যুগে যুগে ঈমাম মাহাদীর আলোচনা যেমন এসেছে তেমনি ভন্ড মাহাদীরও আগমন হয়েছে। আবার ইবনে খালদুনসহ বহু আলেম মাহাদীর আগমনকে অস্বীকার করেছেন। বুখারী, মুসলিমে মাহাদীর (হাফিঃ) নাম না থাকলেও কিছুটা ইঙ্গিত রয়েছে। আরো যে সকল হাদিস মাহদীর প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত করেঃ
● জাবের রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অচিরেই ইরাক-বাসীর কাছে খাদ্যদ্রব্য ও রৌপ্যমুদ্রা সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হবে। আমরা বললাম কাদের পক্ষ থেকে এরকম করা হবে? উত্তরে বললেন- অনারব। অতঃপর বললেন- “অচিরেই শাম-বাসীর কাছে খাদ্যদ্রব্য ও স্বর্ণমুদ্রা সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হবে। কাদের পক্ষ থেকে করা হবে- প্রশ্নের উত্তরে বললেন- রোমান (পশ্চিমা)। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- “আমার শেষ উম্মতের মাঝে একজন খলীফার আবির্ভাব ঘটবে, বে-হিসাব মানুষের মাঝে সে সম্পদ বিলি করবে।”
বর্ণনাকারী আবু নাযরা ও আবুল আলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “আপনারা কি উমর বিন আব্দুল আজীজ রহ.কে সেই খলীফা মনে করেন? তারা বললেন- না!!” (মুসলিম)
● উম্মুল মুমেনীন আয়েশা রা. বলেন- একদা নবী করীম সা. নিদ্রাবস্থায় কেমন যেন করছিলেন। (জাগ্রত হওয়ার পর) জিজ্ঞেস করলাম- এমন করছিলেন কেন হে আল্লাহর রাসূল? বললেন- “খুব-ই আশ্চর্যের বিষয় আমার উম্মতের কিছু লোক কাবা ঘরে আশ্রিত কুরায়শী ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। বায়দা প্রান্তরে পৌঁছা মাত্র সবাইকে মাটির নিচে ধ্বসে দেয়া হবে। আমরা বললাম- পথে তো অনেক মানুষের সমাগম থাকে!! নবীজী বললেন- হ্যাঁ..! দর্শক, অপারগ এবং পথিক সকলকেই একত্রে ধ্বসে দেয়া হবে। তবে অন্তরিচ্ছা অনুযায়ী আল্লাহ পাক তাদের পুনরুত্থান করবেন।” (মুসলিম)
অর্থাৎ মাহদীকে হত্যা করতে আসা সেই নামধারী মুসলিম বাহিনীকে আল্লাহ বায়দা প্রান্তরে ধ্বসে দেবেন। তবে রোজ হাশরে নিয়তানুযায়ী সবাইকে উঠানো হবে। সৎ নিয়তের দরুন কেউ জান্নাতে যাবে, অসৎ নিয়তে কেউ জাহান্নামে যাবে।
● আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কাবার রুকন ও মাকামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে এক ব্যক্তির (ইমাম মাহদী) বায়আত নেয়া হবে। স্থানীয় লোকেরা-ই কাবা ঘরের সম্মান নষ্ট করে নিরাপত্তা-হীন করে তুলবে। আরবদের বিনাশ তখন ঘনিয়ে যাবে। অতঃপর হাবশিরা এসে কাবা ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলে পরবর্তীতে আর কেউ তা নির্মাণ করতে পারবে না। হাবশিরা-ই কাবার রত্ন-ভাণ্ডার লুট করবে।” (মুসনাদে আহমদ)
● আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেমন হবে যখন তোমাদের মাঝে মরিয়ম-তনয় ঈসা অবতরণ করে তোমাদের-ই একজনের পেছনে ফজরের নামায আদায় করবেন..?!!” (বুখারী)। অন্য বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, মাহদী-ই (আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ) ঈসা আ.-এর ইমামতি করবেন।
