বিপদে বন্ধুর পরিচয় কথাটা সত্যি। যে যাকে বন্ধু মনে করে বিপদে তার প্রতি ভরসা ও বিশ্বাস রাখে। বহুলোক বিশ্বাস ও ভরসা রাখে তার পরিচিত স্বজন, তথাকথিত বন্ধুর উপর যদিও তাদের চরিত্র ইসলামের বিপরীত। যখন বিপদে তাদের হতে সাহায্য, সাড়া পায় না তখন বলে উঠে বিপদে বন্ধু চেনা যায়।অথচ মুমিনের বন্ধু ও ভরসা হল আল্লাহ তাই জীবনে যাই ঘটুক হতাশ হয় না যাই ঘটুক আল্লাহ রক্ষা করবেন না হয় এই বিপদ, দুঃখ, কষ্ট জান্নাতের সম্মান বৃদ্ধির কারণ হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার ওলির সঙ্গে শত্রুতা করে, আমি তাকে আমার সঙ্গে যুদ্ধের আহ্বান করি। আমি বান্দার ওপর যা ফরজ করেছি, তা অপেক্ষা আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো বস্তু নেই, যা দ্বারা আমার বান্দা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে। আর বান্দা নফল ইবাদতের দ্বারা আমার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতে থাকে, এক পর্যায়ে আমি আল্লাহ স্বয়ং তাকে ভালাবাসতে শুরু করি। যখন আমি তাকে ভালাবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে। তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে হাঁটে। সে যদি কিছু চায় আমি তা অবশ্যই দান করি, যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দান করি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫০২)। হাদিস বিশারদরা বলেন, আল্লাহ ও রসুলের ভালোবাসা ঈমানের অংশ। সুতরাং তা মুমিনের ওপর ওয়াজিব। কোরআন ও হাদিসের একাধিক বর্ণনা দ্বারা তা প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের বন্ধু আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও ঈমানদারগণ; যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং বিনম্র; আর যারা আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও বিশ্বাসীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই আল্লাহর দল, তারাই বিজয়ী।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৫৫-৫৬)। আল্লাহর বন্ধুদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের জাগতিক জীবনের বন্ধুত্ব ও দূরত্বের ভিত্তিও হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা। আল্লাহর বন্ধুগণ ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ ও অভিমানের চেয়ে আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.) ও ইসলাম বড় করে দেখে। ফলে হাদিসের ভাষায় তাদের বন্ধুত্ব ও শত্রুতা উভয়টিই আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমার ও তোমাদের শত্রুদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো না।’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ১)। মুসলিমদের বিপদ দেখলে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় মুনাফেক আর মুমিন নিজ জীবন, স্বজনের চেয়েও আল্লাহ ও তার রসুলকে ভালোবাসেন। উহুদ যুদ্ধে বহু সাহাবী শহীদ হন স্বয়ং রসুলুল্লাহ (সাঃ) রক্তাক্ত হন। বানূ দীনার গোত্রের এক মহিলার স্বামী, ভাই ও পিতা শহীদ হন। মহিলার কাছে এই সংবাদ পৌছলে তিনি শুধু বলেছিলেন- রসুলুল্লাহ’(সা) কেমন আছেন। লোকজন বলল, হে অমুকের মা! আপনি যেমন কামনা করেছেন আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভালো আছেন। মহিলাটি বললেন- তাকে একটু দেখান, আমি তাকে এক নজর দেখে নিই!! রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি ইশারা করে তাকে দেখানো হল। রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখে তিনি বলে উঠলেন, “ইয়া রসুলুল্লাহ আপনাকে সুস্থ দেখার পর সকল বিপদ আমার নিকট তুচ্ছ।” পক্ষান্তরে মুসলিমরা যখন উহুদ যুদ্ধের শহীদের জন্য কান্নাকাটি ও শোক প্রকাশ করছিল তখন মুনাফেকরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মুসলিমদের মাঝে দুঃখ, হতাশা ছড়িয়ে রসুল (সাঃ) হতে তাদের বিছিন্ন করতে। সাথে কিছু ইয়াহুদীরা প্রচার করে- মুহাম্মাদ যদি সত্য নবী হতেন শত্রুপক্ষ তার উপর জয়ী হতে পারতেন না। তিনি এভাবে যখমপ্রাপ্ত ও বিপদগ্রস্ত হতেন না। বরং তিনি ক্ষমতালোভী, সকল ক্ষমতা করায়ত্ব করাই তার উদ্দেশ্য। মুনাফেকরা প্রচার করছিল তোমরা যদি আমাদের মত অনুসরন করে যুদ্ধ না করে ফিরে আসতে তাহলে এরকম বিপদের সম্মুখীন হতে না। তখন আল্লাহ কুরআনের আয়াত নাযিল করে মুমিনদের সান্তনা দেন। আল্লাহ বলেন -“”তোমরা নিরাশ বা মন ভাঙ্গা হয়ো না, দুঃখিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।” (৩:১৩৯)। ওহুদ যুদ্ধে পরাজিত হবার পর মুসলমানরা হীনবল ও হতাশ হয়ে পড়ে। এই আয়াতে আল্লাহ মুসলমানদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, পরাজিত হলে কখনোই হতাশ হওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে যখন তোমরা তোমাদের অধিনায়কের আদেশ অমান্য করায় যুদ্ধে পরাজিত হয়েছ বরং তোমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করা উচিত। কারণ, ঈমানের ওপরই চূড়ান্ত বিজয় নির্ভর করছে। আগের আয়াতে অতীতের ইতিহাসে রবের নীতির কথা উল্লেখ করার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে কোন জাতির সম্মান বিজয় ও মর্যাদার একমাত্র চালিকাশক্তি হলো, আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান এবং আল্লাহ ও তাঁর নবীগণের নির্দেশ অমান্য করার মধ্যেই রয়েছে জাতিগুলোর লাঞ্ছনা ও পরাজয়। মুসলমানরা ওহুদ যুদ্ধের সময় আল্লাহর এ নীতি প্রত্যক্ষ করেছে। এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত: আল্লাহর প্রতি ঈমান শুধু কেয়ামতের দিনই সম্মানের কারণ হবে না, ইহকালেও অন্যান্য জাতির ওপর বিজয় ও শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যম এই ঈমান।
দ্বিতীয়ত : পরাজয়ের ফলে হতাশ ও পিছু হটা উচিত নয়। পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করতে হবে। সূরা আলে ইমরানের ১৪০ ও ১৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ (১৪০) وَلِيُمَحِّصَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ (১৪১)
“হে মুসলমানগণ! যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তবে অনুরূপ আঘাত ওদেরও লেগেছে। আমি মানুষের মধ্যে পর্যায়ক্রমে জয় ও পরাজয়ের এই দিনগুলোর আবর্তন ঘটাই যাতে স্পষ্ট হয় কারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে এবং তোমাদের মধ্য থেকে যেন সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায়। আর আল্লাহ অত্যাচারীদের ভালবাসেন না।” (৩:১৪০)। “যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ এভাবে তাদেরকে পবিত্র করেন এবং অবিশ্বাসীদের ক্রমেই ধ্বংস করেন।” (৩:১৪১)।
এই দুই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর আরো একটি বিধান বা রীতির কথা উল্লেখ করে বলছেন, মানুষের অবস্থা সব সময় ভালো বা খারাপ থাকে না। বরং মানুষের অবস্থা পরিবর্তনশীল। সাফল্যের পর আসে তিক্ততা, জয়ের পর পরাজয়। উত্থান ও পতনের বিধান দেয়ার কারণ হলো, এর মাধ্যমেই মানব চরিত্রের উজ্জ্বল দিকগুলো ফুটে ওঠে এবং কারা প্রকৃত মুমিন ও কারা মোনাফেক তা বোঝা যায়। অপবিত্রদের মধ্য থেকে পবিত্ররা এভাবে আলাদা বা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেন। এ থেকে অন্যরা বুঝতে পারে যে পবিত্র অবস্থায় বেঁচে থাকা ও মৃত্যুবরণ করা সম্ভব।
মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে আরো বলছেন, তোমরা এখন ওহুদ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছ কিন্তু এর আগে বদর যুদ্ধে তোমরাই বিজয়ী হয়েছিলে। ওহুদ যুদ্ধে তোমাদের মধ্যে যেমন অনেকেই আঘাত পেয়েছে, তেমনি তোমাদের অনেক শত্রুও আহত হয়েছে। তাই প্রথমত: এ যুদ্ধ শুধু তোমাদের জন্যেই তিক্ত নয়। আর দ্বিতীয়ত হলো: তিক্ত ও আনন্দময় ঘটনা স্থায়ী কিছু নয়। ধৈর্য্যশীল হলে শেষ পর্যন্ত তোমরাই জয়ী হবে এবং কাফেরদের পতন ও ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো, প্রথমত: যুদ্ধের মত বিভিন্ন দুর্যোগ ও বিপদের মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষা করা আল্লাহর অন্যতম স্থায়ী নীতি। দ্বিতীয়ত: কাফেরদের বিজয়ের অর্থ এই নয় যে আল্লাহ তাদের ভালবাসেন। খোদায়ী পরীক্ষার জন্যেই কখনো কখনো কাফেরদের বিজয় ঘটে। তৃতীয়ত: যুদ্ধ পবিত্র ও ঈমানদার মানুষকে চেনার এক ভাল মানদণ্ড। মুমিনরা যুদ্ধের ময়দানে কখনো পরাজিত হন না। কারণ, তাদের জন্য শাহাদতও এক ধরনের বিজয়। সূরা আলে ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ (১৪২)
“তোমরা কি মনে করেছ ঈমান আনার দাবি করলেই তোমাদেরকে বেহেশতে যেতে দেয়া হবে? অথচ আল্লাহ এখনও এটা দেখেন নি যে, তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদে যোগ দিয়েছে এবং কারা ধৈর্যশীল?”(৩:১৪২)।
আজও বিশ্ব মিডিয়া ও মুনাফেকগুলো মুসলিমদের উপর নির্যাতন, মসজিদ ও ইসলামের উপর আঘাত, মুজাহিদদের পরাজয় দেখে প্রচার করে ইসলাম ও মুসলিম, মুজাহিদরা যদি হকপন্থী হতো তাদের এই দুর্গতি হতো না বরং এটা তাদের পাপের পরিণতি, এটা তাদের উপর আযাব। অথচ মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় অপরাধ শিরক কিন্তু মুশরিকদের উপর বিপদ দেখলে আযাব না বলে মিছে মায়াকান্না দেখায়। উহুদ যুদ্ধে কিছু সাহাবীর ভূলে রসূল (সাঃ) রক্তাক্ত হন ও সাহাবীরা শহীদ হন। মুসলিমের জীবনে বিপদ, দুঃখ, অভাব সাময়িক আর তার জন্য অপেক্ষা করছে চিরস্থায়ী প্রশান্তিময় জান্নাত।