বিদ্রোহ দমনে দাওয়াতের ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বে প্রায় একদল আলেম আরেকদল বা তাদের মতাদর্শের বিপরীত হলে খারেজী ঘোষণা করে। এমনকি মাসয়ালা নিয়ে তর্ক জড়িয়ে আলেমগণ এরূপ করে।

এই নিয়ে পূর্বে আলোচনা আছে।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন: “যখন আল-হারুরিয়া বেরিয়ে এলো, তারা একটি ঘরে অবসর নিয়েছিল এবং তারা সংখ্যায় ছয় হাজার ছিল সুতরাং আমি আলীকে বলেছিলাম: হে আমীরুল মুমিনীন, তাপমাত্রা কমে যাওয়া পর্যন্ত সলাত বিলম্বিত কর, যাতে আমি তাদের সাথে কথা বলতে পারি।
আলী ইবনু আবী তালিব (রা) বললেনঃ আমি আশঙ্কা করছি যে তারা আপনার ক্ষতি করে দিতে পারে। আমি বললামঃ কখনো না! কোনও সম্ভাবনাই নেই। কাজেই, আমি একটি সুন্দর জামা পরিধান করলাম, চুল আঁচড়ালাম, এবং মধ্যাহ্নে তাদের কাছে উপস্থিত হলাম যখন তারা খাচ্ছিল।
তারা বলল, “স্বাগতম! হে ইবনে আব্বাস! কি মনে করে এখানে এলেন?” আমি তাদের বলেছি: “আমি তোমাদের কাছে নবীর সাহাবীদের পক্ষ থেকে এসেছি, (সলাত ও শান্তি তাঁর উপর, অভিবাসীদের সমর্থকদের) এবং নবীর চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে ও তাঁর জামাইয়ের পক্ষ থেকে। তাদের উপর কুরআন নাজিল হয়েছিল।
কাজেই, তোমাদের ভেতর এমন কেউ নেই যে তাঁদের চেয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে। আমি তোমাদের কাছে তা-ই বলব, যা তাঁরা বলেছেন, আর তাঁদের কাছে তা-ই বলব, যা তোমরা বল।”
এরপর তাদের অনেকে এসে আমার পাশে বসল।
আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম: আপনারা আল্লাহর রসূলের সাহাবী ও তাঁর চাচাত ভাইয়ের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ পোষণ করছেন, তা কোন দলীলের ভিত্তিতে? তারা বলল: “তিনটি দলীলের ভিত্তিতে”।
আমি বললাম; এগুলি কি?
তাদের একজন বলেছিলেন: “প্রথম কারণ হল, “আলী বিচারকের ভূমিকায় নিয়েছেন, অথচ বিচারের মালিক আল্লাহ্ নিজে, কেননা আল্লাহ্ বলেনঃ “বিচারের হক তো কেবল আল্লাহরই (আনআম ৬:৫৭)। মানুষের আবার বিচারের সাথে লেন-দেন কিসের?” আমি বললামঃ এটি তাহলে একটি অভিযোগ।
তারা বললঃ দ্বিতীয় কারণ হল, সে লড়াই করেছে, কিন্তু সে বন্দী করেনি এবং গনীমতও ভোগ করতে পারেনি। যদি তারা কাফের হয়, তবে তাদের বন্দী করা তো বৈধ আর যদি তারা ঈমানদার হয় তবে তাদের সাথে লড়াই করা তো প্রথমেই জায়েয ছিল না।

আমি বললামঃ দু’টি অভিযোগ গেল, তৃতীয়টি কী? তারা বললঃ তিনি ঈমানদারদের ‘সেনাপতি’ শব্দটি থেকে নিজের নাম থেকে মুছে ফেলে দিয়েছিলেন।

যদি সে ঈমানদারদের সেনাপতি না হয় তবে সে কি অবিশ্বাসীদের সর্বাধিনায়ক? “আমি বললামঃ এর বাইরেও আপনার কি কিছু আছে? তারা বলল: “না! এই তিনটিই যথেষ্ট”। আমি বললামঃ আমি যদি আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর রসূলের সুন্নাহ থেকে পড়ে শোনাই এবং তোমাদের অভিযোগসমূহের খন্ডন করি, তোমরা কি মেনে নেবে? তারা বলেছিল: “হ্যাঁ! অবশ্যই”।