● জাবের রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমার উম্মতের একদল মুজাহিদ কেয়ামত পর্যন্ত শত্রুদের উপর বিজয়ী থাকবে। এক পর্যায়ে মরিয়ম-তনয় ঈসা আসমান হতে অবতরণ করলে তাদের সেনাপতি বলবে আসনু! নামাযের ইমামতি করুন! ঈসা বলবেন না! তোমাদের একজন অপরজনের নেতা (তুমি-ই ইমামতি করো!) আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য এ এক বিরাট সম্মান!!” (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
উল্লেখ্য,
মাহদীর পেছনে ঈসা আ. নামায পড়েছেন বলে মাহদী শ্রেষ্ঠ হয়ে যাননি। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে নবী করীম সা.-ও আবু বকরের পেছনে নামায পড়েছেন। আব্দুর রহমান বিন আওফ রা.-এর পেছনেও নবীজী নামায পড়েছেন। উম্মতে মুহাম্মদীর একজন সদস্যের পেছনে নামায আদায়ের মাধ্যমে উনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে, শেষনবী মুহাম্মদ সা.-এর আদর্শের অনুসারী হিসেবে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন।
● আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমার শেষ উম্মতের মাঝে মাহদী প্রকাশ পাবে। আল্লাহ তাদের উপর কল্যাণের বারিধারা বর্ষণ করবেন। ভূ-পৃষ্ঠ গচ্ছিত সকল খনিজ সম্পদ উন্মোচন করে দেবে। ধন সম্পদের সুসম বণ্টন নিশ্চিত করবে। গবাদিপশু বৃদ্ধি পাবে। মুসলমানদের হারানো মর্যাদা ফিরে আসবে। সাত বা আট বছর তাঁর রাজত্ব হবে।” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
● আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমি তোমাদেরকে মাহদীর সুসংবাদ দিচ্ছি। ভূ-কম্পন ও মানুষের বিভেদ-কালে তার আগমন ঘটবে। ন্যায়-নিষ্ঠায় পৃথিবী ভরে দেবে, ঠিক যেমন অন্যায়-অবিচারে ভরে গিয়েছিল।
আসমান-জমিনের অধিবাসীগণ তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। ধন সম্পদের সুসম বণ্টন নিশ্চিত করবে। ‘সুসম কি?’ জিজ্ঞেস করা হলে বললেন ‘সমানভাবে’। আল্লাহ ন্যায়ের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদীকে পূর্ণ করে দেবেন। এমনকি একজন ঘোষক ঘোষণা করবে- “কারো কি সম্পদের প্রয়োজন আছে?” একজন দাড়িয়ে বলবে- দায়িত্বশীলকে বল- মাহদী আমাকে সম্পদ দিতে বলেছে! দায়িত্বশীল বলবে- উঠাও যা পার! আঁচল ভরে স্বর্ণ-রৌপ্য উঠাতে চাইলে লজ্জিত হয়ে বলবে- আমি নিজেকে সবার চেয়ে শক্তিশালী মনে করতাম, কিন্তু আজ এগুলো বহন করতে অপারগ হয়ে গেছি। এ কথা বলে সবকিছু আবার দায়িত্বশীলকে ফিরিয়ে দিতে চাইলে দায়িত্বশীল বলবে এখানে প্রদত্ত মাল ফেরৎ নেয়া হয় না। এভাবেই মাহদীর রাজত্ব সাত, আট বা নয় বছর পর্যন্ত থাকবে। মাহদীর পর জীবনে আর কোন কল্যাণ থাকবে না।” (আল মুসনাদ)
● আলী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মাহদী আমার বংশধর। এক রাত্রিতে আল্লাহ পাক তাকে নেতৃত্বের যোগ্য বানিয়ে দেবেন।” বুঝা গেল- ইমাম মাহদী (মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ) নিজেও জানবেন না যে, হাদিসে উল্লেখিত ব্যক্তিটি তিনিই। আগেভাগে গিয়ে খিলাফতও কামনা করবেন না। নম্রতা-বসত নিজেকে তিনি নেতৃত্বের অযোগ্য মনে করবেন।
আর তাই প্রবল অনিচ্ছা সত্তেও মানুষ জোর করে তার হাতে বায়আত হয়ে যাবে। মাহদী কোন পাপী বা পথভ্রষ্ট হবেন না। বরং শরীয়ত বিষয়ে একজন সুপরিপক্ব জ্ঞানী হবেন। বিচারব্যবস্থাকে শরীয়তমতে ঢেলে সাজাবেন। শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালন করবেন।
তিনি-ই প্রতীক্ষিত মাহদী- এক রাত্রিতে আল্লাহ পাক তা জানিয়ে দিয়ে নেতৃত্বের সার্বিক যোগ্যতা তাকে প্রদান করবেন।
● উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মাহদী আমার বংশে ফাতেমার সন্তানদের মধ্যে হবে।” (আবু দাউদ)
● জাবের বিন ছামুরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা আলীকে নিয়ে আমি নবী করীম সা.এর দরবারে উপস্থিত হলাম। তিনি তখন বলছিলেন “পৃথিবী সমাপ্তির পূর্বে অবশ্যই বারোজন নিষ্ঠাবান খলীফা অতিবাহিত হবেন।
অতঃপর কি যেন বললেন- ঠিক বুঝিনি! আব্বুকে জিজ্ঞেস করলে- “সবাই কুরায়েশ বংশের” বললেন।” (মুসলিম)। ইবনে কাছীর রহ. বলেন- “বুঝা গেল- মুসলমানদের খলীফা হিসেবে বারোজন নিষ্ঠা-পূর্ণ ব্যক্তির আগমন ঘটবে। তবে শিয়া সম্প্রদায়ের ধারণা-কৃত বারোজন নয়; কারণ, তাদের অধিকাংশের-ই খেলাফত সংক্রান্ত কোন কর্তৃত্ব ছিল না। পক্ষান্তরে প্রকৃত বারোজন খলীফা সবাই কুরায়েশ বংশীয় হবেন এবং মুসলমানদের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আভিভূত হবেন।” (তাফছীরে ইবনে কাছীর)।
● উম্মুল মুমেনীন হাফসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কাবা ঘরে আশ্রিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনীর আগমন হবে। বায়দা প্রান্তরে পৌঁছা মাত্র বাহিনীর মধ্যভাগদের ধসিয়ে দেয়া হবে। সম্মুখ ভাগ ভাগের দেরকে ডাকাডাকি করতে থাকবে। পরক্ষণেই সম্পূর্ণ বাহিনীকে ধ্বসে দেয়া হবে। ফলে সংবাদ বাহক (একজন) ছাড়া আর কেউ নিস্তার পাবে না।” (মুসলিম)
প্রাণ নিয়ে ফিরে এসে মানুষকে সে ধ্বসিত বাহিনীর খবর শুনাবে।
● উম্মুল মুমেনীন উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন “জনৈক খলীফার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিরোধ সৃষ্টি হবে। মদিনার একজন লোক তখন পালিয়ে মক্কায় চলে আসবে। মক্কার লোকেরা তাকে খুঁজে বের করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুকন এবং মাক্কামে ইবরাহীমের মাঝামাঝি স্থানে বায়আত গ্রহণ করবে। বায়আতের খবর শুনে শামের দিক থেকে এক বিশাল বাহিনী প্রেরিত হবে।
মক্কা-মদিনার মাঝামাঝি বায়দা প্রান্তরে তাদেরকে মাটির নিচে ধ্বসে দেয়া হবে। বাহিনী ধ্বসের সংবাদ শুনে শাম ও ইরাকের শ্রেষ্ঠ মুসলমানগণ মক্কায় এসে রুকন ও মাক্কামে ইবরাহীমের মাঝামাঝিতে তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করবে।
অতঃপর বনু কালব সম্বন্ধীয় এক কুরায়শীর আবির্ভাব হবে। শামের দিক থেকে সে বাহিনী প্রেরণ করবে। মক্কার নব-উত্থিত মুসলিম বাহিনী তাদের উপর বিজয়ী হয়ে প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্জন করবে। সেদিন বনু কালবের সর্বনাশ ঘটবে। যে বনু কাল্ব থেকে অর্জিত সম্পদ প্রত্যক্ষ করেনি, সে-ই প্রকৃত বঞ্চিত।
অতঃপর মানুষের মাঝে তিনি সম্পদ বণ্টন করবেন। নববী আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাবেন।
ঊট যেমন প্রশান্তচিত্তে গলা বিছিয়ে আরাম পায়, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ইসলামও সেদনি ভূ-পৃষ্ঠে প্রশান্তচিত্তে স্থিরতা পাবে।
সাত বৎসর এভাবে রাজত্ব করে তিনি ইন্তেকাল করবেন, মুসলমানগণ তার জানাযায় শরীক হবে।” (আবু দাউদ) অপর বর্ণনায়- “নয় বৎসর।
বায়দা হচ্ছে মক্কা এবং মদিনার মাঝামাঝি এক বৃহৎ মরুস্থল। ত্রিশোর্ধ-জন সাহাবী থেকে মাহদী সংক্রান্ত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত হাদিস গবেষকগণ শক্তিশালী বর্ণনা-সূত্রে এগুলো বর্ণনা করেছেন। আহলে সুন্নাত সকল উলামা -মাহদী প্রকাশের বিষয়ে একমত।
