি বা জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা থাকে। পরবর্তীকালে তাকে একদিনের বদলে একদিন ঐ রোযা কাযা পালন করতে হবে।
● মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ মুসাফিরদের জন্য রোযা (স্থগিত) এবং নামাযের অংশ বিশেষে ছাড় দিয়েছেন, আর গর্ভবর্তী ও স্তন্যদায়িনীর জন্য রোযা পালনের বাধ্যবাধকতা শিথিল করেছেন।” অর্থাৎ পরবর্তীতে আদায় করতে হবে।
যে স্ত্রীলোকের উপর রোযা ফরয হয়েছে, তার সম্মতিতে দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রীতে যৌনকার্য সংঘটিত হলে, উভয়ের উপর একই হুকুম কার্যকরী হবে (কাযা করতে হবে ও কাফ্ফারা দিতে হবে)। আর স্বামী যদি জোর করে সহবাস করে তাহলে স্ত্রী শুধু কাযা আদায় করবে, কাফ্ফারা দিতে হবে না। তবে স্বামীকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। যেসব পুরুষ লোক নিজেদেরকে সংযত রাখতে পারে না, তাদের স্ত্রীদের উচিত দূরে দূরে থাকা এবং দিনের বেলায় সাজ-গোজ না করা।