মুজিযা হলো প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমী কাজ, যা একজন নবুওয়াতের দাবীদার কর্তৃক প্রকাশ পায়। নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের চ্যালেঞ্জে তিনি তা সম্পাদন করেন এবং কাজটির প্রকৃতি এমন যে, অস্বীকারকারীদের পক্ষে সেরূপ কাজ সম্পাদন করা অসম্ভব। (শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা)
মুজিযা এমন অসাধারণ কাজ, যা আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবী-রসূলগণের দ্বারা সংঘটিত করে থাকেন। উদ্দেশ্য নবীর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করা।
তার সারসংক্ষেপ এই যে, মুজিযা বলা হয় –
(১) যা অসাধারণ, অস্বাভাবিক ও অলৌকিক,
(২) যা নবী-রাসুলগণের দ্বারা প্রকাশ পায়,
(৩) তবে তার সংঘটক স্বয়ং আল্লাহ তাআলা,
(৪) তা নবী-রাসুলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ,
(৫) তার মধ্যে নবী-রাসুলগণের পক্ষ থেকে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি মুকাবিলার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়, তবে তারা তার মুকাবিলা করতে সক্ষম হয় না।
তবে কিছু মুজিযা দীর্ঘমেয়াদী আর কিছু হঠাৎ আল্লাহর হুকুমে প্রকাশ পায়। যেমন – রসুলের (সা:) শরীর হতে খুশবু আসতো যা মেশকের চেয়ে উত্তম ছিল আর ইউসুফ (আ) এর রূপ যা দীর্ঘমেয়াদী মুজিযা। রসুলের (সা:) সবচেয়ে বড় মুজিযা হল আল কুরআন। অন্যন্য নবী-রসুলগনের মৃত্যুর পর তাদের কিতাব বিকৃত হয়, মুজিযাও শেষ হয়ে যায়। অপরিদকে যতদিন মুসলিম থাকবে ততদিন রসুলের (সা) মুজিযা আল কুরআন থাকবে।
আর আল্লাহর হুকুমে ওলির মাধ্যমে সংঘটিত ঘটনাকে কারামতি বলে। সুতারং কেউ কুরআন, সুন্নাহের পথে চললে তার দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছেই কারামত সংগঠিত হতে পারে।
কিন্তু এই নিয়ে বাড়াবাড়ি, ছাড়াছাড়ি দুটোই চলছে – অমুক বুজুর্গ, পীর দ্বারা অমুক অমুক কারামত সংগঠিত হয়েছে দাবি করে এবং বলে তাদের মন্তব্য কুরআন সুন্নাহের বিপরীত হলেও তা মানতে হবে। অথবা অমুক পীর, বুজুর্গ চাইলে কারামত প্রকাশিত হয়। অথচ কুরআনে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ ঘোষণা করেন মুজিযার কথা আর হাদীস হতে প্রমান পাওয়া যায় কারামত আল্লাহর ইখতিয়ার।
মহান আল্লাহ্ বলেন:
এবং তারা বলে, কখনো আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব না যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্যে ভূমি হতে প্রস্রবণ উৎসারিত করবে। অথবা তোমার খেজুরের ও আংগুরের এক বাগান হবে যার ফাঁকে ফাঁকে তুমি অজস্র ধারায় প্রবাহিত করে দিবে নদী-নালা। অথবা তুমি যেমন বলে থাক তদনুযায়ী আকাশকে খণ্ড-বিখণ্ড করে আমাদের উপর ফেলবে অথবা আল্লাহ্ তা'আলা ও ফেরেশতাগণকে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করবে। অথবা একটি স্বর্ণ নির্মিত গ্রহ হবে, অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে; কিন্তু তোমার আকাশে আরোহণে আমরা কখনো ঈমান আনব না যতক্ষণ না তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ করবে যা আমরা পাঠ করব। বলুন, পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক; আমি তো হলাম কেবল একজন মানুষ, একজন রাসূল (১৭: ১০-৯৩)।