■ এ যাবত ভূয়া মাহদীত্ব দাবীদারদের সংক্ষিপ্ত তালিকাঃ
ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায় কালের পরিভ্রমণ, অন্যায়-অবিচারের ছড়াছড়ি এবং জালেম বাদশাহদের আবির্ভাবের পাশাপাশি এমন কিছু ব্যক্তিরও আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, যারা নিজেকে যুগের মাহদী বলে দাবী করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। তন্মধ্যেঃ
১. শিয়া (রাফেযী) সম্প্রদায় মনে করে তাদের ও একজন মাহদী আসবে। তিনি হবেন বার ইমামের সর্বশেষ ইমাম। নাম মুহাম্মদ বিন হাসান আসকারী। হাসান রা. নয়; বরং হুসাইন রা.-এর সন্তানদের একজন হবেন। (আল্লাহ সকল আহলে বাইতের প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন)
তাদের বিশ্বাসঃ
• ২৬০ হিজরী সনে তিনি ছামারা-র ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করেছেন।
• প্রবেশ-কালে তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। অদ্যাবধি তিনি সেখানে জীবিত আছেন। শেষ জমানায় সেখান থেকে বের হয়ে তিনি মাহদীরূপে আবির্ভূত হবেন।
• তারা বিশ্বাস করে যে, তিনি শহরে-বন্দরে ঘুরে নিয়মিত মানুষের খোঁজখবর নেন। কেউ তাকে দেখতে পায় না।
কোন দলিল বা যুক্তি ছাড়াই যুগ যুগ ধরে তারা এ বিশ্বাস লালন করে আসছে। জ্ঞানী মাত্রই ভ্রান্ত এ বিশ্বাসকে চরম বোকামি বলে মেনে নেবেন। আল্লাহর শাশ্বত বিধান হচ্ছে যে, মানুষ দুনিয়াতে আসবে, নির্ধারিত জীবন পার হলে ইন্তেকাল করে বরযখে চলে যাবে। নবীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
নবী-রাসূলদেরকে আল্লাহ মৃত্যু দিয়েছেন, অথচ শিয়াদের মাহদীকে হাজার বছর ধরে ভূগর্ভস্থ কক্ষে বাঁচিয়ে রেখেছেন… এমন বিশ্বাস নিছক নির্বুদ্ধিতা বৈ কিছু নয়।
এত বছর পর্যন্ত কেন তিনি অন্ধকার কুঠিরে আত্মগোপন করবেন?! বর্তমান সময়ে উম্মতে মুহাম্মদী মহা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। চারিদিকে বিপদাপদ ভর করছে!! কেন বের হচ্ছেন না?! কেন মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন না?।
ইবনে কাছীর রহ. বলেন- “প্রকৃত মাহদী প্রাচ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন। ছামারার ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে নয়। যেমনটি রাফেযী সম্প্রদায় মনে করে থাকে। তাদের এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, অযৌক্তিক এবং শয়তানের প্ররোচনা বৈ কিছু নয়। কোরআন, হাদিস এমনকি সাহাবিদের থেকেও এ ব্যাপারে কোন বাণী প্রমাণিত হয়নি।”
২. প্রথম যুগের মহা-প্রতারক আব্দুল্লাহ বিন সাবা দাবী করেছিল যে, আলী বিন আবি তালিব রা. হচ্ছেন ইমাম মাহদী। শেষ জমানায় তিনি দুনিয়াতে আবার ফিরে আসবেন।
৩. প্রসিদ্ধ মিথ্যুক মুখতার বিন উবাইদ সাকাফী দাবী করত যে, মুহাম্মদ বিন হানাফিয়্যা (মৃত্যু-৮১ হিঃ) হচ্ছেন ইমাম মাহদী। মুহাম্মদ বিন হানাফিয়্যা হচ্ছেন আলী রা. এর পুত্র। বনী হানীফা গোত্রীয় মাতা খাওলা বিনতে জাফর এর দিকে সম্বন্ধ করে তাঁকে বিন হানাফিয়্যা বলা হত।
