উসমানীয় সাম্রাজ্য তখন দুর্বল হয়ে আসছিল। রাশিয়ার জার সরকারের ইচ্ছে হল উসমানীয় সাম্রাজ্য দখল করা আর তা সফল হলে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করবে। কারণ তুরস্ক ও ভারত তখন সমৃদ্ধ ছিল। তাদের পথে বাঁধা হয়ে দাড়ান এক মুসলিম মহানায়ক ঈমাম শামিল (রহঃ)।
দাস্তেগান ও কাকেশাসের মহান বীর, শেরে দাস্তেগান ইমাম শামিল (রহঃ) প্রায় অর্ধশতাব্দি যাবৎ নাকানি চুবানি খাইয়েছিলেন প্রতাপশালী রুশীয় জার শাহীদের। এই মহান বীর ১৭৯৭ সালের ২৬শে জুন দাস্তেগানের গমরি নামক এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যা বর্তমানে রাশিয়ার অন্তর্গত। ছোটকালে তার নাম ছিল আলি। তবে স্থানীয় রীতি অনুসারে তার পিতার উপাধি ‘শামিল’ তিনি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি এই নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি ছিলেন বিখ্যাত নকশবন্দিয়া তরিকার একজন সাহেবে নিসবত বুযুর্গ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী রুশ শাহীর ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের মুখে তিনি তাঁর মুরিদদের নিয়ে এক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যা প্রায় দীর্ঘ পঁচিশ বছর জার শাহির উসমানিয়াবিরোধী অগ্রাভিযানের সামনে বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
সময়টা ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি ও প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার যুগ। ফলে ইউরোপের এই ‘রুগ্ণ মানবের’ উত্তরাধিকারে ভাগ বসানোর জন্য ইউরোপিয় শক্তিবর্গ ও জারশাহী ছিল উদগ্রীব। কিন্তু তুর্কিদের আক্রমণ করতে হলে কাকেশাস দাস্তেগান ও চেচেনকে পদানত করা জরুরী। তাই তৎকালীন জার কাকেশাসের দিকে মনোযোগী হন। আর জার শাহীর এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম জিহাদের ডাক দেন দাস্তেগানের প্রথম ইমাম এরাগল খানকার শায়খ ও মুরশিদের শিষ্য গাজি মোহাম্মদ (রহঃ)।
তিনি ১৮২০ সালে এই জিহাদের ডাক দেন। শতধাবিভক্ত গোত্রগুলোকে তিনি ঐক্যের আহ্বান জানাতে থাকেন। তিনি ছিলেন ইমাম শামিলের বাল্যবন্ধু। অবশেষে ১৮৩২ সালে – যখন এই ভারতবর্ষে আল্লাহপাগল কিছু বান্দা বালাকোটের ময়দানে মাওলাপ্রেমের মহাকাব্য রচনা করছিল- ২৯ অক্টবর গমরির লড়াইয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তারপর নেতৃত্বে আসেন হামজা বেগ নামে তারই এক অনুসারী। কিন্তু দুবছর যেতে না যেতেই খোনজাকের এক লোকের হাতে তিনি নিহত হন। তখন সকল গোত্রপ্রধানের সম্মতিক্রমে ইমাম নিযুক্ত হন ইমাম শামিল (রহঃ)।
আধুনিক তোপকামান আর গোলাবারুদে সজ্জিত রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তার অস্ত্র ছিল আল্লাহর প্রতি অবিচন আস্থা ও বিশ্বাস। যৎসামান্য তীর তলোয়ার খঞ্জর আর দূর্গম গিরি কন্দর ও ঘন বনজঙ্গলকে অবলম্বন করে তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর এই অসম লড়াই চালাতে থাকেন। সমকালীন ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত বিরল। ইমাম শামিলের বিরুদ্ধে লড়াই পসঙ্গে প্রখ্যাত রুশ ঐতিহাসিক জেনারেল কাদিউফ লিখেছেন: কাকেশাস অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ে আমাদের এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিহত হয় যে ভারতবর্ষ থেকে জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জয় করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল।
১৮৪৪ এর পর থেকে রুশীয়রা তাদের যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন আনে। সাফল্যকে স্থায়ী করার জন্য তারা বিজিত অঞ্চলগুলোর বনজঙ্গল সাফ করতে থাকে ও ডিনামাইট ব্যাবহার করে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে রাস্তা তৈরি করতে থাকে। পাশাপাশি অর্থসম্পদ ও পদ-পদবির লোভে ফেলে বিভিন্ন অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিজেদের দিকে ভেড়াতে থাকে। এরপরও তিনি দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যান।
অবশেষে ১৮৫৯ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর গমরির লড়াইয়ে তিনি জারশাহীর বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যান। জার শাহী তাকে আত্মসমর্পণে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু তিনি সম্মত না থাকায় একটি শান্তি সাক্ষরিত হয়। আসলে তাকে হত্যা করে জার নতুন করে কোন বিদ্রোহের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিল না। তারপর তিনি মস্কোয় যান। সেখানে দীর্ঘদিন তাকে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। তারপর তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনায় গমন করেন। সেখানেই ২৫ জিলকদ ১২৪৭ হিঃ মোতাবেক ১৮৭১ সালের ৪ই ফেব্রুয়ারি কাকেশাসের এই মহানায়ক শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে জান্নাতুল বাকিতে সমাহিত করা হয়। আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন।
এমনিই ছিলো দ্বিশতক আগের বুজুর্গ ও তার অনুসারীদের ঈমানদীপ্ত জীবনী। কিন্তু বর্তমানে অনেক বুজুর্গরাই বিদআত, কুফর ও জেহাদের অপব্যাখা করে চলছে।