আমি বললাম: তোমরা অভিযোগ করছ আলীর বিরুদ্ধে যে তিনি মানুষ হয়েও বিচারকার্য করছেন, অথচ তা আল্লাহর কাজ। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব থেকে দেখাব, যেখানে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা মানুষের ওপর ১/৪ দিরহামের মূল্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
তোমরা কি আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলার এই আয়াত দেখনি? : “হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহরাম বাধা অবস্থায় শিকার কর না। তোমাদের ভেতর যারা এই কাজ জেনে-শুনে করবে, তার বিনিময় হবে ঐ জন্তুর অনুরূপ, যা সে বধ করেছে। দুজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি তার বিচার করবে [সুরা মায়েদা ৫:৯৫]।
লক্ষ্য করে দেখো, মহান আল্লাহ্ এই সামান্য ও ছোট্ট একটি বিচারের যথাযথ সমাধানের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার বান্দাদের ওপর বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করলেন।
আমি আল্লাহর নামে তোমাদের জিজ্ঞাসা করছিঃ মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের মীমাংসা, শান্তির উদ্দেশ্যে রক্তপাত বন্ধ করা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি খরগোশ হত্যার মামলা অধিক গুরুত্বপূর্ণ? তারা জবাব দিলঃ “কেন নয়! এটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ”।
“মহান আল্লাহ্ স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে বলেনঃ যদি তোমরা দুইয়ের মাঝে ফাটলের আশংকা কর, তাহলে তাঁর (স্বামী) পক্ষ থেকে একজন বিচারক ও তার (স্ত্রী) পক্ষ থেকে একজন বিচারক নিযুক্ত কর। [ সুরা নিসা ৪:৩৫]।
আমি আল্লাহর নামে তোমাদের জিজ্ঞাসা করছিঃ মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের মীমাংসা, শান্তির উদ্দেশ্যে রক্তপাত বন্ধ করা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক মামলা অধিক গুরুত্বপূর্ণ?”
তারা জবাব দিলঃ “ঠিক আছে”।

অতঃপর, আমি বললামঃ তোমরা অভিযোগ করছ তিনি যুদ্ধ করেছেন অথচ বন্দী এবং গণিমতের মাল গ্রহণ করেন নি। তোমরাই বল, তোমরা কি তোমাদের মা, মুমিন জাতির মা “আইশাহ (রা) কে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নেবে?
যদি তোমাদের জবাব হ্যাঁ হয়, তাহলে তোমরা অন্য নারীদের মতই তাঁকে হালাল করে নিলে। সেক্ষেত্রে তোমরা কুফর করে ফেললে।
আর, যদি তোমরা বল যে তিনি তোমাদের মা নন, তাহলেও তোমরা কুফর করলে, কেননা মহান আল্লাহ্ বলেনঃ “নবী মুমিনদের নিকট তাঁদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক অন্তরঙ্গ এবং নবীদের স্ত্রীগণ তাদের মা [আহযাব ৩৩:৬)।
সুতরাং, তোমরা দুইটি বিভ্রান্তি গ্রহণ করেছ। এই বিভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসো। তোমরা কি দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব পেয়েছো? তারা জবাব দিলঃ হ্যাঁ।

তখন আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ তোমরা অভিযোগ করছ তিনি ‘আমীরুল মুমিনীন’ শব্দটি মুছে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে আমিই তোমাদের জবাব দেব, যা তোমাদের মন শান্ত করবে। খেয়াল কর! আল্লাহর রসূল (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদাইবিয়ার সন্ধিতে ‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ লিখান।
কাফেররা প্রশ্ন তোলে যে আমাদের যুদ্ধের কারণই হল যে আমরা আপনাকে রসূল মানি না।
তাই তিনি আলীকে বললেন, হে “আলী! লেখঃ “মুহাম্মাদ বিন আব্দিল্লাহ” আল্লাহর কসম! আল্লাহর রসূল (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আলীর চেয়ে অনেক উত্তম এবং তিনি তাঁর নাম থেকে ‘আল্লাহর রসূল’ মুছিয়ে দিয়েছিলেন। এই মুছে দেয়ার কারণে তাঁর রিসালাত মুছে যায় নি।
তোমরা কি তৃতীয় প্রশ্নের জবাব পেয়েছ? তারা জবাব দিলঃ হ্যাঁ।

এরপর, তাদের ভেতর ২০০০ জন তৎক্ষণাৎ প্রত্যাবর্তন করে, আর বাকি ৪০০০ খারিজী তাদের পথভ্রষ্টতার কারণে মুহাজিরীন ও আনসারদের দ্বারা হত্যা হয়েছিল। [সুনানুন নাসাঈ আল কুবরাঃ ৮৫৭৫ (৮৫২২), শায়খ গোলাম মোস্তফা জহীর বাহায়েছে আলী তে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]

সাহাবিদের যুগের খারেজী ফেতনা ছিল ভয়াবহ। তারা স্বয়ং আলী (রাঃ) সহ সাহাবিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।

খারেজীদের বৈশিষ্ট্য ছিল এই – তারা কুরআন, সুন্নাহর ভুল ব্যাখা করে কুরআন দ্বারা শাসনকৃত শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতো। কিন্তু যারা কুরআনের বিপরীত শাসন করে তাদেরকে কুরআনের দিকে আহ্বান করলেই একশ্রেণির আলেম আছে খারেজী ঘোষণা করে।

আর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) খারেজীদের দাওয়াত দেন যাতে ইসলামে ফিরে আসে অথচ বর্তমানে পরস্পর আলোচনা না করে একে অপরকে খারেজী ঘোষণা দিয়ে উম্মাহকে বিভ্রান্ত করে চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *