মূর্তি পূজার সূচনা হয় নূহ (আ:) এর পূর্বে। দীর্ঘদিন নূহ (আ:) এর দাওয়াতের পরেও ঈমান না আনায় তার জাতির কতিপয় ঈমানদার ব্যতীত বাকীদের আযাবে ধ্বংস করা হয়। মহান আল্লাহ বলেছেন,
তাদের নেতারা বলল, তোমরা (নূহ আ. এর কথায়) তোমাদের দেবতাদের ত্যাগ করো না। তোমরা ছেড়ে দিও না, ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসরকে।
সূরা নূহ : আয়াত ২৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কোরআনে বর্ণিত ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসর হচ্ছে, নূহ (আ.) এর কওমের কিছু মহৎ লোকের নাম। তাদের মৃত্যুর পর শয়তান জনগণকে বোঝালো, তোমরা এসব ব্যক্তির বৈঠকখানার পাশে একটি ভাস্কর্য তৈরি করো। প্রতিটি ভাস্কর্যকে তোমরা সেই মহৎ ব্যক্তির নামে নামকরণ করবে।
অতএব তারা শয়তানের প্ররোচনায় ভাস্কর্য তৈরি করল বটে, কিন্তু কোনোদিনই সেগুলোর উপাসনা করেনি। অবশ্য কিছুদিন পর নতুন প্রজন্মের লোকজন ভক্তি ও স্মৃতির সীমালংঘন করে এসব মূর্তির উপাসনা শুরু করে। (সহীহ বুখারী : ৪৬৩৬;)।
মূর্তিপূজা প্রথম উপাসনা বা পূজা হিসেবে শুরু হয়নি। হয়েছিল শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে। স্মৃতি তর্পণের মাধ্যমে। প্রজন্মান্তরে এসব ভাস্কর্য ও মূর্তি আল্লাহর আসন দখল করে নেয়। (নাউযুবিল্লাহ)। আদম (আ.) থেকে নূহের (আ) আগ পর্যন্ত পৃথিবী তাওহীদে ভরপুর ছিল। মানবজাতি ছিল শিরকমুক্ত। মহৎ লোকের ভাস্কর্যের বিদআতী ফেতনাই শিরকে রুপান্তর হয়েছিল।
ইব্রাহিম (আঃ) এর সময়ও মূর্তিপূজা ছিল
মহান আল্লাহ বলেনঃ
আর ইব্রাহিম বলল, দুনিয়ার জীবনে তোমাদের মধ্যে পরস্পরিক ভালোবাসার জন্যই তো তোমরা আল্লাহকে ছাড়া মূর্তিদেরকে গ্রহণ করেছো। তারপর কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ দিবে, আর তোমাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম আর তোমাদের জন্য থাকবে না কোন সাহায্যকারী।
সূরা আনকাবুত, আয়াত ২৫
মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
আর যখন ইব্রাহিম তার পিতা আযরকে বলেছিল, আপনি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহ রূপে গ্রহণ করছেন? নিশ্চয়ই আমি আপনাকে ও আপনার জাতিকে স্পষ্টভাবে গোমরাহীতে নিমজ্জিত দেখছি।
সূরা আনআম, আয়াত ৭৪
আল্লাহ আরো উল্লেখ করেন,
অতঃপর তাদের মাথা অবনত হয়ে গেল এবং বলল, ‘তুমি তো জানই যে, এরা কথা বলতে পারে না’। সে (ইবরাহীম) বলল, ‘তাহলে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদাত কর, যা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং কোন ক্ষতিও করতে পারে না’?
সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৬৫-৬৬
তিনি আরও বললেন,
সে বলল, ‘তোমরা নিজেরা খোদাই করে যেগুলো বানাও, তোমরা কি সেগুলোর উপাসনা কর’, ‘অথচ আল্লাহই তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তা সৃষ্টি করেছেন’?
