মাতৃভাষার নামে অতিরঞ্জন

জন্মের পর মানুষ যে ভাষায় প্রথম কথা বলে সেটা তার মায়ের ভাষা। সে ভাষার প্রতি তার ভালোবাসা ও ভালোলাগাটা অতি স্বাভাবিক। তবে প্রতিটি ভালোবাসা প্রকাশের নির্দিষ্ট সীমানা বেধে দিয়েছে প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল আলামীন। সে সীমানা অতিক্রম করলে ধ্বংস অনিবার্য।

ভাষা নিয়ে আমরা অনেকেই গর্ব করি, এই ভাষা শ্রেষ্ঠ ভাষা আর আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। আজ আরব, অনারব, ইংরেজ সবাই নিজ ভাষাকে সর্বোত্তম ও নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। আসলে কোন জাতি কি ভাষার কারণে শ্রেষ্ঠ হতে পারে!? মানুষ শ্রেষ্ঠ হয় তার কর্মে। বিদায় হজ্বে রাসুল (সা:) বলেছেন- আরব অনারবের উপর প্রাধান্য নেই তাকওয়া ছাড়া (ইবনে হিশাম, বুখারী, মুসলিম)।

সকল ভাষাভাষী মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। আর রাসুলপাক (সা:)- আরবিকে ভালোবাসতেন, কারণ এ ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে, জান্নাতের ভাষা, এই ভাষায় কথা বলতেন ও দ্বীন প্রচার করতেন (বুখারী)। কিন্তু রাসুল (সা:) আসার আগে লাত, মানত, উযজা সহ সকল দেবদেবীর পূজা করা হত আরবের ভাষাতে। এখন এসব পূজাতে তারা যেসব শব্দ ব্যবহার করত তা কি শ্রেষ্ঠ নাকি নিৎকৃষ্ট?

আসলে ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে এর সঠিক প্রয়োগে, শুধু জন্মসূত্রে এ ভাষা অর্জন করাতে নয়। আজও আরবে মদের বোতলে আরবি লেখা হয় আর এদেশে অশ্লীল গালি, গান, কবিতা বাংলাতে লেখা হয় চাইনিজে নয়। আসলে কুরআন আল্লাহর বাণী হওয়াতে তা শ্রেষ্ঠত্ব পায় যা দ্বারা আল্লাহর ইবাদাত করা হয় ঠিক তেমনি আরবি ভাষাতে যেসব দেবদেবীর পূজা করা হত তা নিৎকৃষ্ট। আর জন্মসূত্রে পাওয়া ভাষা নিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করা বোকামী কারণ আমাদের জন্ম ও সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের নিজ ইচ্ছায় নয়। প্রত্যেক ভাষাভাষী ব্যক্তিই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন- “এবং তার নির্দেশবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা, বর্ণের বৈচিত্র্য। অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন (সুরা রুম -২২)।

আল্লাহ বলেন- “আমি প্রত্যেক জাতির কাছে রাসুলকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যেন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখা করতে পারে (সুরা ইব্রাহীম -৪)। আল্লাহর আসমানী কিতাবসমূহ বিভিন্ন নবীর কাছে বিভিন্ন ভাষায় নাযিল হয়েছে আর আল্লাহর ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কি হতে পারে!? প্রকৃতপক্ষে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে আর এসব ভাষার সাল, মাস, দিনের সাথে ধর্মীয় ইবাদাতগুলো জড়িত। যেমন- মুসলিমরা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন হিজরি সাল ও আরবি মাস গণনা হত যা আমাদের ইবাদাতের সাথে জড়িত। ইংরেজরা এসে এই উপমহাদেশে খ্রিষ্টীয় সাল চালু করে যা তাদের ইবাদাতের সাথে জড়িত। January হতে শুরু করে June পর্যন্ত নামগুলি দেবদেবীর নাম আর Staruday হতে Friday সবই দেবদেবীর নাম।

আর বাংলা সাল ও বারের জন্মদাতা সমাট্র আকবর দ্বীনি ইলাহী নামক ধর্ম প্রচার করেন। আর ধর্মের পালন, আনন্দ উৎসব পালনের জন্য বিভিন্ন নামে মাস ও সপ্তাহের নাম রাখেন। যেমন- বিশাখা (বৈশাখ), জষ্ঠী (জৈষ্ঠ), শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহঃ, শুক্র সবই দেবতার নাম। আকবরের রাজদরবারে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল বেশি আর তিনি ওদের সন্তুষ্টির জন্য সম্মানপ্রদর্শন হিসেবে দেবদেবীর নামে নামকরন করেন।

মুসলিমদের আন্তর্জাতিক ভাষা ছিল আরবি কিন্তু তারা ক্ষমতা হারিয়েছে তাই আরবির বদলে তারা ইংরেজিকে মেনে নিচ্ছে। আজও চাকরির জন্য এদেশে বাংলা ভাষার দক্ষতা খুজে না, ইংরেজির দক্ষতা খুজে। জালেম পাকিস্তানি শাসকরা যদি নিজস্ব সংবিধান বাদ দিয়ে ইসলামী সংবিধান কুরআন দ্বারা শাসন করতো যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়েছিল।

তাহলে পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান সবাই নিজ নিজ ভাষায় কথা বলতে পারতো, আর যেহেতু কুরআন দ্বারা শাসিত হতো তাই দুদেশের দাপ্তরিক বা কমন ভাষা হতো আরবি। আর কুরআন দ্বারা শাসিত দুদেশের মুসলিমরা দ্বীনদারিতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদ, চাকরি, সম্মান ও মর্যাদা পেত। তাদের অতিরঞ্জিত জাতীয়তাবাদের ফলে যুদ্ধ হয়। রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- “যখনই তারা আল্লাহ ও তার রসুলের সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে, তখনই তাদের বিজাতীয় শত্রুকে (আল্লাহ) তাদের উপর বিজয় করে দিবেন, ফলে তারা মালিকানাধীন অনেককিছু দখল করে দিবে। যতক্ষণ শাসক আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করবে না, আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় কার্যকরী করবে না, ততক্ষন আল্লাহ অভ্যন্তরীন সংঘাত লাগিয়ে রাখবেন।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খন্ড পৃ-৩৬৩, ইবনু মাজাহ ৪০১৯)।

পাকিস্তান গঠনের সময় অঙ্গীকার করেছিল এটা শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র হবে। আর মুসলিমরা কালেমা পড়ে সাক্ষ্য দেয় তাদের জীবন আল্লাহর বিধানমতে চালাবে। কিন্তু তৎকালীন শাসকগণ কুরআনের সংবিধান বাদ দিলে সে অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়। ফলে পরস্পর সংঘাত, যুদ্ধ ফলশ্রুতিতে পাকরাষ্ট্র শত্রুপক্ষের নিকট পরাজিত হয়। এরপর কারগিল যুদ্ধেও ভারত তাদের কিছু ভূখণ্ড দখল করে নেয় এবং ভারতের ক্ষতির ভয়ে চীনের সাথে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে কাশ্মীরের কিছু অংশ উপহার দেয়।

আমরা আজ সে পথে হাটছি, ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শিরক করছি আর শিরকি মাস ও সপ্তাহের নাম, বৈশাখী নববর্ষ, বর্ষা ও বসন্ত বরণ পালন করতে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হচ্ছি। কিন্তু এই ভাষাতেই এসব কুফর ও শিরকের বিরোধীতা করলে কেউ বলবে দেশদ্রোহী ও কেউ বলবে পাকিস্তানের দালাল। এসব নিয়ে দেশে অভ্যন্তরীন সংঘর্ষ চলছেই।

আসলে ভাষা ও দেশকে ভালোবাসা মানে কি এই শিরকী অনুষ্ঠান ও হারাম গানবাজনায় অর্থ অপচয় করা? অথচ যে রমনা, গুলশানসহ বহুস্হানে এসন উৎসব পালন করা হয় তার চারপাশে বহু ফুটপাতের শিশু, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কষ্টে জীবনযাপন করে। তারা তো এদেশের মানুষ ও বাংলা ভাষায় কথা বলে তখন তথাকথিত দেশপ্রেমের চেতনা কোথায় থাকে!?

এই ভাষাকে ভালবাসি, এই ভাষাতেই আল্লাহ ও রাসুলের প্রশাংসা ছড়াবো কিন্তু এ ভাষার ব্যবহৃত অশ্লীল, শিরকীয় শব্দ ও আচার অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলব। কারণ মুমিনদের ভালোবাসা কখনও আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রাধান্য পায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *