ভালবাসা, শত্রুতা ও জাহেলিয়াত

রাসুলুল্লাহ (সা:) এর সাহাবীদের মধ্যে চারজন ছিল সবচেয়ে কঠোর। তারমধ্যে সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা:) অন্যতম। সাদ (রা:) তার মাকে খুবই ভালোবাসতেন। সাদ (রা:) এর মা তার ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে হৈ চৈ, বিলাপ করার পর বললেন- যতক্ষন সাদ (রা:) মুহাম্মদ (সা:) এর রিসালাতের অস্বীকৃতি দিবে না ততক্ষণ তিনি কিছু খাওয়া ও পানহার করবেন না, রোদ হতে বাচার জন্য ছায়াতেও আসবেন না। সাদ (রা:) চিন্তিত হয়ে গেলেন- কারণ মাতার সেবা করতে আল্লাহ হুকুম করেছেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা:) এর কাছে ছুটে গেলেন, বিস্তারিত ঘটনা বললেন, তখনই সুরা আনকাবুতের ৮ নং আয়াত নাযিল হয়- “আমি নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার সাথে সদ্বব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যার সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই তুমি তাদের মেনো না।” কুরআনের আয়াত সাদ (রা:) এর মনের অস্হিরতা দূর করে দিল। তার মা তিন দিন পর্যন্ত কিছু মুখে দিলেন না এবং রোদ হতে ছায়াতেও গেলেন না। তিনি বার বার মাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন তবুও তার মায়ের একই কথা ইসলাম ত্যাগ করতে হবে। অবশেষে সাদ (রা:) তার মায়ের মুখের উপর বলতে বাধ্য হলেন: মা, আপনার মতো হাজারটা মাও যদি ইসলাম ত্যাগ করার জন্য পানাহার ত্যাগ করে জীবন বির্সজন দেয় তবুও সত্য দ্বীন ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একথা তার মায়ের অন্তরে দাগ কাটে অবশেষে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুলের (সা:) কুরাইশ সাহাবীদের মধ্যে তিন ব্যক্তি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর, লাজুক, উত্তম ও সত্যবাদিতার অধিকারী। তার মধ্যে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা:) অন্যতম। বদর যুদ্ধের দিন আবু উবাইদার (রা:) আক্রমনে শত্রুরা দূরে সরে যেতে লাগল কিন্তু এক ব্যক্তি ঘুরেফিরে তার সামনে এসে দাড়াতে লাগল। তিনি তার সামনে হতে সরে যেতে লাগলেন, লোকটা বার বার আবু উবাইদার (রা:) সামনে এসে দাড়াতেন আর বারবারই তিনি এড়িয়ে যেতেন। অবশেষে লোকটি শত্রুপক্ষ ও আবু উবাইদার মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াল, ফলে তিনি তরবারির আঘাতে লোকটির মাথা কেটে ফেললেন। লোকটি আর কেউ নয়, লোকটি ছিল আবু উবাইদার পিতা। এ ঘটনার পর আল্লাহ তার শানে কুরআনের আয়াত নাযিল করেন- “আপনি কখনো আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদারকে কখনও তাদের প্রতি বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধচারন করেছে- তারা তাদের পিতা হোক কিংবা পুত্রই হোক বা ভাই হোক বা তার বংশের লোক। তারা সেই লোক যাদের হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালা ঈমান দৃঢ়মূল করে দিয়েছেন এবং তাদের শক্তিশালী করেছেন তার অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তাদের এমন জান্নাতে দাখিল করবেন যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহমান হবে। যাতে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট। এরা আল্লাহর দল। জেনে রেখ আল্লাহর দলই কল্যাণপ্রাপ্ত।”(সুরা মুজাদালাহ-২২)। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,আসহাবে রাসুল খন্ড-১”,মুসলিম শরীফ)। রাসুলের (সা:) অনেক সাহাবী ছিলেন ইসলামের শত্রুদের ব্যাপারে এরূপ কঠোর। কিন্তু সে সাহাবীরা মক্কা বিজয়ের সময় যখন মদীনায় ফিরছিলেন তারা সে ভূমি অতিক্রম করছিলেন যেখানে সুমাইয়া (রা:) কে যৌনাঙ্গে বর্শা নিক্ষেপ করে শহীদ করা, বেলাল (রা:) কে উত্তপ্ত বালুর উপর ও খাব্বাব (রা:) সহ অন্যান্য সাহাবীদের উপর নির্মম নির্যাতনের কথা মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল হামযা (রা:) কে ও মুসাইব বিন উমায়ের (রা:) নির্মমভাবে শহীদ হওয়া। অনেকের মনে তখন প্রতিশোধের চিন্তা, মক্কাবাসী তখন অতি ভীত ও অসহায়। কিন্তু রাসুল (সা:) তাদের ক্ষমা করে দিলেন এবং সাহাবীরা বিনা বাক্যে ক্ষমা করে দিলেন পাষান্ড শত্রুদেরও শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ স্বজনদের সাথে শত্রুতা করেছেন আবার আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ শত্রুদের ক্ষমা করেছিলেন তাই তারা ছিল বিজয়ী। আর আমরা সামান্য জমির জন্য ভাই-ভাইয়ের সাথে বহুবছর বিবাদে লিপ্ত হয়ে মারামারি ও খুনও করি, তুচ্ছ বাস ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে হাজার ছাত্র রাস্তা অবরোধ করে। অথচ রাসুল (সা:) ও কুরআন অবমাননাকারীর বিপক্ষে কথা বলার সময় তারা নিরব দর্শক হয়। সাহাবীরা প্রতিযোগিতা দিত আল্লাহ, রাসুল ও ইসলামের জন্য কে অগ্রগামী হবে, তাই তার আল্লাহর প্রিয় হয়েছিল ও জান্নাতের সমৃদ্ধির সুসংবাদ পেয়েছিল। আর এখন আমাদের প্রতিযোগিতা হল পহেলা বৈশাখে কিভাবে পান্তা-ইলিশ খাবে, কতটা নির্লজ্জভাবে উদযাপন করবে অথবা শহীদ মিনারে কে আর কার আগে ফুল দিয়ে গোনাহে লিপ্ত হবে। আমাদের ভালোবাসাও নিজের জন্য, শত্রুতাও ব্যক্তিস্বার্থে। তাই আমরা ভীরু, কাপুরুষ, সুবিধাবাদী, দুনিয়াপূজারী অপমানিত জাতিতে পরিণত হচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *