মসজিদ হতে ফেতনা ছড়ানো

মসজিদ মুসলিমদের ইবাদতখানা। সালাত, বিচার, বিবাহ, ওয়াজ-নসিহত, মুসলিমদের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত সবকিছুই আসতো মসজিদ হতে। এটা যেমন সত্য তেমনি মুসলিমদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধিত হয়েছে মসজিদ-মাদ্রাসার নাম দিয়ে ফেতনাবাজ সংগঠন নির্মাণ করে। উম্মতকে বিভক্ত ও পথহারা করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র যুগ যুগ ধরে চলছে তা কুরআন ও রসুলের সীরাত হতে স্পষ্ট বুঝা যায়।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

“এবং যারা মসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মু’মিনদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি যুদ্ধ করেছে, তার গোপন ঘাঁটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করবে, ‘আমরা সদুদ্দেশ্যেই তা করেছি।’ আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী। তুমি তাতে কখনো (সালাতের উদ্দেশ্যে) দাঁড়িয়ো না। যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই স্থাপিত হয়েছে তাকওয়ার উপরে, তাই তোমার সালাতের জন্য অধিকতর উপযোগী। সেখানে এমন লোক আছে যারা পবিত্রতা অর্জন ভালবাসে এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন। যে ব্যক্তি তার ঘরের ভিত্তি আল্লাহ ভীতি ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর স্থাপন করে সেই উত্তম, না ঐ ব্যক্তি উত্তম যে, তার ঘরের ভিত্তি স্থাপন করে এক খাদের ধ্বংসোম্মুখ কিনারায়, ফলে যা তাকেসহ জাহান্নামের আগুনে পতিত হয়? আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না। তাদের সে ঘর যা তারা নির্মাণ করেছে তা তাদের অন্তরে সন্দেহের কারণ হয়ে থাকবে যে পর্যন্ত না তাদের অন্তর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’

সুরা তওবা ৯ঃ ১০৭-১১০

তাবূক থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদীনায় প্রবেশের পূর্বাহ্নে রাসূল (সা) কর্তৃক মসজিদটি মিসমার করে দেওয়ার নির্দেশ প্রসংগটি ইবনু ইসহাক বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। সে আলোচনার সার কথা হল, মুনাফিকদের একটি দল কূবা মসজিদের কাছে মসজিদের আকার-আকৃতি দিয়ে একটি ঘর তৈরী করল। তাদের পরিকল্পনা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাতে উদ্বোধনী সালাত আদায় করে দিলে তাদের দূরভিসন্ধি তথা শৃংখলা ভংগের এবং কুফরী ও হটকারীতার পথ সুগম হয়ে যাবে।

কিন্তু আল্লাহ তার রাসূলকে সেখানে সালাত আদায় করা থেকে বিরত রেখে হিফাজত করলেন। আর তা হল এভাবে, তিনি তখন তাবূক অভিযানে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি ‘যী আওয়ান’ মদীনা থেকে এক ঘন্টা দূরত্বের স্থানে অবস্থানকালে এ মসজিদ সম্পর্কে পূর্বোক্ত ওহী নাযিল হয়।

কুরআনে দুরভিসন্ধিমূলক ও ক্ষতিকর বলার যুক্তি হল- তাদের উদ্দেশ্য ছিল কুবা মসজিদের প্রতিকূলে প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হওয়া। আর কুফরী ক্রিয়াকাণ্ড এ জন্য যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্থলে এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ছিল তার প্রতি কুফরী। আর ‘বিভেদ সৃষ্টি করণে’ এ কারণে যে, কূবা মসজিদের মুসল্লী জামাআতে বিভক্তি সৃষ্টির প্রয়াস ছিল। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য ঘাঁটি ও আখড়া….ব্যক্তিটি হল রাহিব আবূ আমির ফাসিক- আল্লাহ তাকে কুৎসিত করুন।

ঘটনা এরূপ- আল্লাহর রাসূল (সা) তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলে সে তা প্রত্যাখ্যান করল এবং মক্কায় গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের উত্তেজিত করে তুলল। ফলে সংঘটিত হল উহুদের যুদ্ধ। তার চক্রান্ত সফল না হওয়ায় সে রাসূলের বিরুদ্ধে সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে রোম সম্রাট কায়সারের দরবারে উপনীত হল। আবূ ‘আমির ছিল হিরাক্লিয়াসের ধর্মাবলম্বী অন্যতম আরব খৃস্টান। সেখানে থেকে সে রং বেরং-এর প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যতের রংগীন আশার আশ্বাস দিয়ে মদীনায় তার সহযোগীদের কাছে চিঠি-পত্র পাঠাতো।

শয়তান তো শুধুমাত্র প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকে। এভাবে তার চিঠিপত্র ও দূতের ঘন ঘন গমনাগমন চলতে থাকত। এক পর্যায়ে তারা মসজিদরূপী এ ঘরটি তৈরী করল, যা মূলত ছিল যুদ্ধের আখড়া এবং আবূ ‘আমির রাহিবের নিকট থেকে আগত প্রতিনিধিবর্গ ও তাদের অনুগামী মুনাফিকদের নিরাপদ আস্তানা। এ কারণেই আল্লাহ পাক তার ঘোষণায় বলেছেন- “আল্লাহ এবং তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারীদের আখড়া। তারপর ইরশাদ করেছেন, ঐ ঘরের নির্মাতারা অবশ্যই কসম করে বলবে- এ নির্মাণে আমাদের উদ্দেশ্য একান্ত নির্ভেজাল ও মহৎ। জবাবে আল্লাহ্ পাকের ইরশাদ- “আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, ওরা নিশ্চিতই শুধু মিথ্যাবাদী। তারপর আল্লাহ তার রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সেখানে আপনি মুহূর্তের জন্যও অবস্থান করবেন না। এ নিষেধাজ্ঞার কারণ হল, যাতে তাঁর অবস্থান ওদের উদ্দেশ্যের সার্থকতা আনায়নে সহায়ক না হয়। বরং আল্লাহ তাকে নির্দেশ দিয়ে অনুপ্রাণিত করলেন সে মসজিদে অবস্থানের ব্যাপারে, সূচনালগ্ন থেকেই যার বুনিয়াদ রয়েছে তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতির উপরে। সেটি হল কূবা মসজিদ।

কেননা, আয়াতের পূর্বাপর বর্ণনা সংযুক্তি এ দাবী প্রমাণ করে এবং কুফাবাসীদের তাহারাত প্রীতির প্রশংসায় বর্ণিত হাদীসসমূহেও বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত মিলে। তবে মুসলিম শরীফে যে ‘তাকওয়ার বুনিয়াদ সম্বলিত মসজিদ’ বলে ‘মসজিদে নববী’-কে বুঝানো হয়েছে, তা আমাদের বর্তমান বর্ণনার সাথে সংঘাত সৃষ্টি করবে না।

কেননা, কুবা মসজিদ সম্পর্কে যদি ‘সূচনা লগ্ন থেকে তাকওয়ার উপরে ভিত্তিকৃত’ বিশেষণ কার্যকর হতে পারে, তাহলে নববী মসজিদ তো এ গুণের অধিকতর উপযোগী ও অধিকারী। বরং তার মাহাত্ম্য তো আরো মযবুত ও সুদৃঢ়।

মোট কথা রাসূলুল্লাহ (সা) যী আওয়ানে অবস্থান কালে মালিক ইবনুদ দুম ও মাআন ইব্‌ন ‘আদী অথবা তার ভাই আসিম ইবন ‘আদী (রা)-কে ডেকে পাঠালেন এবং অনাচারীদের নির্মিত এ মসজিদের কাছে গিয়ে সেটি ভষ্মীভূত করে ফেলার নির্দেশ দিলেন। (তাফসীরগ্রন্হ, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ৫ খন্ড)।

আজও দেখুন আরবসহ সারাবিশ্বে অনেক ঝাঁকঝমকপূর্ন মসজিদ তৈরি করা হয়। যেখানে বড় বড় আলেমদের আমন্ত্রণ জানানো হয় – যেন মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যায় এই মসজিদ ইসলামের কল্যাণে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হল- এইসব মসজিদে ক্ষমতাসীনদের সুবিধা অনুযায়ী ইসলাম শেখানো হয়। যে ইসলাম ও ওয়াজ প্রচার করলে তাদের জন্য সমস্যা হবে সেরকম কিছু প্রচার করলে আলেম-ওলামাদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। এমনকি অধিকাংশ মসজিদগুলোতে প্রশাসন খুতবা নিয়ন্ত্রণ করে।