এ সকল আয়াত এবং এগুলোর সাথে সামঞ্জস্যশীল অন্যান্য আয়াত সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর।
ইউনুস এবং যিয়াদ, হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা সূর্যাস্তের পর কুরায়শ বংশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা কা’বাগৃহের নিকট সমবেত হয়। আব্বাস (রা) উপস্থিত লোকদের নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের একে অন্যকে বলল যে, তোমরা মুহাম্মাদ (সা)-এর নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ কর এবং তার নিকট যুক্তিতর্ক পেশ কর যাতে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে তার কোন ওযর আপত্তি না থাকে। এরপর তারা তাঁর নিকট এই বলে লোক পাঠায় যে, তোমার সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ সমবেত হয়েছেন, তারা তোমার সাথে কথা বলবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সব সময় এটাই কামনা করতেন তারা যেন সৎপথে আসে। তাদের সত্যদ্রোহিতায় তিনি দুঃখ পেতেন। তাদের উপস্থিতির কথা শুনে তিনি ধারণা করেন যে, ঈমান আনায়নের ব্যাপারে তাদের মনে কোন নতুন অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই সংবাদ শুনে দ্রুত তিনি তাদের নিকট উপস্থিত হন এবং তাদের নিকট গিয়ে বসেন।
তারা বলল, হে মুহাম্মাদ! আমরা তোমার নিকট সংবাদ পাঠিয়েছি এজন্যে যে, এ বিষয়ে আমরা তোমার ওযর আপত্তির পথ বন্ধ করে দিতে চাই। তুমি তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছ কোন মানুষ তার নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমন কিছু করেছে বলে আমাদের জানা নেই। তুমি আমাদের পূর্বপুরুষদের দুর্নাম করেছ, আমাদের ধর্মের দোষত্রুটি বর্ণনা ও সমালোচনা করেছ। আমাদের জ্ঞানী-গুণী লোকদেরকে তুমি মূর্খ বলেছ। আমাদের উপাস্যগুলোকে তুমি গালমন্দ করেছ। আমাদের ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়কে তুমি বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত করে দিয়েছ। এমন কোন মন্দ কাজ ও মন্দ আচরণ নেই, যা তুমি আমাদের সাথে করনি। তোমার এরূপ প্রচারের দ্বারা ধন-সম্পদ সংগ্রহ করাই যদি উদ্দিষ্ট হয়, তবে আমাদের সকলের ধন-সম্পদ থেকে কিছু কিছু আমরা তোমাকে দিয়ে দিব যার ফলে তুমি আমাদের সকলের চাইতে অধিক সম্পদশালী হয়ে যাবে। সম্মান ও মর্যাদাই যদি তোমার কাম্য হয়, তবে আমরা তোমাকে আমাদের সকলের নেতা রূপে বরণ করে নিব। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
কিন্তু আল্লাহ অনুমোদন দেননি ফলে এমন কোন ঘটনাও ঘটেনি।
কারামতের উদাহরণ –
১. হযরত আনাস বিন মালিক রা. বর্ণনা করেন-
এক রাতে হযরত উসাইদ বিন হুদাইর রা. ও আব্বাদ বিন বিশার রা. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত ছিলেন। যখন তাঁরা দরবার থেকে প্রস্থান করলেন, তখন চারদিক ছিল ভীষণ অন্ধকার। হঠাৎ ওপর থেকে আলোর বিচ্ছুরণ তাঁদের চারপাশ আলোকিত করে দিল। তাঁরা একে অন্যের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার পরও বাড়ি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সেই আলো তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল। [বুখারী, হাদীস নং ৪৬৫ ও ৩৬৩৯, মুসলিম]।।
