কয়েকবছর আগের কথা- তখন কাওরান বাজার হতে হেটে সকালে ফজরটা কাকরাইল মসজিদে পড়তাম। এমনি এক প্রভাতে রমনার পাশের ফুটপাত দিয়ে হাটছিলাম।
হঠাৎ দেখলাম জীর্ন, ছেড়া পোশাক পরা এক মহিলা দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হতে গেল কিন্তু চলন্ত গাড়ির আঘাতে মাঝ রাস্তায় পড়ে গেল। খুব ভোর তবুও কিছু গাড়ি ছুটছিল আর আহত মহিলা উল্টো হয়ে পরে রইলো।
কিছু গাড়ি পাশ কাটিয়ে কষ্ট করে মহিলার কাছে পৌছালাম। একলা তাকে ধরে মাঝরাস্তায় হতে নিরাপদ জায়গায় আনা যাবে না। আশেপাশের কেউ সাহায্য করতে এল না, অনেক অনুরোধের পর এক সিএনজি ড্রাইভার রাজি হলো।
আহত মহিলাটিকে ধরে ফুটপাতে নিয়ে আসলাম। দেখলাম মাথা দিয়ে প্রচন্ড রক্ত ঝরছে আর মহিলা চিৎকার করছে – ভাই আমারে বাঁচান। সিএনজির ড্রাইভার পুলিশ ঝামেলায় পড়তে পারে এই ভেবে পালালো।
আমি কিছুক্ষণ রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। আশেপাশের কিছু মানুষ ছিল বলল এই মহিলা ফুটপাতে থাকে ভিক্ষুক, কেউ বলল দেহ ব্যবসায়ী। তাই তারা সাহায্য করতে চাইলো না, আর পুলিশের ভয় তো আছেই।
এইদিকে মহিলার অবস্থা খুব খারাপ – আমাকে ধরে ভাই বাচান বাচান করে কাদছে। একে তো সকালবেলা তার উপর আমার পকেট ফাঁকা কি করা যায় বুঝছি না।
মহিলাকে বসিয়ে কাকরাইল মসজিদের দিকে গেলাম – পানিসহ, ব্যান্ডিস বা কিছু সাহায্য পাওয়া যায় কিনা!!.
কিছুটা সাহায্য নিয়ে যখন ফিরলাম – দেখি মহিলাটি নেই, অনেককে জিগাস করলাম কেউ জানে না। জানি না কি হয়েছিল- হয়তো কোন দয়াবান ব্যক্তি নিয়ে গেছে চিৎকিসা করাতে।
তবে সেদিন একটা জিনিস বুঝেছি – আমাদের সমাজে নিম্নমধ্যবিত্ত, গৃহহারারা কোন অপরাধ করলে এটাকে সবচেয়ে বড় পাপ ভেবে ঘৃণা করা হয়। অথচ এরচেয়ে বড় পাপী মডেল, অশ্লীল তারকা, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি সসম্মানে গাড়িতে চড়ে বেড়ায়। তাদের হাতের রুমালটা পড়লেও উঠিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব হবে না ওদের নাম হয় আবার সেলেব্রিটি!!
অনেকের চোখে মহিলাটি নিম্নধরের পতিতা ছিলো- আমার কাছে অসহায় এক বোন ছিল আর ইসলাম আমাকে প্রতিবেশীর হক্ব শিখিয়েছিল যদিও সেদিন আদায় করতে পারিনি।
এই পার্কে বহু মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত তরুন-তরুনী প্রেমের বিকাশ করে ওদের মানুষ ততটা ঘৃনা করে না যতটা এসব অসহায় পেটের দায়ে যারা দেহ ব্যবসা করে তাদের ভাবা হয়।
এমন না আমি তার পাপকে সমর্থন দিচ্ছি বরং তারা পাপের তুলনায় ঘৃণা অনেক বেশি পায় অথচ এরচেয়ে বড় পাপ করেও অনেকে সম্মানিত!! অথচ মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় পাপ হল শিরক। যারা আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে তাদের আমরাই মাননীয় বলে সম্মান করে চলছি।
অথচ আল্লাহ বলেন –
“আমি তাওরাত অবর্তীর্ন করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বর, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদীদেরকে ফয়সালা দিতেন। কেননা, তাদেরকে এ খোদায়ী গ্রন্থের দেখাশোনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তাঁরা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াত সমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্যে গ্রহণ করো না, যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই কাফের।”
সুরা মায়েদাহ -৪৫
অথচ যারা আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করে শিরকী নিয়মনীতি চালু করছে অনেক আলেমকে দেখি তাদের অসুস্থতায় দোয়া ও মিলাদ পড়ে।
আরেকদিনের ঘটনা – পকেটে অল্প কিছু টাকা নিয়ে বিকালে নাস্তার জন্য বের হলাম। হোটেলের কাছে গেলে এক ভদ্রমহিলা জিগাস করলো – পরোটার দাম কত!! আমি দাম বললাম। মহিলা ইতস্তত হয়ে চলে যাচ্ছিলো।
দেখে মহিলাকে ভদ্র পরিবারের লাগলো বললাম – আপনি কিছু খাবেন আমি দাম পরিশোধ করবো।
মহিলা লজ্জা পেল- রাজি হচ্ছিল না, বার বার বলতে লাগলো ছাত্র মানুষ তোমার টাকা নষ্ট হবে!!
আমি বললাম – বোনের জন্য ভাইয়ের টাকা খরচ করবে এটাই সার্থকতা। হোটেলের লোকগুলোও ভালো ছিলো – তারা অনুরোধ করলো, মহিলা পেটভরে ভাত খেলেন, বুঝলাম প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিল।
মহিলা অনেক দোয়া করলেন – বললো বেচে থাকো, আমি বললাম – নিষ্ঠুর সমাজে বেচে থাকতেই ভয় লাগে বেশি।
আহা! এমন যুগ ছিল মুসলিমদের বিলীসিতা ছিল না।
অভাব ছিলো নিত্যসঙ্গী তবু তারা সাধ্য থাকলে কাউকে ক্ষুধার্ত রাখতো না। তারা এই সুন্নাহ মেনে চলতো-
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুজনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট। আর তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৩৯২)।
আজ খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় – একজনে কিভাবে তিনজনের খাবার খেতে পারে।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মু’মিন এক পেটে খায় আর কাফির সাত পেটে খায়।
(সহীহ বুখারী ৫৩৯৬,মুসলিম ৩৬/৩৫, হাঃ ২০৬২, ২০৬৩, আহমাদ ৭৭৭৭)
যেসব লোক ও রেষ্টুরেন্ট এগুলো প্রচার করে তাদের পরিহার করুন। এখন পকেটে টাকা থাকে, দীর্ঘদিন কিছু আয় করেছি।
প্রায় আত্মীয়-স্বজনরা, এলাকার পরিচিতরা টাকা ধার চায়- আগে দিতাম, ফেরতও পেতাম না। খোজ নিয়ে দেখলাম – কেউ আমার টাকা দিয়ে নতুন জামা কিনে, কেউ বিভিন্ন জায়গয় ঘুরে, কেউ গার্লফ্রেন্ডদের পিছে খরচ করে। এখন চাইলে বলি – আমার টাকা খরচ করবো জান্নাতের পথে আর কারো জাহান্নামের পথ সহজ করার জন্য নয়। আমাদের সমাজব্যবস্হা এমন- ভরাপেটকে (ধনীদের) খাদ্য (দাওয়াত) দেয় আর যার জামা কেনার ক্ষমতা আছে তাকে গিফট করে অথচ ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীনদের অধিকারটা বেশি।
হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২৬৯৯; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১১২)
আরও বর্নিত আছে-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যর রা.- কে বলেন, হে আবু যর, তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো। (সহীহ মুসলিম)
আর আমরা গরিব গৃহকর্মী, ছোট শিশুদের সাথে কতটা নির্দয় – ওদের সাথে একসাথে খাওয়া যাবে না, একসাথে বসা যাবে না।
অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের খাদেম যখন তোমাদের জন্য খানা প্রস্ত্তত করে নিয়ে আসে তখন তাকে যদি সাথে বসিয়ে খাওয়াতে না-ও পার তাকে দু এক লোকমা হলেও দাও। (সামান্য কিছু দিয়ে হলেও তাকে এই খানায় শরিক কর) কারণ, সে-ই তো এই খানা প্রস্ত্তত করার কষ্ট ও আগুনের তাপ সহ্য করেছে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪৬০)।
প্রতিবেশীর হক্ব আদায় না করে অনেকে জান্নাতে যেতে চান। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিবরীল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাছের অংশিদার বানিয়ে দেয়া হবে। (দ্র.সহীহ বুখারী ৬০১৪;সহীহ মুসলিম)।
অল্পকিছু লোক আছে এমন- যারা দ্বীনের জ্ঞান নিয়ে গরিব, বস্তিবাসীর কাছে গিয়েছে অথচ দ্বীন জানা তাদের অধিকার আর আমাদের দায়িত্ব জানানো।
মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,
‘ওই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করে’
সূরা হামিম সিজদাহ-৩৩
মহান রাব্বুল আলামিন আরও ইরশাদ করেন,
‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং নিষেধ করবে মন্দ কাজ থেকে’
সূরা ইমরান