৪. মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বরবরী ওরফে ইবনে মরুত। ৫১৪ হিজরীতে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথমে নিজেকে হাসান বিন আলী রা.এর বংশধর বলে পরিচয় দেয়। কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল বলে মানুষকে প্রতারিত করতে সে নানান কৌশল অবলম্বন করত। ভুয়া কেরামতী দেখিয়ে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করত। একবার কিছু অনুসারীকে কবরে লুকিয়ে রেখে মানুষদের জড়ো করে সে বলতে থাকে- ওহে মৃত কবর-বাসী! আমাকে উত্তর দাও! কবর থেকে আওয়াজ ভেসে আসে -“আপনি হচ্ছেন নিষ্পাপ মাহদী.. আপনি… আপনি…”। লোকজন পরীক্ষার জন্য কবরের নিকটে গেলে মাটি ধ্বসে তার অনুসারীদের মৃত্যু হয়।
৫. আহমদ বিন আব্দুল্লাহ সুদানী (মৃত্যু-১৩০২হিঃ/১৮৮৫ইং)। সুদানে খোদাভক্ত সূফী-প্রধান হিসেবে পরিচিত ছিল। ৩৮ বৎসর বয়সে সে মাহদীত্ব দাবী করলে নেতৃস্থানীয় ও গোত্রপ্রধানরা তাকে সব ধরনের সহায়তা করে।
সে দাবী করত যে তার মাহদীত্বে অস্বীকার করল, সে আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকার করল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মোক্ষম ভূমিকা পালন করলেও ইতিহাস তাকে মাহদী বলে স্বীকৃতি দেয়নি।
৬. মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ কাহতানী। সৌদি আরবের রিয়াদে আত্মপ্রকাশ করে। স্বপ্নযোগে মাহদীত্ব পেয়েছে বলে দাবী করলে একদল লোক তার হাতে বায়আত গ্রহণ করে। ১৪০০হিঃ/১৯৮০ইং সনে মসজিদে হারামে তাকে অবরোধ করা হয়। হত্যার মধ্য দিয়ে অবরোধের সমাপ্তি ঘটে। ঘটনাটি – ফেতনায়ে হারাম নামে প্রসিদ্ধ।
■ প্রকৃত ইমাম মাহদী যাচাইয়ে করণীয়ঃ
নবী করীম সা. থেকে এ ব্যাপারে অনেকগুলো হাদিস বিশুদ্ধ বর্ণনা-সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ঝট করে মাহদীত্ব দাবী করলেই তাকে মাহদী বলে মেনে নেয়া হবে না। নবী করীম সা.-এর সাথে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি নিদর্শন জুড়ে দিয়েছেন। এ সকল নিদর্শন যথাযথ প্রমাণিত হলে বিনা দ্বিধায় তাকে আমরা ইমাম মাহদী বলে মেনে নেবঃ
১. প্রকৃত ইমাম মাহদী কখনো মাহদীত্বের দাবী করবে না। বায়আতের জন্য মানুষকে ডাকবে না। বরং মানুষ তাঁকে খুঁজে বের করে জোরপূর্বক বায়আত নেবে।
২. নবী করীম সা.-এর নামের সাথে সম্পূর্ণ মিল থাকবে (আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ)।
৩. তাঁর বংশ-সূত্র হাসান বিন আলী রা.-এর সাথে গিয়ে মিলবে।
8. হাদিসে বর্ণিত দৈহিক গুণাগুণের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে (উজ্জ্বল ললাট, সরু নাসিকা..) ।
৫. প্রকাশকালে প্রেক্ষাপট নিম্নরূপ হবেঃ
• জনৈক খলীফার মৃত্যু নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হবে।
• পাপাচার-অবিচারে ভূ-পৃষ্ঠ ভরে যাবে।
• তিন রাজপুত্র কর্তৃত্ব নিয়ে লড়াই করতে থাকবে।
• ইমাম মাহদী সৎ, নিষ্ঠাবান খোদাভীরু হবেন। শরীয়ত সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী হবেন।
• মক্কায় আত্মপ্রকাশ করবেন। রুকন এবং মাক্কামে ইবরাহীমের মাঝামাঝি স্থানে বায়আত নেবেন।
• মাহদীকে হত্যার জন্য শামের দিক থেকে বিশাল বাহিনী প্রেরিত হবে। মক্কা-মদিনার মাঝামাঝি বায়দা মরুস্থলে সম্পূর্ণ বাহিনী মাটির নিচে ধ্বসে যাবে।
নির্দিষ্ট সময়ের আগ পর্যন্ত খলিফা মাহাদী (হাফিঃ) নিজেও জানবেন না তিনি প্রতীক্ষিত মাহাদী।
হাদীসমতে- তাকে একরাতে পরিশুদ্ধ করা হবে।
তাই আজ যারা কাউকে মাহাদী দেখার সংবাদ দিচ্ছে তারা মিথ্যাচার করছে।
■ ভুয়া মাহদীদের আবির্ভাব কেন?
ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায় যে,
• নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতার লোভে কেউ কেউ মাহদীত্বের দাবী তুলেছে। যেমন, উবাইদুল্লাহ কাদ্দাহ, ইবনে তুমরূত। অথচ বর্ণিত কোন নিদর্শন তাদের মধ্যে ছিল না।
• অতি ইসলাম প্রেমিক হওয়ায় মানুষ তাকে মাহদী মনে করেছে। যেমন, মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ (পবিত্র আত্মার অধিকারী)। তাঁর অনেক অনুসারী ছিল। পরে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি মাহদী নন।
• কারো কারো ক্ষেত্রে স্বপ্ন-দর্শনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে মানুষ তাকে মাহদী মনে করতে শুরু করেছে। যেমন, মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ কাহতানী।
আর আমাদের সমাজে একটা ধারণা আছে –
মাহাদী (হাফিঃ) এসে সংশোধন করবে বরং সব হাদীস জড়ো করলে বুঝা যায় – মাহাদী (হাফিঃ) আসার আগ হতে একটা দল হক্বের পথে লড়াই করবে তারাই মাহাদীর হাতে নেতৃত্ব তুলে দিবে।
আর ইসলাম সবসময় পরিপূর্ণ, সংশোধনের প্রয়োজন নেই। মাহাদী (হাফিঃ) আসলে নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হবে, এবং মুসলিমরা বিজয় লাভ করবে। তার মানে এই প্রমান হয় না মাহাদী (হাফিঃ) সাহাবী, তাবেয়ীর পর শ্রেষ্ঠ। বরং যে কেউ কোন নেক কাজের সূচনা করলে যতলোক তাকে অনুসরণ করবে সব নেকীই সূচনাকৃত ব্যক্তিও পাবে।
সুতরাং মাহাদী (হাফিঃ) আসার আগে এরকম অনেকে আসবে যারা মাহাদীর পথ সহজ করবে। যেমন – খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর হাতে আল্লাহ বিজয় দিয়েছিলেন কিন্তু বিজয়ের পথ হামজা (রাঃ) সহ প্রথমদিকের সাহাবীরা করেছিলেন তাই প্রথমদিকের সাহাবীদের মর্যাদা শ্রেষ্ঠ। এটা আল্লাহর সিদ্ধান্তঃ কার হাতে শাসন বা বিজয় দিবে।
ঠিক তেমনি যত মানুষ রসুল (সাঃ) কে অনুসরণ করবে সকল নেকী রসুল (সাঃ) পাবেন কারণ এই উম্মতের দ্বীনের সূচনা তিনি করেছেন। আর ঈসা (আঃ) যদিও বিশ্বপরিচালনা করবেন রসুলের (সাঃ) সুন্নাহ মেনে করবেন, তাই সকল নেকী রসুলও (সাঃ) পাবেন।
এই হতে প্রমাণিত হয় রসুল (সাঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ, সুতরাং খ্রিস্টানসহ যারা ভাবছে মসীহ বা ঈসা (আঃ) শ্রেষ্ঠ হবে বিশ্বশাসন করবে বলে তারা বিভ্রান্তিতে আছে।