আপনি কাদের বড় শত্রু ভাবছেন? কাফেরদের!? যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে!! নাকি মুসলিম নামধারী তাদের যারা ইসলামের শত্রুদের সাহায্য করে!?
বিভ্রান্ত ইসলাম প্রচার করে উম্মতকে পথহারা ও বহুদলে বিভক্ত করে দুর্বল করে তুলছে। ওরা মুসলিমদের তেল, গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে বড় বড় প্রাসাদ, দালান, স্বর্ণের গাড়ি, জামা এমনকি স্বর্নের টয়লেট পর্যন্ত নির্মাণ করছে।

অপরদিকে কাফেররা সেই একই তেল, গ্যাস, প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে নাসা, পারমাণবিক বোমাসহ, টেকনোলজি ও সমরাস্ত্র, অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হয়েছে।

আর আমাদের দেশে এমন অনেক মসজিদ আছে যার সভাপতির আকীদায় কুফরী, শিরক বিদ্যামান। অথচ ঈমাম অর্থ নেতা, প্রধান আর সভাপতি অর্থও নেতা, প্রধান। মসজিদের প্রকৃত সভাপতি হলো ঈমামগণ যারা সালাত পড়ান, ও ওয়াজ নসিহতে উম্মতকে পথনির্দেশনা দেন। তথাকথিত সভাপতি কি সালাত পড়াতে পারে না জুমার খুতবা দিতে পারে!? কতটুকু ইসলাম সে জানে ও মানে!?

মূলত এসব সভাপতিগণ মসজিদের হিসাব, টাকা তোলা, ভবন নির্মানের দায়িত্ব পান। যাকে মূলত স্বেচ্ছাসেবক বা কেয়ারটেকার বলা যেতে পারে। কিন্তু এই নামকরণ দিলে অধিকাংশ লোক দেখানো সাহায্যকারী ধনী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ মসজিদের পদ ও দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইবে না!!!

অথচ আল্লাহ বলেন-

“আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহেঃ অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের উপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য। তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, (দুনিয়ার সাথে) সম্পর্কচ্ছেদকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে।

সুরা তওবা ১১২-১১৩

কেয়ামতের পূর্বে অনেক মসজিদই নির্মাণ হবে – যেখানে তাকওয়া ও দ্বীনদারিতা নয় বরং চাকচিক্যকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

● আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না মানুষ মসজিদ (কারু-কার্যকরণ) নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। (আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)

সাহাবায়ে কেরাম রা. সবসময় মসজিদ সুসজ্জিত করা থেকে সতর্ক করতেন। এবাদত, আল্লাহর স্মরণ এবং দ্বীনী শিক্ষার মাধ্যমেই মসজিদ আবাদ করার প্রতি তাগিদ দিতেন।

● ইবনে আব্বাস রা. বলেন- “অচিরেই তোমরা মসজিদগুলোকে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের মত কারুকার্য করে গড়ে তুলবে।” (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ)।

ইমাম বগভী রহ. বলেন “প্রাথমিক যুগে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের উপাসনালয়গুলো কারুকার্যমন্ডিত ছিল না, আসমানী কিতাব বিকৃত হওয়ার পর-ই তারা কারুকার্যকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে।” (ফাতহুল বারী)

খাত্তাবী রহ. বলেন- “ইহুদী খ্রিষ্টানরা যখন আসমানী কিতাব বিকৃত করে ফেলে, আল্লাহর দ্বীনকে বিনষ্ট করে ফেলে, তখন-ই তারা গির্জা সুসজ্জিত-করণে আত্মনিয়োগ করে।” (উমদাতুল ক্বারী)

তাই তো দেখা যায় সভাপতি বা ধনী, ক্ষমতাসীনদের খুশি করতে এমন লোকের জন্য দোয়া ও জানাজা পড়া হয় যে সারাজীবন ইসলামের বিধানকে উপহাস করেছে। ইসলাম বিরোধী আইন রচনা ও প্রসার করেছে।

আল্লাহ বলেন-

“মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করা, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা দোযখী।”

সুরা তওবা -১১৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *