সুন্নী, শিয়া বিরোধিতায় উম্মত মুসলিম পরিচয় যেন ভুলে গেছে। বর্তমানে অনেকে ইহুদি, খ্রিস্টান ও নাস্তিকদের নিয়ে আলোচনা ও দাওয়াহ দিচ্ছে অথচ শিয়া, সুন্নীদের মধ্যে বিদ্যমান সুস্পষ্টভাবে ভুল ধারণা নিয়ে খুব কম আলেমই সঠিক বক্তব্য রাখছে। ইনশাআল্লাহ আমরা চেষ্টা করবো সত্যগুলো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য।
বাগে ফাদাক নিয়ে শিয়ারা আবু বকর (রা:), উমর (রা:) সহ সাহাবীদের নিয়ে অপবাদ ও বিদ্বেষ পোষন করে। অপরদিকে সুন্নীদের অনেকে ফাতেমাকে (রা:) দোষী দাবি করে নাউজুবিল্লাহ।
আসুন জেনে নিই বাগে ফাদাক কি?
ফাদাক এর খেজুর বাগান রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ‘খাছ’ হিসাবে বণ্টিত হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন প্রথম খায়বরে উপস্থিত হন, তখন তিনি ফাদাকের ইহূদীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য মুহাইয়েছাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)-কে পাঠান। কিন্তু তারা বিলম্ব করে। অতঃপর যখন খায়বর বিজয় হ’ল, তখন তারা ভীত হয়ে পড়ল এবং রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে দূত পাঠালো এই মর্মে যে, খায়বরবাসীদের সঙ্গে ফসলের অর্ধাংশ দেবার শর্তে যেরূপ সন্ধি করা হয়েছে, তারাও অনুরূপ সন্ধিতে আগ্রহী। তাদের এ প্রস্তাব কবুল করা হয় এবং ফাদাকের ভূমি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। কেননা এই ভূমি জয় করতে কোনরূপ যুদ্ধের প্রয়োজন হয়নি।
এই ফাদাকের খেজুর বাগানের উত্তরাধিকার প্রশ্নেই রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে খলীফা আবু বকরের সঙ্গে হযরত ফাতেমা ও আলী (রাঃ)-এর বিরোধ হয়। হাদীছটি ছিল, ‘আমরা নবীরা আমাদের সম্পদের উত্তরাধিকারী কেউ হয় না। যা কিছু আমরা ছেড়ে যাই, সবই ছাদাক্বা হয়ে যায়’।তিনি বলেন,নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম রেখে যান না। তাঁরা রেখে যান কেবল ইল্ম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’। বলা বাহুল্য যে, শিয়ারা এখনো উক্ত ফাদাকের সম্পত্তির দাবীতে অটল। তারা খলীফা আবু বকর ও ওমর (রাঃ)-কে দায়ী করে থাকে। অথচ পরে আলী (রাঃ) নিজে খলীফা হয়েও ঐ সম্পত্তি দাবী করেননি।
যেহেতু রসুলদের (সা:) সম্পদের উত্তরাধিকার হয় না তাই আবু বকর (রা:), ফাতেমা (রা:) এর কাছে বাগে ফাদাকের কতৃত্ব দেননি। কারন আবু বকর (রা:) সবসময় রসুলের (সা:) অনুসরণ করতেন, তিনি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনে। রসুল (সা:) যেভাবে বন্টন করেছিলেন সেভাবেই বন্টন করেছেন।
তাহলে ফাতেমা (রা:), আলী (রা:) সহ কেন অধিকার দাবি করলেন ও অভিমান করলেন?
মূলত তারা সম্পদের মালিকানা নয় বরং তত্বাবধায়ন দাবি করেছিলেন! সবগুলো হাদীস দেখলে তা স্পষ্ট। কারন রসুল (সা:) হতে তারা ইলেমের অধিকারী ছিলেন আহলে বায়াতের উপর জুলুম হবে। হয়তো তারা ধারণা করেছিলেন রসুলের (সা:) পরবর্তীতে তাদের উপর জুলুম, নির্যাতন হবে ও অধিকার হরন করা হবে (এই বিষয়ে পোস্ট আছে)।
বনু উমাইয়ার শাসনামলে তাই হয়েছিল। হুসাইন (রা:) সহ আহলে বায়াতের হত্যা, জুলুম, আলীর (রা:) ওপর লানত ও গালি দেওয়া হতো। উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ:) এসে তা বন্ধ করেন এবং বাগে ফাদাকের তত্বাবধায়ন আহলে বায়াতের হাতে ন্যস্ত করেন।
তার শাসনমাল পরবর্তীতে আবার আহলে বায়াতের উপর জুলুম চলে, অধিকার হরন করা হয়। অপরদিকে আবু বকর (রা), উমর (রা) বেচে থাকতে আহলে বায়াতের অধিকার দেওয়া হবে না তা ছিল অসম্ভব। তাই তারা রসুলের (সা:) অনুসরণ করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রেখে এই সম্পদ হতে আহলে বায়াতের ভরনপোষণ, গরীবদের জন্য খরচ করতেন।
হাদীসে এসেছে – আবদুল আযীয ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) … উম্মূল মুমিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ফাতিমা বিনতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের পর তাঁর মিরাস বন্টনের দাবী করেন। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফায় (বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ) হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁকে প্রদত্ত সম্পদ থেকে রেখে গেছেন। তখন আবূ বাকর (রাঃ) তাঁকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমাদের পরিত্যাক্ত সম্পদ বন্টিত হবে না আমরা যা ছেড়ে যাই, তা সাদকা রূপে গণ্য হয়।’ এতে ফাতিমা বিনতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট হলেন এবং আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এর সঙ্গে কথাবার্তা বলা ছেড়ে দিলেন। এ অবস্থা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর ফাতিমা (রাঃ) ছয় মাস জীবিত ছিলেন।
আয়িশা (রাঃ) বলেন, ফাতিমা (রাঃ) আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ত্যাজ্য খায়বার ও ফাদাকের ভূমি এবং মদিনার সাদকাতে তাঁর অংশ দাবী করেছিলেন। আবূ বকর (রাঃ) তাঁকে তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানান এবং তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আমল করতেন, আমি তাই আমল করব। আমি তাঁর কোন কিছুই ছেড়ে দিতে পারি না। কেননা, আমি আশঙ্কা করি যে, তাঁর কোন কথা ছেড়ে দিয়ে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে না যাই। অবশ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদিনার সাদকাকে উমর (রাঃ) তা আলী ও আব্বাস (রাঃ) কে হস্তান্তর করেন। আর খায়বার ও ফাদাকের ভূমিকে পূর্ববৎ রেখে দেন।
উমর (রাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ সম্পত্তি দু’টিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জরুরী প্রয়োজন পূরণ ও বিপথকালীন সময়ে ব্যায়ের জন্য রেখেছিলেন। সুতরাং এ সম্পত্তি দু’টি তারই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে, যিনি মুসলমানদের শাসন ক্ষমতার অধিকারী খলিফা হবেন।’ যুহরী (রহঃ) বলেন, এ সম্পত্তি দু’টির ব্যবস্থাপনা অদ্যবধি সেরূপই রয়েছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (বুখারী, ২৮৭৪)
অপর হাদীসে এসেছে –
ইয়াহইয়া ইবনু বুকায়র (রহঃ) … মালিক ইবনু আউস ইবনু হাদাছান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। মুহাম্মদ ইবনু জুবায়র ইবনু মুতঈম আমাকে (মালিক ইবনু আউস ইবনু হাদাছান) এর পক্ষ থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি বলেনঃ আমি মালিক ইবনু আউস (রাঃ) এর কাছে চলে গেলাম এবং ঘটনাটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন যে, আমি উমর (রাঃ) এর নিকট গিয়েছিলাম। এমন সময় তাঁর দারোয়ান ইয়ারফা সেখানে উপাস্থিত হয়ে বলল, আপনি উসমান, আবদুর রাহমান, যুবায়র ও সা’দ (রাঃ) কে ভিতরে আসার অনুমতি দিবেন কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তিনি তাঁদেরকে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন। এরপর সে উমর (রাঃ) এর নিকট এসে বলল, আপনি আলী ও আব্বাস (রাঃ) কে ভিতরে আসার অনুমতি দিবেন কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন! আমার এবং এর মাঝে মীমাংসা করে দিন।
উমর (রাঃ) বললেনঃ আপনাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলি যার হুকুমে আকাশ ও যমীন প্রতিষ্ঠিত আছে; আপনারা কি জানেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমাদের কোন উত্তরাধিকারী থাকবে না, আমরা যা কিছু রেখে যাব সবই হবে সাদাকা স্বরূপ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দ্বারা নিজেকেই উদ্দেশ্য করেছিলেন। দলের লোকেরা বলল, অবশ্যই তিনি তা বলেছেন।
এরপর তিনি আলী ও আব্বাস (রাঃ)-এর দিকে মুখ করে বললেনঃ আপনারা কি জানেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছিলেন? তারা উভয়ে জবাব দিলেন, অবশ্যই তিনি তা বলেছেন।
উমর (রাঃ) বললেনঃ এখন আমি এ ব্যাপারে আপনাদের কাছে বর্ণনা রাখছি যে, আল্লাহ তায়ালা এ ফায় (বিনা যুদ্ধেপ্রাপ্ত ধন সম্পদ) এর ব্যাপারে তার রাসুলকে বিশেষত্ব প্রদান করেছেন, যা আর অন্য কাউকে করেননি। তিনি (আল্লাহ তা’আলা) বলেনঃ مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ থেকেقَدِيرٌ পর্যন্ত তিলাওয়াত করে শোনালেন। এবং বললেনঃ এটা তো ছিল বিশেষ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য। আল্লাহ তা’আলার কসম! তিনি আপনাদের ব্যতীত অন্য কারও জন্য এ মাল সংরক্ষণ করেননি। আর আপনাদের ব্যতীত অন্য কাউকে এতে প্রাধান্য দেননি। এ মাল তো আপনাদেরই তিনি দিয়ে গিয়েছেন এবং আপনাদের মাঝেই বণ্টন করেছেন। পরিশেষে এ মালটুকু অবশিষ্ট ছিল। তখন তিনি তার পরিবার-পরিজনের বছরের ভরণ-পোষনের জন্য এ থেকে খরচ করতেন। এরপর যা অবশিষ্ট থাকত তা আল্লাহর মাল হিসেবে (তার রাস্তায়) খরচ করতেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার গোটা জীবদ্দশায়ই এরূপ করে গিয়েছেন। আমি আপনাদের আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, এ কথাগুলো কি আপনারা জানেন? তারা বললেনঃ হ্যাঁ। এরপর তিনি আলী (রাঃ) ও আব্বাস (রাঃ) এর দিকে লক্ষ্য করে বললেনঃ আমি আপনাদের দু’জনকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আপনারা কি এ কথাগুলো জানেন? তাঁরা উভয়ে বললেনঃ হ্যাঁ। এরপর আল্লাহ তার নবীকে ওফাত দান করলেন তখন আবূ বকর (রাঃ) বললেনঃ আমি আল্লাহর রাসুলের ওলী। এরপর উক্ত মাল হস্তগত করলেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে তা ব্যবহার করেছিলেন তিনিও তা সেভাবে ব্যবহার করেছেন।
এরপর আল্লাহ তাআলা আবূ বকর (রাঃ)-এর ওফাত দান করলেন। তখন আমি বললাম, আমি আল্লাহর রাসুলের ওলীর ওলী। আমি এ মাল হস্তগত করলাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর (রাঃ) এ মালের ব্যাপারে যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন দু’বছর যাবত আমি এ মালের ব্যাপারে সেই নীতি অবলম্বন করে আসছি।
এরপর আপনারা আমার কাছে আসলেন আর আপনাদের উভয়ের বক্তব্যও এক এবং ব্যাপারটিও অনুরূপ। (হে আব্বাস (রাঃ)) আপনি তো আপনার ভাতিজার থেকে প্রাপ্য অংশ আমার কাছে চাইছেন। আর আলী (রাঃ) আমার কাছে তার স্ত্রীর অংশ যা তার পিতা থেকে প্রাপ্য আমার কাছে তলব করছেন। সুতরাং আমি বলছি, আপনারা যদি এটা চান তাহলে আমি আপনাদেরকে তা দিয়ে দিতে পারি। এরপর কি আপনারা অন্য কোন ফায়সালা আমার কাছে চাইবেন? ঐ আল্লাহর কসম! যার হুকুমে আকাশ ও যমীন প্রতিষ্ঠিত আছে। আমি যে ফায়সালা প্রদান করলাম কিয়ামত পর্যন্ত এ ছাড়া আর অন্য কোন ফায়সালা দিতে পারব না। আপনারা যদি এ ধনসম্পদের শৃংখলা বিধানে অক্ষম হন তবে তা আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন, আমি তার শৃংখলা বিধান করব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (বুখারী)
বর্ণনাকারীঃ মালিক ইবনু আওস
আর আহলে বায়াতের প্রতি আবু বকর (রা:), উমর (রা:) এর ভালোবাসা, সম্মান ছিল সন্দেহাতীত।
আবদুল্লাহ ইবনু আবদুল ওয়াহহাব (রহঃ) … আবূ বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবারবর্গের প্রতি তোমরা অধিক সম্মান দেখাবে। হাদিসের মানঃ সহিহ (বুখারী)
আর আলী (রা:) নিজেই আবু বকর (রা:) ও উমর (রা) কে উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হিসেবে মানতেন। তাই আমরা এসব ইজতেহাদী বিষয়ে সবার ব্যাপারে সুধারনা পেষন করবো।