আমাদের দেশে একটা কথা বহুল প্রচলিত, ‘ব্যবহার বংশের পরিচয়!’ এর ভিত্তি দূর্বল, যুক্তিহীন!! ইসলামে প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা নির্ভর করে তার তাকওয়া ও আমলের কারণে। আর বিচার দিবসে প্রত্যেকে তার কৃর্তকর্মের ফল ভোগ করবে।
আদমের (আ:) এক সন্তান ছিলেন তাকওয়াপূর্ণ আর আরেকজন ছিল হত্যাকারী, তাদের আচরনগত ভিন্নতা লক্ষনীয়!! ইব্রাহিমের (আ:) পিতা ছিল মুশরিক আর ইব্রাহিম (আ:) মুসলিম জাতির পিতা, তেমনি রসুলের (সা:) চাচা হামজা (রা:) হলেন শহীদদের সর্দার, তার ব্যাপারে হাদীসে সুসংবাদ জানানো হয়েছে। অপরদিকে আবু লাহাবকে অভিশাপ দিয়ে সুরা নাযিল হয়। আর আহলে বায়াতকে ভালোবাসার কারণ শুধু বংশ পরিচয় নয় বরং তারা দ্বীনের পথে সব সময় অটল থাকবে।
গাদিরে খুমের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন: ‘আমি তোমাদের জন্য অতি মূল্যবান দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি, একটি আল্লাহর কিতাব, অপরটি হচ্ছে আমার রক্তসম্পর্কীয় নিকট স্বজন “আহলে বাইত”। তোমরা যদি এ দুটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো, তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পোষ্য উমার ইবনু আবী সালামাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, উম্মু সালামাহ্ (রাযিঃ)-এর ঘরে এ আয়াত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ হয় (অনুবাদ) “হে নাবীর পরিবার। আল্লাহ তা’আলা তো চান তোমাদের হতে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে পবিত্র করতে”– (সূরা আহযাব ৩৩)। সে সময় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমাহ, হাসান ও হুসাইন (রাযিঃ)-কে ডাকেন এবং তাদেরকে একখানা চাদরে আবৃত করেন। তার পেছনে আলী (রাযিঃ) ছিলেন। তিনি তাকেও চাদরে ঢেকে নেন, তারপর বললেনঃ “হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত। অতএব তুমি তাদের হতে অপবিত্রতা অপসারণ করে দাও এবং তাদেরকে উত্তমভাবে পবিত্র কর”। সে সময় উম্মু সালামাহ্ (রাযিঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত কি? তিনি বললেনঃ তুমি স্বস্থানে আছ এবং তুমি কল্যাণের মাঝেই আছ। (তিরমিজি)
সাহাবীদের জীবনী লক্ষ্য করলে দেখা যায়- কারো পিতা, পুত্র, ভাই শত্রু শিবিরের পক্ষ হয়ে লড়াই করতে এসেছিল কিন্তু তারা দ্বীনের পথে অটল থেকে জেহাদ চালিয়ে যান।
আল্লাহ বলেন –
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পিতৃবর্গ ও ভাতৃবৃন্দ যদি ঈমানের মুকাবিলায় কুফরীকে পছন্দ করে, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই যালিম।
সুরা তওবা -২৩
বনী ইসরায়েল হতে সবচেয়ে বেশি নবী, রসুল এসেছিল আর সবচেয়ে বেশি নবীদের হত্যা ও বিরোধীতা তারাই করেছে। যেমনি বনী ইসরায়েলের নবীগনের প্রশংসা করে কুরআনের আয়াত এসেছে তেমনি বনী ইসরায়েলের কুফরী প্রকাশ করা হয়েছে কুরআনে।
আমরা যখন কারবালার, জঙ্গে জামালের আলোচনা করতে গিয়ে বনু উমাইয়াসহ মুনাফেকদের সমালোচনা করি তখন অপবাদ দেওয়া হয় আমরা সাহাবীদের সমালোচনাকারী। অথচ আমাদের ঘৃনা ব্যক্তির কৃতকর্মের উপর কোন নির্দিষ্ট বংশ বা নামের উপর নয়। আজ এমন একজন সাহাবীর জীবনী আলোচনা করবো যিনি বনু উমাইয়াদের মধ্যে অন্যতম সম্মানিত, উত্তম মুজাহিদ। অথচ তার আলোচনা আলমদের মুখ হতে শুনবেন না, কিন্তু একই নামে আরেকজন জালেমকে বাচাতে তার মিথ্যা ফজিলত বর্ননা করে।
ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা:) ছিলেন আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের পুত্র, প্রথম মুয়াবিয়ার (রা:) ভাই। ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া আর ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা:) এক ব্যক্তি নন।
৬৩৪ সালে খলিফা আবু বকর কর্তৃক রোমান সিরিয়া জয় করার জন্য যে চারজন সেনাপতিকে প্রেরণ করা হয়েছিল ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান তাদের অন্যতম। দামেস্ক জয়ের পর তিনি দামেস্কের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীর বাম ভাগের নেতৃত্ব দেন। ৬৩৯ সালে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর মৃত্যুর পর মুয়াজ ইবনে জাবাল সিরিয়ার গভর্নর হন। মুয়াজও প্লেগে মারা যান। এরপর খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব ইয়াজিদকে সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনিও ৬৪০ সালে প্লেগে মৃত্যুবরণ (শাহাদাত বরন) করেন।
আর তার মৃত্যুর পর উমর (রাঃ) মুয়াবিয়াকে (রা:) সিরিয়ার গর্ভনর করেন। মূলত আবু সুফিয়ানের বংশের মর্যাদা ও পদলাভের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় তার অবদানে অথচ আলেমরা তার নামই মুখে আনে না কিন্তু ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার মিথ্যা ফজিলত বর্ননা করে জালেমকে সম্মানিত করার চেষ্টা করে।
ইসলামের ভালোবাসা ও শত্রুতার ভিত্তি শুধুমাত্র বংশ, দেশ, জাতির উপর নির্ভর করে নয় বরং মুমিনদের ভালোবাসা ও শত্রুতা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য।
একদিকে বনু উমাইয়া (মারওয়ান) আলীর (রা:) উপর অভিশাপ, গালি চালু করেছিল তেমনি উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ:) তা বন্ধ করেছিল। তিনিও বনু উমাইয়ার ছিলেন। তাকে ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ মানা হয়।
তাই বনু উমাইয়াদের জালেম, মুনাফেক যারা আহলে বায়াতসহ সাহাবীদের উপর জুলুম করেছিল তাদের ঘৃণা করি অপরদিকে যারা ইসলামের জন্য অবদান রেখেছে আল্লাহর জন্য তাদের ভালোবাসি।
উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদীসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কারো সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে শুধু আল্লাহর জন্য, শক্রতা রেখেছে শুধু আল্লাহর জন্য, অর্থ ব্যয় করে আল্লাহর জন্য এবং অর্থ ব্যয় থেকে বিরত রয়েছে আল্লাহর জন্য, সে নিজের ঈমানকে পরিপূর্ণ করেছে। [আবু দাউদ: ৪৬৮১; অনুরূপ তিরমিযী: ২৫২১]
হাদীসের এ বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসাকে অপরাপর ভালবাসার উর্ধ্বে স্থান দেয়া এবং শক্ৰতা ও মিত্রতায় আল্লাহ ও তার রাসূলের হুকুমের অনুগত থাকা পূর্ণতর ঈমান লাভের পূর্বশর্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত ও শরীআতের হেফাযত এবং এতে ছিদ্র সৃষ্টিকারী লোকদের প্রতিরোধ আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালবাসার স্পষ্ট প্রমাণ।