২. হযরত ওমর রা. কোনো এক যুদ্ধে হযরত সারিয়া রা.-এর নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। কোনো একপর্যায়ে হযরত ওমর রা. মদীনা মুনাওয়ারা মসজিদে জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবা চলাকালীন তিনি উচ্চ আওয়াজে বললেন- হে সারিয়া, পাহাড়ের দিকে দেখ! পাহাড়ের দিকে দেখ! যখন সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ হতে ফিরে এল, হযরত সারিয়া রা. বললেন, আমিরুল মুমিনীন! যখন চতুর্দিক থেকে শত্রুরা আমাদের ওপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, হঠাৎ আমরা শুনতে পেলাম কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, হে সারিয়া, পাহাড়ের দিকে দেখ! এরপর আমরা পাহাড়ে আরোহণ করে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই করে আল্লাহর রহমতে জয়লাভ করি। [বায়হাকি]
কারামত হতে উম্মাহ উপকৃত হবে সেটা স্বাভাবিক, এবং যতদিন মুসলিম থাকবে ততদিন কারামত থাকবে।
যেমন – মুসলিমদের তকবীর ধ্বনি দিয়ে ইস্তাম্বুল বিজয় এবং মাহাদী (হাফি:) ও দাজ্জালের সময়ে জিকিরে মুমিনের ক্ষুধার কষ্ট দূর হবে।
একটু খেয়াল করলে বুঝবেন- উমর (রা:) বহুদূর হতে মুসলিম বাহিনী সতর্ক করলেন নিহত ও পরাজিত হওয়া হতে। অথচ যখন তিনি শহীদ হলেন তাকে আহত করার পূর্বে তিনি টের পাননি। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারামাত প্রদর্শিত হতো জেহাদে অথচ কারামতের দাবিদার অনেকে জেহাদের বিপরীত।
কারন কারামত সম্পূর্ণ আল্লাহর নির্দেশে হয় আর উমর (রা:) শাহাদাতের দোয়া করেন আল্লাহ কবুল করেন।
আমীরুল মূমীনীন হযরত ওমর(রাঃ)-এর দুয়া:
اللَّهُمَّ ارْزُقْنِي شَهَادَةً فِي سَبِيلِكَ وَاجْعَلْ مَوْتِي فِي بَلَدِ رَسُولِكَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
(আল্লাহুম্মারযুকনি শাহাদাতান ফি সাবিলিক, ওয়ায’আল মাওতি ফি বালাদি রাসুলিক)
… “হে আল্লাহ, আমাকে শাহাদাতের মৃত্যু দিন এবং মৃত্যু রাসূল (স:) এর শহরে দিন।” (সহীহ বুখারী: ১৮৯০)
আর একটা মূল ব্যাপার হল উমর (রা:) দ্বারা এত বড় কারামত প্রকাশ হওয়ার পরও কি সাহাবীরা কখনও তার সাথে একতেলাফ করেননি!! বরং জানা যায় উমর (রা:) রায় দিয়েছেন, আলী রা বা অন্যরা আরও উত্তম সমাধান দিয়েছেন আর উমর (রা:) খুশি হয়ে তা মেনে নিতেন বরং তাদের জন্য দোয়া করতেন।
তার মানে কারামত প্রকাশ পেলেও তার কথা দলিলহীন হলে মানতে হবে এমন কোন ভিত্তি নেই।
অপরদিকে যারা কুরআন, সুন্নাহর বিপরীত চলে অথচ তাদের দ্বারা কিছু অদ্ভুত ঘটনা প্রকাশ পায় তা হল জাদু বা শয়তান দ্বারা সংঘটিত ঘটনা।
যেমন- মুসা (আ:) এর যুগে জাদুকরদের ঘটনা! যখন মুজিযা এসেছে জাদু বিলুপ্ত হয়েছে। আর এই উম্মতের জন্য রহমত রসুল (সা) এর মুজিযা আল কুরআন, সুন্নাহ মেনে চললে সকল জাদু ও শয়তানের ফেতনা দূরীভূত হবে।
এভাবে জাদু, কারামতের মধ্যে পার্থক্য না বুঝার কারনে বহুলোক ঈমান হারা হয়েছে ও হচ্ছে। যেমন – হাসান ইবনে সাবাহর ধোঁকাবাজি ও আল মুকান্না কৃত্রিম চাদের ধোকা দিয়ে নবী ও রব দাবি করে। দাজ্জালও তাই করবে।
ইনশাআল্লাহ এগুলো নিয়ে পরে আলোচনা হবে।