সূরা সাফফাত, আয়াত ৯৫-৯৬
আরও আছে-
ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর, ওদের জন্য। তোমরা কি বুঝ না
সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৬৭
একটু চিন্তা করুন- মূর্তি ভাঙ্গা বা মূর্তি পূজার বিরোধিতা করার জন্য স্বয়ং ইব্রাহিম (আঃ) এর পিতাসহ পুরো জাতি তার বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়। তবুও তিনিও অটল ছিলেন এবং হয়েছেন আল্লাহর প্রিয় খলিল। অপরদিকে নমরুদের অনুসারীরা তার শাস্তি দাবি করেছিল- আর নমরুদ তার আয়োজন করেছিল। বর্তমানে কোথাও যদি এমন ঘটনা ঘটে আমাদের অবস্থান কি হবে? কুরআনের সাথে না নমরুদের অনুসারীদের মত শাস্তি দাবি করবেন!? বর্তমানে মূর্তিপূজা চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে – ধর্ম, ঐতিহ্য, চেতনার নামে বহু মূর্তি গড়ে উঠেছে।
এছাড়া মুসা (আ:) সহ সকল নবী, রসুলগণই মূর্তির বিরুদ্ধে বলেছেন। এখন একদল লোক একটা আয়াতের ভুল ব্যাখা করে সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানায়।
আল্লাহ বলেন,
আর আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমলংঘন করে অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহকেও গালি দেবে; এভাবে আমরা প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ শোভিত করেছি; তারপর তাদের রব-এর কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন। এরপর তিনি তাদেরকে তাদের করা কাজগুলো সম্বন্ধে জানিয়ে দেবেন।
সুরা আনকাবুত
আলোচ্য আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক মাসআলা নির্দেশিত হয়েছে যে, যে কাজ করা বৈধ নয়, সে কাজের কারণ ও উপায় হওয়াও বৈধ নয়। কুরাইশ সর্দাররা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ হয় তুমি আমাদের উপাস্য প্রতিমাদেরকে মন্দ বলা থেকে বিরত হও, না হয় আমরা তোমার প্রভুকে গালি দিবো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। [তাবারী] যাতে বলা হয়েছে, “আপনি ঐ প্রতিমাদেরকে মন্দ বলবেন না, যাদেরকে তারা উপাস্য বানিয়ে রেখেছে। তাহলে তারা আল্লাহকে মন্দ বলা শুরু করবে পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতার কারণে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বভাবগত চরিত্রের কারণে শৈশবকালেও কোন মানুষকে বরং কোন জন্তুকেও কখনো গালি দেননি। সম্ভবত কোন সাহাবীর মুখ থেকে এমন কঠোর বাক্য বের হয়ে থাকতে পারে, যাকে মুশরিকরা গালি মনে করে নিয়েছে। [তাফসীরে বায়যাভী; আইসারুত তাফসীর]
কুরাইশ সর্দাররা এ ঘটনাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে রেখে ঘোষণা করেছে যে, আপনি আমাদের প্রতিমাদেরকে গালি-গালাজ থেকে বিরত না হলে আমরা আপনার আল্লাহকেও গালি-গালাজ করব। এতে কুরআনের এ নির্দেশ নাযিল হয়েছে। এতে মুশরিকদের মিথ্যা উপাস্যদের সম্পর্কে কোন কঠোর বাক্য বলতে মুসলিমদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। এ ঘটনা ও এ সম্পর্কিত কুরআনী নির্দেশ একটি বিরাট জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং কতিপয় মৌলিক বিধান এ থেকে বের হয়ে এসেছে।
কোন পাপের কারণ হওয়া পাপ
উদাহরণস্বরূপ একটি মূলনীতি এই বের হয়েছে যে, যে কাজ নিজ সত্তার দিক দিয়ে বৈধ; বরং কোন না কোন স্তরে প্রশংসনীয়ও, সে কাজ করলে যদি কোন ফ্যাসাদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে কিংবা তার ফলশ্রুতিতে মানুষ গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে সে কাজও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কেননা, মিথ্যা উপাস্য অর্থাৎ প্রতিমাদেরকে মন্দ বলা অবশ্যই বৈধ এবং ঈমানী মর্যাদাবোধের দিক দিয়ে দেখলে সম্ভবতঃ সওয়াব ও প্রশংসনীয়ও বটে, কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে আশংকা দেখা দেয় যে, প্রতিমাপূজারীরা আল্লাহ তা’আলাকে মন্দ বলবে। অতএব, যে ব্যক্তি প্রতিমাদেরকে মন্দ বলবে, সে এ মন্দের কারণ হয়ে যাবে। তাই এ বৈধ কাজটিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। [কুরতুবী; রাযী]
রসুল (সা:) মক্কার জীবনে কোন মূর্তি ভাঙ্গেন নি, মক্কা বিজয়ের পর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন। তবুও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি মূর্তিদের গালমন্দ করেন, বাজে মন্তব্য করেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
সূরা আল কাফিরুন একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ তথা তাওহীদের বাণী প্রচার করতে লাগলেন তখন কুরাইশগণ তাতে বিভিন্নভাবে বাঁধার সৃষ্টি করে। এতো বাধা ও কুচক্রান্ত করার পরও যখন তারা ব্যর্থ হয় তখন তারা মহানবী (সা.) কে শান্তিচুক্তির আহ্বান জানায় যা ছিল অনৈতিক। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে প্রস্তাব দেয় যে, এক বছর তারা ও সবাই মূর্তি পূজা করবে এবং আর এক বছর তারা এবং সবাই আল্লাহর ইবাদত করবে। (নাউজুবিল্লাহ)। অনৈতিক এই প্রস্তাব শুনে মহান আল্লাহ প্রিয় সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের কাছে পবিত্র এই সূরা নাজিল করেন এবং মহানবী (সা.) নির্দেশ দেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম যেন তাদের এই প্রস্তাব থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ঘোষণা করেন।
সূরাটি নাজিল হওয়ার পর মক্কায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং কিছু মুশরিক ইসলাম গ্রহণ করে এবং আল্লাহর একত্ববাদকে সাদরে গ্রহণ করে।
আল্লাহ বলেন,
বলুন, হে কাফেরকূল, আমি এবাদত করিনা, তোমরা যার এবাদত কর। এবং তোমরাও এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি এবং আমি এবাদতকারী নই, যার এবাদত তোমরা কর। তোমরা এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি। তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্যে।
সূরা আল কাফিরূন
অন্য এক বর্ণনায় আছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, কাফেররা প্রথম শান্তিচুক্তির স্বার্থে রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর কাছে প্রস্তাব দিলো যে, তারা রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কে অনেক ধন সম্পত্তি দিবে এবং আপনি যে মহিলাকে ইচ্ছা বিবাহ করতে পারবেন, বিনিময়ে আমাদের উপাস্যদেরকে খারাপ বলবেন না। আর যদি আপনি এটাও মেনে না নেন তাহলে, একবছর আমরা আপনার উপাস্যের এবাদত করব এবং একবছর আপনি আমাদের উপাস্যদের এবাদত করবেন।
এছাড়া কুরআনের বহু আয়াত, রসুলের (সা:) জীবনী ও হাদীস মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে এখনও এগুলো প্রকাশ করলে মুশরিকরা মনে কষ্ট পেতে পারে তাই ভালোবাসার নামে এগুলো প্রচার ছেড়ে দিবেন যাতে তারা জাহান্নামে যায়!
নাকি বরং ওদের সত্য জানাতে শত্রুতা মেনে নিবেন- আর তারা যেন হেদায়েতের পথে এসে জান্নাত পায় সেই দোয়া করা উত্তম!!
ইব্রাহিম (আঃ) যে রাষ্ট্রে মূর্তি ভেঙ্গেছেন তা ছিল কুফরী রাষ্ট্র আর মক্কা, মদীনায় মুশরিকদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যদিও এখানকার ক্ষমতাসীনরা তা মেনে চলছে না। অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্রে (যে রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ শরীয়া আইন বিদ্যমান) জিজিয়া দিয়ে তারা নির্দিষ্ট স্হানে (মন্দির, উপাসনালয়ে) তাদের ইবাদত করতে পারবে!! আর ওদের বিরোধিতার নাম করে নিরীহ বিধর্মীদের উপর আঘাত (যারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়নি) নিষিদ্ধ।
এখন কিছুলোক মূর্তি বলতে শুধু বিধর্মীদেরগুলোই বুঝে। তাই এইক্ষেত্রে ওদের বিরোধিতা করলেও যখন চেতনা, সংস্কৃতি, আদর্শ পুরুষের নামের মূর্তিগুলোর বিরোধিতা করলে, তারাই মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয় -দেশের শান্তি, প্রগতি ও ঐক্যের পথে হুমকি এসব মুসলিমরা।